ঢাকা, মঙ্গলবার, ৯ পৌষ ১৪৩১, ২৪ ডিসেম্বর ২০২৪, ২১ জমাদিউস সানি ১৪৪৬

স্বাস্থ্য

৩ মাস ধরে বেতন-ভাতা বন্ধ ইমপালস হাসপাতালের কর্মরতদের

স্টাফ করেসপন্ডেন্ট | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ০০৩৫ ঘণ্টা, মে ২২, ২০২৩
৩ মাস ধরে বেতন-ভাতা বন্ধ ইমপালস হাসপাতালের কর্মরতদের

ঢাকা: রাজধানীর ইমপালস হাসপাতাল পরিচালনা পর্ষদের একাংশের অনৈতিক সিদ্ধান্ত ও দুর্নীতির কারণে গত তিন মাস ধরে ইমপালস হাসপাতালের কর্মকর্তা-কর্মচারীদের বেতন-ভাতা বন্ধ রয়েছে।

রোববার (২১ মে) একটি সূত্রে এতথ্য জানা গেছে।

 

ঈদের আগে বেতন-ভাতার দাবিতে ডাক্তার, নার্স, আয়া, বুয়া, প্রশাসনিক কর্মকর্তা-কর্মচারীরা আন্দোলন করেছেন।

সেই সময় কর্তৃপক্ষ প্রতিশ্রুতি দিয়েছিল দ্রুত তাদের বেতন-ভাতা পরিশোধ করা হবে, কাউকে ছাঁটাই করা হবে না। কিন্তু কোনো প্রতিশ্রুতি রক্ষা না করে পরিচালকদের একাংশের ষড়যন্ত্রের কারণে ডুবতে বসেছে রাজধানীর স্বনামধন্য বেসরকারি খাতের এই হাসপাতালটি। বর্তমান রোগীরাও উন্নতমানের চিকিৎসা সেবা থেকে বঞ্চিত হচ্ছেন বলে অভিযোগ পাওয়া গেছে।

সম্প্রতি কর্মকর্তা-কর্মচারী, ডাক্তার ও নার্সসহ হাসপাতালের অন্যান্য স্টাফরা বেতন-ভাতা নিয়মিত করার দাবিতে শ্রম ও কর্মসংস্থান মন্ত্রণালয়, অর্থমন্ত্রণালয় ও স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়সহ সরকারের সংশ্লিষ্ট দপ্তরে চিঠি পাঠিয়ে বিষয়টি জানিয়েছে। একই সঙ্গে সমস্যা সঙ্কটের প্রতিকার চেয়েছে তারা। চিঠিতে হাসপাতালের বিভিন্ন দুর্নীতির বিষয়টি উল্লেখ করা হয়।  

এতে অভিযোগ করা হয়েছে- একদিকে, হাসপাতালটির প্রতিষ্ঠাতা উদ্যোক্তা ও  ব্যবস্থাপনা পরিচালক (এমডি) ডা. আলী জাহীর আল-আমীনকে সরিয়ে দখলের ষড়যন্ত্র, অন্যদিকে লিগ্যাল খরচের নামে ক্যাশ থেকে নগদ অর্থ লুটপাটে নাজুক অবস্থায় পড়েছে হাসপাতালটি। গত তিন মাস ধরে ডাক্তার ও নার্সসহ শত শত কর্মকর্তা-কর্মচারীদের বেতন-ভাতা বকেয়া রয়েছে। বিভিন্ন অজুহাতে কর্মকর্তা-কর্মচারীদের ছাঁটাই করা হলেও অন্যদিকে আবার নতুন লোকবল নিয়োগ দেওয়া হচ্ছে।  

অভিযোগের তীর মহিলা দলের নেত্রী খালেদা ইয়াসমিনের বিরুদ্ধে। যিনি হাসপাতালটির একজন পরিচালকও। এছাড়া অভিযোগ উঠেছে বাংলাদেশ মেডিকেল ও ডেন্টাল কাউন্সিলের (বিএমডিসি) বিরুদ্ধেও। সংস্থাটির অনৈতিক সিদ্ধান্তে ক্ষুব্ধ চিকিৎসক সমাজ।  

জানা গেছে, ঘটনার সূত্রপাত ২০২০ সালের মার্চ মাসের মিসেস মোমেনা হক মুন নামে একজন রোগীর বাম কানের প্যারোটিড গ্ল্যান্ডের একটি টিউমার অপারেশনকে কেন্দ্র করে। এই অপারেশনটি করতে গিয়ে ডানকানেও রোগটির বিস্তার রয়েছে বলে সন্দেহ করে ডা. আলী জাহীরসহ অপারেশনে নিয়োজিত বিশেষজ্ঞ ডাক্তাররা। এ কারণে রোগীর তাৎক্ষণিক সম্মতিতে বামকানের পাশাপাশি ডানকানেও অপারেশন করা হয়। অপারেশনের পর রোগী ভালো ও সুস্থ আছেন। দীর্ঘ তিন বছরেও তার মুখ বেঁকে যায়নি।  

সাধারণত এ ধরনের রোগের চিকিৎসায় রোগীর মুখ বেঁকে যাওযার ঝুঁকি থাকে। কিন্তু মিসেস মুনের ক্ষেত্রে সেটি পরিলক্ষিত হয়নি। এক্ষেত্রে তিনি ভাগ্যবতীও। বর্তমান তিনি এ টিউমারটি থেকে সম্পূর্ন সুস্থ আছেন। তবে সমস্যা তৈরি হয় অন্য জায়গায়। ডা. আলী জাহীর আল-আমীনের অভিযোগ, হাসপাতাল থেকে তাকে অপসারণের জন্য যারা দীর্ঘদিন ধরে চেষ্টা করছিলেন সেই খালেদা ইয়াসমিন গং ঘটনাটিকে পুঁজি করে গভীর ষড়যন্ত্রে লিপ্ত।  

তারা রোগী মুন ও তার স্বামীকে ডা. জাহীর ভুল অপারেশন করেছে এবং তিনি বিপুল অঙ্কের ক্ষতিপূরণ দাবি করতে পারেন বলে বুঝিয়েছেন। এভাবেই নানা নাটকীয় ঘটনার মাধ্যমে পুরো বিষয়টি জটিল হয়ে ওঠে। অবশেষে রোগীর অভিযোগ ও হাসপাতালটির পরিচালকদের একাংশের গভীর ষড়যন্ত্রের মুখে ডা. জাহীর আল-আমীনের চিকিৎসা নিবন্ধন এক বছরের জন্য স্থগিত করে দেয় বাংলাদেশ মেডিকেল ও ডেন্টাল কাউন্সিল (বিএমডিসি)। সেই সঙ্গে ডা. জাহীর প্রতিষ্ঠাতা পরিচালক হওয়ার পরও হঠাৎ অন্য একটি বোর্ড সভার মাধ্যমে খালেদা ইয়াসমিনকে ব্যবস্থাপনা পরিচালক করা হয়, যার কোনো আইনি বৈধতা নেই বলে জানা গেছে।  

একই সঙ্গে ডা. জাহীরকে অপমান করে হাসপাতাল থেকে বের করে দেওয়া হয়। মহামারি করোনাকালে ডা. জাহীরের নেতৃত্বে কোভিড রোগীদেরও সেবা দিয়ে হাসপাতালটি বেশ সুনাম কুড়িয়েছিল। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার আহ্বানে সাড়া দিয়ে সেই সময় করোনা রোগীদের স্বল্প ব্যয়ে চিকিৎসা দিয়েছিল ইমপালস হাসাপাতাল কর্তৃপক্ষ। এখন শুধু মালিক পক্ষের দ্বন্দ্বে ডুবতে বসেছে হাসপাতালটি। একদিকে হাসপাতালটির ব্যবস্থাপনা পরিচালককে (এমডি) সরিয়ে দখলের পাঁয়তারা, অন্যদিকে অর্থ আত্মসাতের মতো ঘটনায় হাসপাতালটির স্বাভাবিক কাজকর্ম হুমকির মুখে পড়েছে। এ কারণে হাসপাতালের কর্মরত ডাক্তার, নার্স, আয়া-বুয়াসহ শ্রমিক কর্মকর্তা-কর্মচারী কেউ এখন আর এখানে ভালো নেই।  

বিশেষ করে বেতন-ভাতা বকেয়া থাকার কারণে কর্মকর্তা কর্মচারীদের মধ্যে দিনদিন অসস্তোষ বেড়েছে। সম্প্রতি বেতন-ভাতা পরিশোধে কর্মকর্তা-কর্মচারীদেরও পক্ষ থেকে আল্টিমেটামও দেওয়া হয়েছে।  

এ প্রসঙ্গে হাসপাতালটির এমডি ডা. আলী জাহীর আলামীন বলেন, গত ০৯ জানুয়ারি হঠাৎ একটি অবৈধ বোর্ড সভার মাধ্যমে খালেদা ইয়াসমিনকে এমডি করা হয়। যার কোনো আইনি বৈধতা নেই। খালেদা ইয়াসমিনের নেতৃত্বে আমাকে অপমান করে হাসপাতাল থেকে বের করে দেওয়া হয়। এরপর থেকেই বেতন-ভাতা বন্ধ রয়েছে। তাদের আন্দোলনের মুখে ষড়যন্ত্রকারীরা সাময়িক পিছু হটলেও তাদের কারসাজি থেমে নেই।  

তিনি বলেন, আমার বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র হচ্ছে। বিএমডিসি সেই আগুনে আরও ঘি ঢেলে দিয়ে পরিস্থিতি জটিল করেছে।  

প্রতিষ্ঠাকাল থেকে তিনি অবৈতনিক এমডি হিসেবে হাসপাতালে সেবা দিয়ে যাচ্ছেন।  

মুনের অপারেশনটি সঠিক ছিল দাবি করে তিনি বলেন, রোগীর স্বার্থেই সেই সময় এমন সিদ্ধান্ত নিতে হয়েছিল। রোগীর পীড়াপীড়িতে এবং মৌখিক সম্মতির ভিত্তিতে এবং অপারেশন কনসেন্ট ফর্মে অতিরিক্ত অপারেশন করার অনুমতির কারণে আমরা বামদিকের পাশাপাশি ডানদিকেও অপারেশন করি এবং সেই দিকেই সমস্যা ধরা পরে বায়োসপি রিপোর্টে। আর এ কারণেই তিনি এখনো সুস্থ আছেন।  

তিনি আরও জানান, বিএমডিসি যেটা করেছে আমরা তার বিরুদ্ধে আদালতে যাব। আমার মনে হয় এখানে হয়তো প্রকৃত সত্যটা বের হয়ে আসবে। আমার প্রতি সুবিচার করা হয়নি। এদেশের নাগরিক হিসেবে সুবিচার পাওয়া এবং চাওয়ার অধিকার আমার রয়েছে।  

অভিযোগ রয়েছে বিএমডিসির ভারপ্রাপ্ত রেজিস্টার ডা. লিয়াকত হোসেনের একচ্ছত্র আধিপত্যের কারণে প্রতিষ্ঠিত ডাক্তাররা সুনামের সঙ্গে দায়িত্বপালন করতে পারছে না। দুর্নীতি কমিশন (দুদক), স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় এবং স্বাস্থ্য অর্থনীতি বিভাগে ইতোমধ্যে এ ব্যাপারে একাধিক অভিযোগ জমা পড়েছে বলেও জানা গেছে।  

এ প্রসঙ্গে ডা. লিয়াকত হোসেনের সঙ্গে যোগাযোগ করা হলে তাকে অফিসে পাওয়া যায়নি। পরবর্তীকালে তার মোবাইলফোনে যোগাযোগ করা হলে তিনি ফোনটি ধরেন। তবে এ প্রসঙ্গে কথা বলতে গেলে তিনি ব্যস্ততা দেখিয়ে এড়িয়ে যান এবং ফোনটি রেখে দেন।  

এ প্রসঙ্গে মুনের স্বামী জিয়াউর রহমান ভূঁইয়া বলেন, আসলে রোগীর মুখ বেঁকে যায়নি বা সেরকম কোনো ক্ষতিও হয়নি। তবে তার মেন্টাল ট্রমা হয়ছে। আমরা যারা কাছের মানুষ তারাই শুধু বিষয়টি বুঝতে পারি। তবে এ প্রসঙ্গে বাংলাদেশ মেডিকেল অ্যাসোসিয়েশনের (বিএমএ) সাবেক সভাপতি ও স্বাস্থ্য অধিকার আন্দোলনের জাতীয় কমিটির সভাপতি অধ্যাপক ডা. রশীদ-ই-মাহবুব বলেন, চিকিৎসাসেবা দেওয়ার ক্ষেত্রে ডাক্তারের ভুল হওয়ার বিষয়টি অস্বাভাবিক কিংবা অসম্ভব কিছু নয়। তবে দেখতে হবে ভুল করার ক্ষেত্রে চিকিৎসকের কোনো অবহেলা ছিল কি না। যদি অবহেলার কারণে কোনো রোগী ভুক্তভোগী হয়, সেটা খুবই অনাকাঙ্ক্ষিত। এ বিষয়ে আরও বেশি সচেতন হওয়া প্রয়োজন। তবে ভুলপ্রান্তি হতেই পারে। মানুষ মাত্রই ভুল হয়। তবে আমাদের দেখতে হবে রোগীর কোনো ক্ষতি হয়েছে কি না।  

খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, শুধুমাত্র লিগ্যাল খরচ দেখিয়ে গত তিন মাসে ৫২ লাখ টাকা ক্যাশ হিসাব থেকে নিয়ম বর্হিভূতভাবে নেওয়া হয়। কর্মচারীদেরও বেতন বন্ধ থাকলেও মিসেস খালেদা ইয়াসমিনের ওষুধ বিলবাবদ বাকি আছে ৪৬ হাজার টাকা। গত ০৯ জানুয়ারি থেকে ০৫ এপ্রিল পর্যন্ত ফার্মেসির স্টক কমেছে ১ কোটি ৩ লাখ টাকা থেকে ৮৩ লাখ টাকায়। অর্থাৎ এখানে ২০ লাখ টাকার স্টক কমে গেছে। একই সময়ে ফার্মেসি থেকে বিক্রি হয়েছে ৯০ লাখ টাকার মতো আর বিপরীতে ওষুধ কেনা হয়েছে ৪৭ লাখ টাকার।  

অর্থাৎ এখানে ৪৩ লাখ টাকার ওষুধ কমে গেছে। এতে করে বর্তমানে রোগীরা হাসপাতালের ফার্মেসি থেকে ওষুধ পাচ্ছে না। অর্থাৎ ফার্মেসির লোকসান হয়েছে ৬৩ লাখ টাকা। এছাড়া বিদ্যুৎ, পানি ও গ্যাস বিল বকেয়া রয়েছে।  

নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক হাসপাতালের একজন কর্মকর্তা বলেন, গত তিন মাসেরও বেশি সময় ধরে বেতন-ভাতা হচ্ছে না। চাকরি ছাঁটাইয়েরও হুমকি রয়েছে। এ অবস্থায় চাকরি করা কঠিন হয়ে পড়ছে।  

বাংলাদেশ সময়: ০০৩০ ঘণ্টা, মে ২২, ২০২৩
এমকে/এসআরএস

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।