ঢাকা, মঙ্গলবার, ৯ পৌষ ১৪৩১, ২৪ ডিসেম্বর ২০২৪, ২১ জমাদিউস সানি ১৪৪৬

স্বাস্থ্য

অ্যানিমিয়া ও প্রয়োজনীয় কিছু তথ্য

মো. আবু জাফর সাদেক | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ১০৪৪ ঘণ্টা, আগস্ট ২৬, ২০১৩
অ্যানিমিয়া ও প্রয়োজনীয় কিছু তথ্য

ঢাকা: বাংলাদেশে ৫ বছরের কমবয়সী শিশুদের শতকরা প্রায় ৫৫ ভাগ রক্তাল্পতা বা অ্যানিমিয়ায় আক্রান্ত। রক্তাল্পতা অতি সহজে নিরাময়যোগ্য অপুষ্টিজনিত একটি রোগ।



শিশুদের  মূলত বৃদ্ধির সময়ে অপুষ্টি বা রক্তাল্পতা অতি ঝুঁকিপূর্ণ। শৈশবজীবনে রক্তাল্পতা স্বাভাবিক দৈহিক ও মানসিক বৃদ্ধিতে মারাত্মক বি‍রূপ প্রতিক্রিয়া ফেলে। বিশ্বস্বাস্থ্য সংস্থা ও ইউনিসেফ প্রদত্ত সাম্প্রতিক তথ্যে দেখা যায় বিশ্বে প্রায় ৭৫ কোটি শিশু রক্তাল্পতায় আক্রান্ত।

আফ্রিকা ও দক্ষিণ এশিয়ার উন্নয়নশীল দেশগুলোর শিশু-কিশোর ও কিশোরীদের মধ্যে রক্তাল্পতার সমস্যা সবচেয়ে বেশি। এবং তা মোট সংখ্যার শতকরা ৮০ ভাগকেও ছাড়িয়ে যাবে।   Nutritional Surveillance Project কর্তৃক প্রকাশিত এক তথ্যমতে বাংলাদেশের ২-৬ বছর বয়সী স্কুল পূর্ববর্তী শিশুদের অর্ধেক এবং স্কুলে যায় এমন শিশুদের এক তৃতীয়াংশের মধ্যে রক্তাল্পতাজনিত সমস্যা বিদ্যমান। এই সংস্থার প্রকাশিত অন্য এক তথ্যে দেখা যায় বাংলাদেশের গ্রামাঞ্চলের প্রায় ২ কোটি ৩০ লাখ শিশু রক্তাল্পতায় ভুগছে। রক্তাল্পতার ইংরেজি শব্দ Anaimia থেকে যার উৎপত্তি প্রাচীন গ্রিক শব্দ অ্যানাইমিয়া থেকে (অহধরসরধ), এর অর্থ রক্তের ঘাটতি।

রক্তাল্পতা বলতে বোঝায় রক্তে স্বাভাবিকের চাইতে কম পরিমাণ লোহিত কণিতা (জইঈ) বা হিমোগ্লোবিন থাকা।

হিমোগ্লোবিনের অক্সিজেন আকর্ষণের ক্ষমতা কমে গেলেও তাকে রক্তাল্পতা বা Anaimia বলা যায়। প্রসঙ্গত উল্লেখ্য, হিমোগ্লোবিন থাকে লোহিত রক্তকণিকার (RBC) মধ্যে এবং তা ফুসফুস থেকে অক্সিজেন বহন করে টিস্যু/কলায় পৌঁছায়। হিমোগ্লোবিনের গঠনের জন্য লৌহ অপরিহার্য। যেহেতু দেহের প্রতিটি কোষ বাঁচার জন্য অক্সিজেনের উপর নির্ভরশীল, তাই রক্তাল্পতায় কোষে কম পরিমাণ অক্সিজেন পৌঁছানোয় নানান ধরনের সমস্যার সৃষ্টি হয়। ক্ষুধামন্দা, শরীর ক্লান্ত বোধ করা, ফ্যাকাসে হয়ে যাওয়া, শ্বাস-প্রশ্বাসে সমস্যা, সর্বদা অস্বস্তি বোধ করা, অস্বাভাবিক হৃদকম্পন, নখের আশে-পাশের জায়গার বর্ণ পরিবর্তন প্রভৃতি রক্তাল্পতার প্রধান লক্ষণ।

রক্তাল্পতার কিছু অপ্রধান লক্ষণ হলো হাত/পা ফুলে যাওয়া, বুক জ্বালা করা, বমিবমি ভাব/বমি হওয়া, বেশি বেশি ঘাম ঝড়া, মলের সাথে রক্ত যাওয়া প্রভৃতি। রক্তাল্পতার নানা শ্রেণি বিভাজন থাকলেও বাংলাদেশর শিশুদের ক্ষেত্রে লৌহের অভাবজনিত (Iron deficienc) প্রকোপই সবচেয়ে বেশি এবং তা মারাত্মকও বটে। রক্তাল্পতার কারণ অনুসন্ধান করলে যে জিনিসগুলি প্রথমেই উঠে আসে তাহলো খাবারে পরিমাণ মত লৌহ, ফলিক এসিড, ভিটামিন বি-১২ এর অভাব, বেশি বেশি চা/কফি পান করা, খাবারের লৌহ শরীরে ঠিকমত শোষিত না হওয়া, কৃমির সংক্রমণ প্রভৃতি। গরুর দুধ বাচ্চাদের জন্য উপকারী হলেও তাতে লৌহের পরিমাণ খুবই কম এবং তা লৌহ শোষণ কমিয়ে দেয়। শৈশব বা কৈশোরে কোন শিশুর রক্তাল্পতা দেখা দিলেও তার স্বভাবিক দৈহিক বৃদ্ধি, বুদ্ধিমত্তার বিকাশ, রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা, হাড় গঠন, স্বাভাবিক আচার-আচরণ প্রভৃতি বাধাগ্রস্ত হয়। রক্তাল্পতার কারণে কখনও কখনও আবার অনিয়মিত হৃদকম্পন, বুকে ব্যথা, হৃৎপিন্ডের অস্বভাবিক বৃদ্ধি, হৃদক্রিয়া বন্ধ হওয়া প্রভৃতিও হতে পারে। কম ওজন নিয়ে জন্মগ্রহণ করা শিশু এবং বাড়ন্ত সময়ের শিশুদের লৌহের প্রয়োজনীয়তা সবচেয়ে বেশি কারণ এ সময় শরীরে লৌহের স্বল্পতাজনিত রক্তাল্পতার ঝুঁকি থাকে। সাম্প্রতিক এক তথ্যে দেখা যায় সে সব শিশুর রক্তাল্পতার সমস্যা আছে তাদের শ্রেণী কক্ষে মনোনিবেশ ও শিক্ষা গ্রহণ ক্ষমতা যাদের রক্তাল্পতা নেই তাদের চেয়ে অনেক কম।

বয়স অনুপাতে মানবদেহে ভিন্ন ভিন্ন পরিমাণে লৌহের প্রয়োজন হয়। ১-৮ বছর বয়সী শিশুদের দৈনিক ৭-১০ মি.গ্রা, ৯-১৮ বছর বয়সী (বালক) ৮-১১ মি.গ্রা, ৯-১৮ বছর বয়সী (বালিকা) ৮-১৫ মি.গ্রা, পূর্ণ বয়স্ক পুরুষ ৮ মি.গ্রা এবং পূর্ণ বয়স্ক পুরুষ ৮ মি.গ্রা এবং পূর্ণ বয়স্ক স্ত্রীলোকের ১৮ মি.গ্রা লৌহের প্রয়োজন। বিশেষ ক্ষেত্রে দৈনিক সর্বোচ্চ ৪৫ মি.গ্রা পর্যন্ত লৌহ সেবন করা যেতে পারে। আমরা যে সমস্ত খাবার থেকে উল্লেখযোগ্য পরিমাণ লৌহ পাই সেগুলো হলো বৃক্ক, যকৃত, মাংস, কার্প জাতীয় মাছ, সামুদ্রিক মাছ, শুকনা ফল, কমলা লেবু, স্ট্রবেরি, টমেটো, ব্রোক্কলি, বিভিন্ন শস্য (গম, যব, ভূট্টা প্রভৃতি), শিম, কাঁচকলা এবং ডিম।

পরিমাণ হিসাবে বিবেচনা করলে ১০ গ্রাম মুরগীর মাংস/যকৃত থেকে ৮.৮ মি.গ্রা, ১৫ গ্রাম গো-মাংস থেকে  ৫.৫ মি.গ্রা, ১টি বড় মাপের ডিম থেকে ০.৭ মি.গ্রা লৌহ পাওয়া যায়। তবে এও মনে রাখা জরুরি যে, আমরা খাবারে যে পরিমাণ লৌহ খাই তার মাত্র ১৫% দেহে শোষিত হয়।

শিশু জন্মের ৬ মাস পর্যন্ত মায়ের বুকের দুধ লৌহসহ যাবতীয় খনিজের যোগানদাতা হিসাবে যথেষ্ট। তারপর শরীরে লৌহের চাহিদা বাড়াতে অন্য উৎস থেকে লৌহ সরবরাহের প্রয়োজনীয়তা দেখা যায়। সময়মত খাবার না খাওয়া, অল্প পরিমাণ খাবার খাওয়া, বিভিন্ন রকমের পর্যাপ্ত খাবার না পাওয়া/খাওয়া, খাবারের প্রতি অরুচি প্রভৃতি উল্লেখযোগ্য কারণে শিশুদের লৌহের অভাব একটি সমন্বিত পুষ্টি পরিপূরক (Nutritional Supplement) বিশাল ভূমিকা রাখতে পারে। একটি সমন্বিত পুষ্টি পরিপূরকে প্রয়োজনমত নানা ধরনের ভিটামিন ও মিনারেল থাকে যা শিশুর সকল ভিটামিন ও মিনারেলের অভাব পূরণ করে। আর রক্তাল্পতার চিকিৎসায় মুখে খাওয়ার লৌহ পরিপূরক ব্যবহার সারা বিশ্বে স্বীকৃত ও সমাদৃত।    

বাংলাদেশ থেকে রক্তাল্পতার সমস্যা দূর করার মহৎ লক্ষ্যে দেশের অন্যতম ওষুধ প্রস্তুতকারী প্রতিষ্ঠান রেনাটা লিমিটেড পুষ্টিকণা নামে একটি সমন্বিত ভিটামিন ও মিনারেল পরিপূরক উৎপাদন ও বাজারজাত করছে। এতে আছে লৌহ ১০ মি.গ্রা, ফলিক এসিড ০.১৫০ মি.গ্রা, ভিটামিন-এ ০.০৪ মি.গ্রা, ভিটামিন-বি১২ ০.০০০৯ মি.গ্রা, ভিটামিন-সি ৩০.০ মি.গ্রা, ভিটামিন ডি ০.০০৫ মি.গ্রা, ভিটামিন-ই ৫.০ মি.গ্রা, ভিটামিন-বি১ ০.৫০ মি.গ্রাম কপার ০.৫৬ মি.গ্রা ভিটামিন-বি২০.৫০ মি.গ্রা, সেলেনিয়াম ০.০১৭ মি.গ্রা, নিয়াসিন ৬.০০ মি.গ্রা আয়োডিন ০.০৯ মি.গ্রা, পাইরিডক্সিন ০.৫০ মি.গ্রা।

ভিটামিন-এ দৃষ্টি শক্তি ভালো রাখে, কোষ বৃদ্ধিতে সহায়তা করে তৎসঙ্গে ত্বক, চুল এবং কলার স্বভাবিকতা নিশ্চিত করে। ভিটামিন-সি কোলাজেন তৈরিতে সাহায্য করে। কোলাজেন সুস্থ দাঁত, মাড়ি, রক্তনালী প্রভৃতি গঠনে ভূমিকা রাখে। ভিটামিন-ই বিপাক ক্রিয়া, খাদ্যহজম এবং সুস্থ স্নায়ুতন্ত্র গঠনে কার্যকরভাবে অংশগ্রহণ করে।

ভিটামিন-ডি শরীরের ক্যালসিয়ামের শোষণ বাড়ায়। ক্যালসিয়াম হাড় ও দাঁতের গঠনে সহায়তা করে।

ভিটামিন-বি২ খাদ্যের বিপাক ক্রিয়ায়, কলা গঠনে এবং দৃষ্টি শক্তি স্বাভাবিক রাখতে কাজ করে। লৌহ হিমোগ্লোবিন উৎপাদন বৃদ্ধি করে। হিমোগ্লোবিনের সংশ্লেষণ ও লৌহের বিপাক ক্রিয়ার জন্য কপার প্রয়োজন।

ভিটামিন-বি২ কোষ বৃদ্ধিতে সাহায্য করে। ভিটামিন-বি১২ শরীরে আমিষের যোগান দেয়, লৌহিত কণিকার পরিমাণ বাড়ায় এবং সুস্থ সবল স্নায়ুতন্ত্র গঠনে সাহায্য করে। সেলেনিয়াম এন্টিবডির উৎপাদন বাড়িয়ে দিয়ে রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বাড়ায়। খাদ্যবস্তু হজমে এবং লোহিত কণিকা উৎপাদনে কাজ করে ফলিক এসিড। কোষ বৃদ্ধি, কোষের পুনর্গঠন, রোগপ্রতিরোধ ক্ষমতা বৃদ্ধি প্রভৃতিতে জিংকের ভূমিকা অনস্বীকার্য। আয়োডিন শক্তি উৎপাদন, শারীরিক ওজন ও মানসিক বৃদ্ধি নিয়ন্ত্রণ করে। স্বাস্থ্য সম্মত ত্বক, চুল, নখ ও দাঁত গঠনেও আয়োডিনের ভূমিকা আছে। ভিটামিন-বি১ শক্তির বিপাক ক্রিয়া বাড়ানোসহ স্নায়ুতন্ত্রের গঠন স্বভাবিক রাখতে কাজ করে। এখানে উল্লেখ করা প্রয়োজন যে, পুষ্টিকণার উৎপাদন ফর্মুলা বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা, ইউনিসেফ এবং ডব্লিএফপি কর্তৃক অনুমোদিত এবং এটি বিশ্বের বহুদেশে ভিন্ন ভিন্ন ব্রান্ড নামে বহুল প্রচলিত। বাংলাদেশের পার্বত্য অঞ্চলের শিশুদের অপুষ্টি ও রক্তাল্পতাজনিত সমস্যা নিরাময়ে বেশ আগে থেকেই এই ভিটামিন ও মিনারেল পরিপূরকটি ব্যবহৃত হয়ে আসছে।

আফ্রিকার দেশ ঘানায় ৬-১৮ বছর বয়সী ৫৫৭ জন শিশুর উপর পুষ্টিকণা ব্যবহার করে একটি গবেষণা করা হয়।

ঐ শিশুদের সবাই রক্তাল্পতার সমস্যায় আক্রান্ত ছিল এবং তাদের হিমোগ্লোবিনের মাত্রা ছিল ৭০-৯০ গ্রাম/লিটার। ৫৫৭ জন শিশুকে দু’টি ভাগে ভাগ করে এক ভাগকে পুষ্টিকণাসহ এসকরবিক এসিড এবং অন্য ভাগকে (Ferrus Sulphate drop) দেয়া হয়েছিলো। ২ মাস পরে পুষ্টিকণা সেবনকারীদের রক্তাল্পতা হ্রাসের হার ছিল শতকরা ৫৮ ভাগ এবং  FeSO4 drop গ্রুপে এ এই হার ছিল শতকরা ৫৬ ভাগ অর্থাৎ রক্তস্বল্পতার সমস্যায় পুষ্টিকণা আয়রন সিরাপের চাইতেও ভালো। আফগানিস্তানে ও পাকিস্তানে পরিচালিত আরও দুটি গবেষণার ফলাফলে দেখা যায় পুষ্টিকণা শতকরা ৫১ ভাগ শিশুর লৌহের অভাবজনিত রক্তাল্পতা দূর করতে সমর্থ হয়েছিলো। অর্থাৎ রক্তস্বল্পতায় পুষ্টিকণা একটি আদর্শ পরিপূরক।
 
বাংলাদেশ সময়: ১০৪০ ঘণ্টা, আগস্ট ২৬, ২০১৩
আরআই / এসআরএস

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।