ঢাকা, সোমবার, ৮ পৌষ ১৪৩১, ২৩ ডিসেম্বর ২০২৪, ২০ জমাদিউস সানি ১৪৪৬

স্বাস্থ্য

খুলনার কমিউনিটি ক্লিনিকগুলোতে রোগীও নেই ডাক্তারও নেই

মাহবুবুর রহমান মুন্না, জেলা প্রতিনিধি | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ০৬২২ ঘণ্টা, সেপ্টেম্বর ৩০, ২০১২
খুলনার কমিউনিটি ক্লিনিকগুলোতে রোগীও নেই ডাক্তারও নেই

খুলনা: খুলনা জেলার কমিউনিটি ক্লিনিকগুলো রোগীদের কাঙ্খিত প্রত্যাশা পূরণ করতে পারছেনা। রোগী থাকলে চিকিৎসক নেই, চিকিৎসক থাকলে ওষুধ নেই।

শত সমস্যায় ভরপুর এ ক্লিনিকগুলো। তবুও এভাবেই চলছে গরীবের জন্য তৈরি খুলনার ১৬৯টি কমিউনিটি ক্লিনিক।

প্রত্যন্ত অঞ্চলের মানুষের মধ্যে চিকিৎসা সেবা পৌঁছে দিতে সরকারের এ উদ্যোগ প্রশংসা এক সময় পেলেও এখন মানুষ এগুলোকে নিয়ে ধিক্কার দিতে বেশি ব্যস্ত। কতিপয় অসাধু চিকিৎসক ও কর্মচারীর কারণে সরকারের এ মহৎ উদ্যোগটি আজ সারাদেশের মানুষের কাছে ভোগান্তির স্থানে পরিণত হয়েছে।

সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের নিষ্ক্রিয়তা, নেই জবাবদিহিতা, নেই মনিটরিং ব্যবস্থা সবমিলিয়ে এটি যেন সরকারের একটি উদাসীন প্রকল্পে পরিণত হয়েছে।

এসব কারণে এ কমিউনিটি ক্লিনিকগুলোর স্বাস্থ্য সেবা ও পরিবেশ নিয়ে প্রশ্ন ওঠেছে।

বাংলানিউজের অনুসন্ধানমূলক প্রতিবেদনের তথ্য সংগ্রহ করতে গিয়ে জেলার কমিউনিটি ক্লিনিক নিয়ে রোগীদের পাহাড় সমান অভিযোগ পাওয়া গেছে। শুধু রোগীদের অভিযোগ নয়, অভিযোগ সাধারণ মানুষেরও। অনেকেই অভিযোগ করেন, সরকার শুধু শুধুই এগুলোর পেছনে টাকা খরচ করছেন।  

জেলায় চালুকৃত ১৬৯টি কমিউনিটি ক্লিনিকে খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, সেবাদানকারীদের অনুপস্থিতির কারণে অধিকাংশ ক্লিনিক বিধিমতো কাজ করছে না। এসব ক্লিনিকে জবাবদিহিতার কোনো বালাই নেই।

কয়রা উপজেলার সুতারখালী গ্রামে গিয়ে সেখানকার কমিউনিটি ক্লিনিকের ব্যাপারে জানতে চাইলে সাংবাদিক পরিচয় পাওয়ার পর ভোক্তভোগীদের মধ্যে অনেকেই সবার আগে অভিযোগ দেওয়ার প্রতিযোগীতায় নেমে পড়েন।
অনেকের মধ্যে এক ভুক্তভোগী বাংলানিউজকে জানান, সকাল ১১টার দিকে ক্লিনিকে গেলেও বন্ধ পাওয়া যায়। ডাক্তার তো কোনো সপ্তাহে আসে আবার আসেনা। সারাদিন অপেক্ষা করে অনেকে আবার বাড়ি চলে যায়।
তিনি আরও বলেন, মানুষ এগুলো কোনো চিকিৎসায় পায়না। সবাই হাসপাতালেই যায়।

ওই গ্রামের আব্দুল হাফিজ বাংলানিউজকে জানান, তার ইউনিয়নের ক্লিনিকগুলোতে ওষুধের জন্য অর্থ দিতে হয়। ওই টাকা তাদের কাছ থেকে নেওয়া হয় ক্লিনিক ব্যবস্থাপনার কথা বলে।

বটিয়াঘাটা উপজেলার জলমা ইউনিয়নের স্কুল শিক্ষক আব্দুস সালাম বাংলানিউজকে জানান, তার এলাকায়ও দুই টাকা করে কমিউনিটি ক্লিনিকে রোগীদের কাছ থেকে নেওয়া হয়।    

দাকোপ উপজেলার কালাবগী গ্রামের কলেজ শিক্ষক মো. সেলিম বাংলানিউজে বলেন, “ক্লিনিকগুলোতে প্রতিবন্ধী ও বয়স্কদের সেবার কোনো ব্যবস্থা নেই। স্বাস্থ্য ও পরিবার পরিকল্পনা সহকারীদের মধ্যে যারা ক্লিনিকে আসেন, তারাও সময় মানেন না। স্বাস্থ্য ও পরিবার পরিকল্পনা সহকারীর সঙ্গে ইউনিয়ন ও উপজেলা পর্যায়ের কর্মকর্তাদের সহযোগিতা ও সমন্বয় খুবই দুর্বল। ”

ক্লিনিকগুলো পরিচালনার ক্ষেত্রে স্থানীয় সরকার প্রতিনিধিদের অংশগ্রহণ বা ভূমিকা চোখে পড়ে না।
সরেজমিনে দেখা গেছে, স্থানীয় মানুষের দান করা জমিতে কমিউনিটি ক্লিনিক তৈরি করেছে সরকার। অনেক উপজেলার প্রত্যন্ত গ্রামে ক্লিনিকে যাওয়ার কোনো রাস্তা নেই। ধানের জমিতে, নদী ও খালের পাড়ে, নিচু জমিতে ক্লিনিক হয়েছে।
অভিযোগ রয়েছে, মন্ত্রণালয়ের নীতিমালা লঙ্ঘন করে নিচু জমিতে ও যাতায়াতের অযোগ্য জায়গায় বহু ক্লিনিক তৈরি হয়েছে। এ কারণে এগুলো সহজেই ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে।

কমিউনিটি ক্লিনিকগুলো কার্যকর করার জন্য মাঠপর্যায়ে স্বাস্থ্য সহকারী ও পরিবার পরিকল্পনা সহকারীর কাজের সমন্বয়ের কথা বলা হলেও বাংলানিউজের অনুসন্ধানে তা দেখা যায়নি।

জানা গেছে, বর্তমানে কমিউনিটি ক্লিনিকে ৩১ ধরনের ওষুধ পাঠাচ্ছে স্বাস্থ্য অধিদপ্তর। এর মধ্যে এন্টিবায়োটিকও আছে। স্বাস্থ্য সহকারীরা এসব ওষুধ রোগীদের দিচ্ছেন। উদ্যোগটি বাংলাদেশ মেডিকেল অ্যান্ড ডেন্টাল কাউন্সিল (বিএমডিসি) অ্যাক্টের পরিপন্থী।

আইনে বলা আছে, বিএমডিসিতে নিবন্ধিত নন এমন কেউ অ্যালোপ্যাথি চিকিৎসা করতে পারবেন না। করলে তিন বছর কারা- বা এক লাখ টাকা জরিমানা হবে অথবা উভয় দ-ে দ-িত হবেন।

অভিজ্ঞ চিকিৎসকরা বাংলানিউজকে বলছেন, “এখানে সমস্যা দুই ধরনের। প্রথমত, সরকার নিজে আইন ভাঙছে। অন্যদিকে এন্টিবায়োটিকের যথেচ্ছ ব্যবহারের আশঙ্কা তৈরি হচ্ছে। ”

সরেজমিনে আরও দেখা যায়,অধিকাংশ কমিউনিটি ক্লিনিকের দরজা জানালা ভাঙা, কোনো কোনটির আবার কিছুই নেই, নলকুপ থাকলেও অধিকাংশ’রই মাথা নেই, টয়লেটগুলো ব্যবহারের অযোগ্য। ক্লিনিক গুলোর চারপাশে ঝাড়-জঙ্গলে ভরে উঠেছে। পর্যাপ্ত পরিমাণে ঔষধ সাপ্লাই না থাকার কারণে সুবিধা ভোগীদের আনাগোনাও কমে গেছে।

রূপসা উপজেলার বাগমারা মাজেদা কমিউনিটি ক্লিনিকের প্রভাইডার মো. ওয়াজকরুনী বাবু বাংলানিউজকে জানান, কমিউনিটি ক্লিনিক সপ্তাহের ছয় দিন সকাল ৯টা থেকে দুপুর ৩টা পর্যন্ত খোলা থাকে।

নৈহাটী ইউনিয়নের ৯টি কমিউনিটি ক্লিনিকের দ্বায়িত্বে থাকা সহ-স্বাস্থ্য পরিদর্শক ডা. সিরাজুল ইসলাম বুলু বাংলানিউজকে বলেন, “জনবহুল এ ইউনিয়েনে আরও একটি ক্লিনিক করার প্রস্তাব রয়েছে। কিন্তু জায়গার অভাবে দীর্ঘদিনেও তা বাস্তবায়ন হচ্ছেনা। ফলে টিকাসহ অন্য স্বাস্থ্য সেবা থেকে এলাকার অনেকে বঞ্চিত হচ্ছেন। ”
সিভিল সার্জন সূত্র বাংলানিউজকে জানায়, প্রতিটি কমিউনিটি ক্লিনিকে একজন প্রভাইডার একজন স্বাস্থ্য সহকারী, একজন পরিবার পরিকল্পনাকর্মীর পদ রয়েছে। কিন্তু বেশ কিছু কমিউনিটি ক্লিনিকে জনবল সংকট রয়েছে।

বেসরকারি উন্নয়নমূলক সংস্থা মানবসেবার নির্বাহী পরিচালক মো. মিজানুর রহমান বাংলানিউজকে বলেন, “প্রতিটি কমিউনিটি ক্লিনিকের জন্য পর্যাপ্ত ওষুধ ও চিকিৎসা যন্ত্রপাতি বরাদ্দ থাকে। কিন্তু দক্ষ চিকিৎসকের অভাবে এসব ওষুধ ও যন্ত্রপাতির সঠিক ব্যবহার হচ্ছে না।

এ কারণে জনগণ কাক্সিক্ষত সেবাটুকু পাচ্ছে না। কমিউনিটি ক্লিনিকগুলোতে একজন করে দক্ষ চিকিৎসক নিয়োগ দেওয়া প্রয়োজন।

এ ব্যাপারে সরকারের দৃষ্টি আকর্ষণ করেন তিনি।

খুলনা সিভিল সার্জনের কার্যালয় সূত্রে জানা যায়, ১৯৯৮ সালে তৎকালীন সরকার তৃণমূল পর্যায়ে স্বাস্থ্য সেবা নিশ্চিত করতে প্রতিটি ওয়ার্ডে কমিউনিটি ক্লিনিক চালুর উদ্যোগ নেয়। তখন খুলনার ৬৮টি ইউনিয়নের জন্য ২১০টি কমিউনিটি ক্লিনিক নির্মাণের প্রস্তাব পাঠানো হয়। কিন্তু এ পর্যন্ত নির্মাণ করা হয়েছে ১৭০টি ক্লিনিক।

এর মধ্যে কয়রা উপজেলা একটি ক্লিনিক নদীগর্ভে বিলীন হয়ে যাওয়ায় বর্তমানে ১৬৯টি ক্লিনিকে চিকিৎসা সেবা দেওয়া হচ্ছে। এছাড়া ৪০টি প্রস্তাবিত রয়েছে।

আরও জানা যায়, স্থান নির্বাচন এবং জমি রেজিস্ট্রেশন করা রয়েছে প্রায় ২১টি ক্লিনিকের। এসব স্থানে এখন ভবন নির্মাণ করলেই হাসপাতাল চালু করা যাবে। কিন্তু এসব স্থানে ক্লিনিক নির্মাণের জন্য একাধিকবার চিঠি দেওয়া হলেও সাড়া মিলছে না।

খুলনার সিভির সার্জন ডা. গোলাম মোর্ত্তুজা শিকদার বাংলানিউজকে বলেন, “কমিউনিটি ক্লিনিকের মাধ্যমে গ্রাম পর্যায়ে স্বাস্থ্য সেবা পৌঁছে দেওয়ার চেষ্টা চলছে। কিন্তু প্রায় ৪০টি স্থানে কমিউনিটি ক্লিনিক নেই। ”

না থাকার কারণ হিসাবে তিনি বলেন, “জমি নির্বাচনে সমস্যা, জমি নির্বাচনের পর তা রেজিস্ট্রেশন না হওয়া এবং ভবন নির্মাণে দীর্ঘ সূত্রতার কারণে এ অবস্থায় সৃষ্টি হয়েছে। এতে কাঙ্খিত সেবা থেকে বঞ্চিত হচ্ছে গ্রামের মানুষ। ”
এজন্য দ্রুত এসব স্থানে ক্লিনিক নির্মাণের দাবি জানান তিনি।

পাঠক আগামীকাল সোমবার থাকছে যশোর ২৫০ শর্যা হাসপাতালের বিভিন্ন অনিয়ম ও দুর্নীতি নিয়ে সচিত্র প্রতিবেদন।

বাংলাদেশ সময়: ০৬০০ ঘণ্টা, সেপ্টেম্বর ৩০, ২০১২
সম্পাদনা: মাহাবুর আলম সোহাগ,নিউজরুম এডিটর

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।