ঢাকা, বৃহস্পতিবার, ১১ পৌষ ১৪৩১, ২৬ ডিসেম্বর ২০২৪, ২৩ জমাদিউস সানি ১৪৪৬

স্বাস্থ্য

মেনিনজাইটিস এক ভয়ঙ্কর রোগ

মো. আবু জাফর সাদেক | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ২২০০ ঘণ্টা, জানুয়ারি ১৯, ২০১৪
মেনিনজাইটিস এক ভয়ঙ্কর রোগ

ঢাকা: ১০ বছরের রিয়া জামালপুর শহরের নামকরা একটি বিদ্যালয়ের ৫ম শ্রেণির ছাত্রী। তার বাবা দেশের একটি প্রথম সারির ওষুধ কোম্পানির জেলা বিক্রয় ব্যবস্থাপক।



একদিন রিয়ার কানে, গলায় ও নাকে প্রচণ্ড ব্যথা শুরু হয়। তবে প্রচলিত ব্যথানাশক ওষুধ সেবনে তা সঙ্গে সঙ্গে ভালোও হয়ে গেল।

কিন্তু পরের দিন আবারও দেখা গেল সেই ব্যথা, সঙ্গে শরীরের ভারসাম্য রক্ষা করতে না পারার সমস্যা।

রিয়ার বাবা মা তাকে স্থানীয় নাক, কান ও গলা বিশেষজ্ঞের কাছে নিয়ে গেলেন। কিছু পরীক্ষা নিরীক্ষার পর চিকিৎসক জানালেন রিয়ার মেনিনজাইটিসে আক্রান্ত হওয়ার মত উপসর্গ আছে, তাই দেরি না করে দ্রুত তাকে যেন ময়মনসিংহ মেডিকেল কলেজ-হাসপাতালে ভর্তি করানো হয়।

সঙ্গে সঙ্গেই রিয়াকে ময়মনসিংহ মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে ভর্তি করা হলেও রাত পেরোবার আগেই খবর এলো রিয়া চলে গেছে না ফেরার দেশে।

প্রিয় পাঠক, রিয়ার মত বিশ্বে প্রতি মিনিটে ১ জন মানুষ মেনিনজাইটিসে আক্রান্ত হয়, আর প্রতি ২৪ ঘণ্টায় মারা যায় ১৩৭ জন।

মেনিনজাইটিসের হাত থেকে বেঁচে যাওয়া প্রতি ৫ জন রোগীর অন্তত ১ জনের চিরস্থায়ী অঙ্গহানি,মস্তিষ্কের সমস্যা, বধিরতা বা দৃষ্টি শক্তি হারানোর মত করুণ পরিণতি ভোগ করতে হয়।

এবার চলুন দেখি জানা যাক, মেনিনজাইটিস কি ধরনের রোগ।

মেনিনজাইটিস হলো মস্তিষ্ক ও স্পাইনাল কর্ডকে আচ্ছাদনকারী পর্দা মেনিনজেসের তীব্র প্রদাহ। মূলত জীবানুর সংক্রমণের কারণেই এ প্রদাহের সৃষ্টি।

এই প্রদাহ মস্তিষ্কের খুব কাছাকাছি হওয়ায় মেনিনজাইটিসের ক্ষেত্রে মৃত্যুঝুঁকি অনেক বেশি। আর বিনা চিকিৎসায় মেনিনজাইটিসে মৃত্যুর হার শতকরা ৭০ ভাগেরও বেশি।

মেনিনজাইটিসের লক্ষণ: অনেক ক্ষেত্রে লক্ষণ প্রকাশের ১২ ঘন্টার মধ্যেই মেনিনজাইটিসে আক্রান্ত রোগী মারা যায়। তবে সব ক্ষেত্রে এ রকম হয় এমনটি বলা যাবে না। মেনিনজাইটিসের প্রধান লক্ষণগুলো হলো, তীব্র মাথা ব্যথা, গলার মাংস শক্ত হয়ে যাওয়া, স্মৃতি বিভ্রম, বমি, বমি বমি ভাব, আলোর দিকে তাকাতে না পারা, অস্বস্তি, শরীরে বিশেষ দাগ, মূর্ছা যাওয়া, প্রচণ্ড ঘুম পাওয়া, শরীরে ভারসাম্য হারানো প্রভৃতি। তবে বয়সভেদে এই উপসর্গগুলোর কিছুটা ভিন্নতা দেখা যেতে পারে।

কারণ ও প্রকারভেদ: অধিকাংশ ক্ষেত্রে মেনিনজাইটিসের কারণ হল বিভিন্ন প্রকারের ভাইরাস, ব্যাকটেরিয়া, ফাংগাস, প্রোটোজোয়া প্রভৃতি।

তবে বিভিন্ন ধরনের ওষুধের প্রতিক্রিয়ায় বা ক্যান্সারের কারণেও মেনিনজাইটিস হতে পারে।

ক) ব্যাকটেরিয়াল মেনিনজাইটিস: বয়সভেদে ভিন্ন ভিন্ন ব্যাকটেরিয়া ভিন্ন ভিন্ন ব্যাকটেরিয়াল মেনিনজাইটিসের জন্য দায়ী। সদ্যজাত থেকে শুরু করে ৩ মাস বয়সী শিশুর ক্ষেত্রে প্রধানত গ্রুপ-বি স্ট্রেপটেকক্কি ও লিস্টেরিয়া।

সাধারণত মনোসাইটোজিনেসিস দ্বারা মেনিনজাইটিস হয়ে থাকে। পরিণত শিশুদের মেনিনজাইটিসের জন্য দায়ী নাইসেরিয়া মেনিনজাইটিডিস, স্ট্রেপটোকক্কাস নিউমোনিয়া এবং হেমোফিলাস ইনফ্লুয়েঞ্জা টাইপ-বি।

বড়দের শতকরা ৮০ ভাগ ব্যাকটেরিয়াল মেনিনজাইটিসের কারণ নাইসেরিয়া মেনিনজাইটিডিস ও স্ট্রেপটোকক্কাস নিউমোনিয়া।

পঞ্চাশোর্ধ ব্যক্তির ক্ষেত্রে লিস্টেরিয়া মনোসাইটোজিনেসিস জনিত মেনিনজাইটিসের হার অনেক বেশি।

খ) ভাইরাল মেনিনজাইটিস: ভাইরাস জনিত মেনিনজাইটিস ব্যাকটেরিয়া জনিত মেনিনজাইটিসের চাইতে কম ভয়ংকর। ভাইরাল মেনিনজাইটিসের প্রধান জীবানু এন্টেরোভাইরাস। এর বাইরেও কিছু ভাইরাস এই রোগের সৃষ্টি করে যা মশার মাধ্যমে একজনের কাছ থেকে অন্য জনে ছড়াতে পারে।

ঘ)ফাংগাল মেনিনজাইটিস: ফাংগাল মেনিনজাইটিসের প্রধান জীবানু ক্রিপটোকক্কাস নিউফরমান্স। রোগ প্রতিরোধকারী ক্ষমতা হ্রাসের ওষুধ সেবনকারী, এইডস/এইচআইভি আক্রান্ত রোগী ও বয়স্ক মানুষ ফাংগাল মেনিনজাইটিসের জন্য অত্যন্ত ঝুঁকিপূর্ণ।

ফাংগাল মেনিনজাইটিসের প্রকোপ আফ্রিকা মহাদেশে সবচাইতে বেশি এবং তা ২০-২৫% এইডস আক্রান্ত রোগীর মৃত্যুর কারণ। অন্য যেসব ফাংগাস মেনিনজাইটিস ঘটায় সেগুলো হলো হিস্টোপ্লাজমা ক্যাপসুলাটাম, কক্কিডায়োআইডেস ইমিটিস, ব্লাস্টোমাইসেস ডার্মাটাইটিস, ক্যানডিডা স্পেসিস প্রভৃতি।

ঘ) প্যারাসাইটিক মেনিনজাইটিস: এই ধরনের মেনিনজাইটিসের প্রধান প্রধান জীবানু হলো এ্যাংজিও স্ট্রংগিলাস, ক্যান্টোনেনসিস, গ্যান্থোসটোমা স্পিনিজেরাম, সিস্টোসোমা প্রভৃতি।

প্যারাসাইটিক মেনিনজাইটিসে সেরেব্রো স্পাইনাল ফ্লুইডে ইসোনোফিল (এক ধরনের শ্বেত কনিকা) পাওয়া যায়।
ঙ) জীবানুবিহীন মেনিনজাইটিস: জীবানুর বাইরেও কিছু কারণে মেনিনজাইটিস হতে পারে যার মধ্যে ক্যান্সারের বিস্তৃতি, কিছু বিশেষ ওষুধ সেবন (ব্যথা ও প্রদাহ বিরোধী ওষুধ, ইমিউনোগ্লোবিন, জীবানু বিরোধী ওষুধ), সারকোডিয়াসিস, কানেকটিভ টিস্যু ডিজঅর্ডার, সিস্টেমিক লুপাস ইরাথেমেটাসাস বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য। কোন কোন ক্ষেত্রে মাইগ্রেন থেকেও মেনিনজাইটিস হতে পারে যদিও এ হার অনেক কম।

কিভাবে হয়: তিন স্তর (ডুরামাটের, আর্কনয়েডমাটের ও পিয়ামাটের) বিশিষ্ট মেনিনজেস এবং সেরেব্রোস্পাইনি‍য়াল ফ্লুইড মস্তিষ্ক ও স্পাইনাল কর্ডকে আবরণ প্রদান করে প্রতিরক্ষা দেয়। ব্যাকটেরিয়াল মেনিনজাইটিসের ক্ষেত্রে রক্ত প্রবাহ বা নাসা রন্ধ্রের মাধ্যমে ব্যাকটেরিয়া মেনিনজেসের সংস্পর্শে আসে এবং পরবর্তীতে প্রদাহ সৃষ্টি করে। নবজাতকের রক্তের গ্রুপ-বি স্ট্রেপটোকক্কিতে আক্রান্ত হলে শতকরা ২৫ ভাগ ক্ষেত্রে মেনিনজাইটিস হওয়ার সম্ভাবনা থাকে।

উল্লেখ্য, রক্ত প্রবাহে ব্যাকটেরিয়া প্রবশ করলে তা সাবএরাকনয়িড স্পেসে চলে যায় আর এই স্পেসটি হলো ব্লাড ব্রেইন বেরিয়ারের সবচেয়ে সংবেদনশীল এবং ঝুঁকিপূর্ন স্পেস।

মেনিনজাইটিসে যে মারাত্মক প্রদাহ হয় তার কারণ ব্যাকটেরিয়ার সরাসরি আক্রমণ নয় বরং ব্যাকটেরিয়ার কেন্দ্রীয় স্নায়ুতন্ত্রে অনুপ্রবেশের ফলে শরীরের রোগ প্রতিরোধকারী সিস্টেমের প্রতিরোধের চেষ্টা। মস্তিষ্কে ব্যাকটেরিয়ার কোষের উপস্থিতি নিশ্চিত হলে শরীরের রোগ প্রতিরোধকারী সিস্টেম বেশি পরিমাণ সাইটোকাইন ও হরমোন জাতীয় পদার্থ নিঃসরণ করে, এতে করে ব্লাড ব্রেইন রেরিয়ার দুর্ভেদ্য থেকে ভেদ্য হয়ে উঠে এবং রক্তনালী থেকে তরল নির্গত হয়ে মস্তিষ্ক ফুলে উঠে। এমতাবস্থায় বেশি বেশি শ্বেত রক্ত কণিকা সেরেব্রো স্পাইনাল ফ্লুইডে প্রবেশ করে এবং প্রদাহ আরও তীব্রতর হয়ে উঠে। একেবারে শেষ পর্যায়ে মস্তিষ্কের কোষগুলো অক্সিজেন প্রাপ্তি হতে বঞ্চিত হয় এবং শেষে মারা যায়।

মেনিনজাইটিস সনাক্তকরণ: কারও মেনিনজাইটিস থাকার ব্যাপারে সন্দেহ হলে ব্লাড কালচার, কমপ্লিট ব্লাড কাউন্ট (সিবিসি), সি-রিয়াকটিভ প্রোটিন টেস্ট প্রভৃতি পরীক্ষার মাধ্যমে নিশ্চিত হওয়া যায়। লাম্বার পাঙ্কচার দ্বারা সেরেব্রোস্পাইনাল ফ্লুইড টেস্ট করার মাধ্যমেও মেনিনজাইটিস সম্পর্কে সুনিশ্চিত হওয়া যায়।

কিভাবে ছড়ায়: সংস্পর্শে মেনিনজাইটিস খুব দ্রুত ছড়িয়ে যায় না, তবে ভাইরাল ও ব্যাকটেরিয়াল মেনিনজাইটিস নাক ও গলার নিঃসরণে সরাসরি সংস্পর্শে একজনের কাছ থেকে অন্যজনের কাছে ছড়াতে পারে।

একজন স্বাভাবিক মানুষ মেনিনজাইটিস রোগের কোন উপসর্গ ছাড়াই এই রোগের জীবাণু বহন করতে পারে যা তা‍র ব্যবহৃত গ্লাস, থালা-বাসন বা সিগারেট ভাগাভাগির মাধ্যমে অন্যজনের নিকট সংক্রমিত হতে পারে।

এছাড়া ভাইরাল মেনিনজাইটিস মলের মাধ্যমেও একজনের থেকে অন্যজনে ছড়াতে পারে।

মেনিনজাইটিসের টিকা: ১৯৮০ সালের গোড়ার দিকে বিশ্বের অনেক দেশ তাদের বাচ্চাদের জন্য নিয়মিত টিকাদান কর্মসূচিতে হেমোফিলাস ইনফ্লুয়েঞ্জা টাইপ-বি’র টিকা অর্ন্তভুক্ত করেছে, কারণ এই জীবাণু ইনফ্লুয়েঞ্জার পাশাপাশি মেনিনজাইটিস সৃষ্টিতে ভূমিকা রাখে।

মাম্পস ভ্যাকসিন (টিকা) মাম্পস ও মাম্পস-মেনিনজাইটিস প্রতিরোধ করে। মেনিনগোকক্কাস ভ্যাকসিন গ্রুপ-এ, সি, ডাব্লিও-১৩৫ এবং ওয়াই মেনিনজাইটিসের বিরুদ্ধে কার্য্যকরী প্রতিরোধ গড়ে তোলে যা সর্বোচ্চ প্রতিরক্ষা নিশ্চিত করে।

এখানে লক্ষ্য করা যেতে পারে যে, যে সব দেশে মেনিনগোকক্কাস গ্রুপ-সি এর ভ্যাকসিন ব্যবহৃত হচ্ছে সেখানে মেনিনজাইটিসের প্রকোপ উল্লেখযোগ্য হারে কমে গিয়েছে।

বাংলাদেশেও মেনিনজাইটিসের বিরুদ্ধে কার্য্যকর ও মানসম্পন্ন ভ্যাকসিন বাজারে প্রচলিত আছে যা সর্বোচ্চ প্রতিরক্ষা দেয়।

মেনিনগোকক্কাস ভ্যাকসিন গ্রুপ-এ, সি, ডাব্লিও-১৩৫ এবং ওয়াই-এর সুবিধা:

১। শরীরে মেনিনজাইটিসের বিরুদ্ধে দীর্ঘস্থায়ী প্রতিরোধ ব্যবস্থা গড়ে তোলে।
২। ২ বছর বয়স থেকে ব্যবহার করা যায়।
৩। বার বার দিতে হয় না।
৪। ভ্যাকসিন গ্রহণকারীর পাশাপাশি নিকটবর্তী প্রিয়জনকে মেনিনজাইটিস থেকে রক্ষা করে।

কারা ঝুঁকিপূর্ণ: শিশু-কিশোর, আন্তর্জাতিক ভ্রমণকারী, ছাত্র/ছাত্রী নিবাসে অবস্থানকারী, সদ্য নিয়োগপ্রাপ্ত সৈনিকসহ অনেক শ্রেণি পেশার মানুষই মেনিনজাইটিসের ক্ষেত্রে ঝুঁকিপূর্ণ।

করণীয়: আসুন সবাই মিলে ডাক্তারের পরামর্শে মেনিনজাইটিসের টিকা গ্রহণ করে মেনিনজাইটিস মুক্ত বাংলাদেশ গড়ি।

মো. আবু জাফর সাদেক
ফার্মাসিস্ট
azs_sohel@yahoo.com
 
বাংলাদেশ সময়: ২১৪৬ ঘণ্টা, জানুয়ারি ১৯, ২০১৪
সম্পাদনা: রাইসুল ইসলাম, অ্যাসিস্ট্যান্ট আউটপুট এডিটর (অ্যাক্ট.)

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।