ঢাকা, মঙ্গলবার, ৯ পৌষ ১৪৩১, ২৪ ডিসেম্বর ২০২৪, ২১ জমাদিউস সানি ১৪৪৬

স্বাস্থ্য

ফাইলেরিয়ায় বিকলাঙ্গ হতে বসেছেন উত্তরের মানুষ

মাহাবুর আলম সোহাগ, রোভিং করেসপন্ডেন্ট | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ২০৫৩ ঘণ্টা, মে ১৯, ২০১৪
ফাইলেরিয়ায় বিকলাঙ্গ হতে বসেছেন উত্তরের মানুষ ছবি: বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম

নীলফামারী থেকে: উত্তরাঞ্চলসহ দেশের ৩৪টি জেলায় ছড়িয়ে পড়েছে ভয়াবহ ফাইলেরিয়া রোগ। এর মধ্যে ১৯টি জেলায় এ রোগের পরিস্থিতি ভয়াবহ আকার ধারণ করেছে।



ফাইলেরিয়ায় আক্রান্ত এসব রোগীর বেশিরভাগই বিকলাঙ্গ হতে বসেছেন।

আক্রান্ত জেলাগুলো হলো- পঞ্চগড়, ঠাকুরগাঁও, দিনাজপুর, জয়পুরহাট, নওগাঁ, চাঁপাইনবাবগঞ্জ, নীলফামারী, রংপুর, কুড়িগ্রাম, রাজশাহী, লালমনিরহাট, বগুড়া, পাবনা, ঢাকা, গোপালগঞ্জ, মুন্সীগঞ্জ, নরসিংদী, গাজীপুর, জামালপুর, নারায়ণগঞ্জ, মেহেরপুর, নড়াইল, কুষ্টিয়া, চুয়াডাঙ্গা, ঝিনাইদহ, পিরোজপুর, বরিশাল, ঝালকাঠি, বরগুনা, পটুয়াখালী, হবিগঞ্জ, লক্ষ্মীপুর, নোয়াখালী ও ফেনী। তবে উত্তরাঞ্চলে এ রোগের প্রকোপ বেশি।

এর মধ্যে নীলফামারীর জলঢাকা এবং রংপুরের গঙ্গাচড়া উপজেলায় ফাইলেরিয়ায় আক্রান্ত রোগীর সংখ্যা সবচেয়ে বেশি বলে জানান বিশ্বের একমাত্র ফাইলেরিয়া হাসপাতালের তত্ত্বাবধায়ক সুরত আলী বাবু।

তিনি জানান, আক্রান্ত ৩৪ জেলার মধ্যে নীলফামারী জেলাকে ফাইলেরিয়ার জোন বলা হয়। কারণ, নীলফামারীর প্রতিটি উপজেলায় ফাইলেরিয়ায় আক্রান্ত রোগী রয়েছেন, যা দেশের অন্যান্য জেলা-উপজেলার তুলনায় অনেক বেশি। এ জেলার প্রায় ২৫ শতাংশ মানুষ ফাইলেরিয়ায় আক্রান্ত।

সুরত আলী বাবু জানান, অন্যান্য জেলাগুলোতে ফাইলেরিয়া আক্রান্ত রোগীর পরিমাণ ১৫ থেকে ২০ শতাংশ।

অন্যদিকে, ফাইলেরিয়া আক্রান্ত এসব জেলার মধ্যে ঠাকুরগাঁও ও পঞ্চগড় জেলাকে ২০১০ সালে সরকারিভাবে ফাইলেরিয়ামুক্ত ঘোষণা করা হয়েছিল। কিন্তু বর্তমানেও এই দুই জেলায় প্রায় ১৫ শতাংশ মানুষ নতুন করে ফাইলেরিয়ায় আক্রান্ত হচ্ছেন।

তিনি বলেন, প্রতিদিন পঞ্চগড় এবং ঠাকুরগাঁও জেলার বিভিন্ন গ্রাম থেকে অনেক রোগী চিকিৎসা নিতে আসছেন আমাদের হাসপাতালে।

সরকার যে ২০১০ সালে এ দু’টি জেলাকে ফাইলেরিয়ামুক্ত ঘোষণা করেছিল, তখন হয়তো রোগীর সংখ্যা খুব কম ছিল। বর্তমানে প্রতিদিন এ দুটি জেলায় রোগীর সংখ্যা বাড়ছে বলেও জানান সুরত আলী বাবু।

সরেজমিনে নীলফামারীর সৈয়দপুর উপজেলার ধলাগাছ এলাকায় অবস্থিত বিশ্বের একমাত্র ফাইলেরিয়া হাসপাতালে গিয়ে দেখা মেলে ঠাকুরগাঁও সদর উপজেলার মোহাম্মদপুর ইউনিয়ন থেকে আসা লুৎফা বেগমের। তিনি অবশ্য এবারই প্রথম এসেছেন এ হাসপাতালে।

লুৎফা বেগম বলেন, বেশ কিছুদিন ধরে বাম পা ফুলে যাচ্ছে। এ কারণে এখানে ডাক্তারের কাছে এসেছি।

তিনি আরও জানান, আমাদের গ্রামকে ২০১০ সালে ফাইলেরিয়ামু্ক্ত ঘোষণা করা হয়েছিল। কিন্তু এখন অনেক মানুষ এ রোগে আক্রান্ত। অনেকে অভাবী হওয়ায় হাসপাতালে আসতে পারছেন না।

পঞ্চগড় সদর উপজেলা থেকে এ হাসপাতালে ডাক্তারের কাছে এসেছেন সালেহা খাতুন (৫০)। তিনি অবশ্য অনেকদিন ধরেই এ হাসপাতালে যাওয়া-আসা করছেন। তার সমস্যা ডান পায়ে।

ফাইলেরিয়া কি?
ফাইলেরিয়াসিস একটা মশাবাহিত সংক্রামক ব্যাধি। বাংলাদেশে কিউলেক্স জাতীয় স্ত্রী মশা দ্বারা এ রোগ সংক্রমিত হয়। সংক্রমিত রোগী থেকে এ রোগ আবার কয়েক প্রজাতির স্ত্রী মশার কামড়ের মাধ্যমে সুস্থ মানুষের দেহে ছড়িয়ে পড়ে। এ জীবানু মানুষের দেহে প্রবেশের পর কৃমির মাধ্যমে তা মানুষের রক্তে ছড়িয়ে পড়ে। কারণ, কৃমি মাইক্রো ফাইলেরিয়ার জন্ম দেয় এবং ক্রমাগত লসিকা নালী ক্ষতিগ্রস্থ করতে থাকে। ফলে অধিকাংশ ক্ষেত্রে আক্রান্ত রোগীর হাঁটুর নিচের অংশ, হাত, স্তন, যৌনাঙ্গ মোটা হয়ে ফুলে যেতে থাকে।

কিভাবে এ রোগ প্রকাশ পায়?
ফাইলেরিয়া রোগ মানুষের দেহে ৪ ভাবে প্রকাশ পায়।
১. লক্ষণহীন: জীবানু দেহে প্রবেশের পর কয়েক বছর কোনো লক্ষণ দেখা যায় না। তবে জীবানুটি কিডনি ও ফুসফুসের লসিকা নালীর ক্রমাগত ক্ষতি করতে থাকে।

২. তাৎক্ষণিক: অনেকের তাৎক্ষণিক লক্ষণ দেখা দেয় যেমন চর্মরোগ, গা চুলকানো, লাল হওয়া, চাকা চাকা হওয়া, lymph ফুলে যাওয়া, মাঝে মাঝে জ্বর, কাশি, শ্বাসকষ্ট হওয়া ইত্যাদি।
৩. দীর্ঘসূত্রী: এ ধরণের রোগীরা সবচেয়ে বেশি ভুক্তভোগী। এসব রোগীর রক্ত পরীক্ষায় প্রায়ই এ রোগ ধরা পড়ে না। মশার কামড়ের পর আক্রান্ত অঙ্গ ফুলে যেতে কয়েক বছর সময় লাগে।

৪. দীর্ঘসূত্রতার মধ্যে তাৎক্ষণিক: বিকলাঙ্গ রোগীদের অনেকের পা বা হাতের আঙ্গুলের মাঝখান দিয়ে প্রদাহ হয়। রোগীর প্রচণ্ড জ্বর মাথাব্যথা হয়।

রোগ নির্ণয়ে পরীক্ষা
বিভিন্ন পরীক্ষার মাধ্যমে এ রোগ নির্ণয় করা যায়।
১. এলার্জি পরীক্ষা:
ক. রক্ত পরীক্ষা: রক্তে স্বাভাবিক মাত্রার চেয়ে esonophil অনেক বেশি ধরা পড়ে।
খ. ত্বকীয় পরীক্ষা: পজিটিভ ক্ষেত্রে ত্বকের পরীক্ষিত অংশ ফুলে যায়।
২. ICT(Immuno Chromatographic test): এ পরীক্ষায় মাত্র দুই ফোটা রক্ত ICT/Spot Test কার্ডে দিলে দশ মিনিটের মাথায় রোগ ধরা পরে।
৩. lymphoscintigraphy test: যাদের রক্ত পরীক্ষায় ফাইলেরিয়া ধরা পড়ে না তাদের জন্য এ পরীক্ষা কার্যকরী।
পরীক্ষা শুধুমাত্র ডাক্তারের পরামর্শ মতো করতে হবে।

ফাইলেরিয়ার চিকিৎসা
শরীরে সন্দেহজনক লক্ষণ দেখা দিলে যেমন- নির্দিষ্ট সময়ে জ্বর আসা, শরীর চুলকানো এবং অণ্ডকোষ, স্তন, হাত, পা ইত্যাদি অঙ্গ ফুলে গেলে অবশ্যই ডাক্তারের শরণাপন্ন হতে হবে। প্রয়োজনীয় পরীক্ষা-নিরীক্ষার পর রোগ ধরা পড়লে দ্রুত চিকিৎসা গ্রহণ করতে হবে।

আক্রান্ত ব্যক্তির পরিবারের সদস্যদেরকেও প্রতিষেধক গ্রহণ করতে হবে। অন্যথায় তাদেরও আক্রান্ত হবার ঝুঁকি থেকে যাবে। এছাড়া আক্রান্ত রোগীদের আরও কিছু নিয়ম মেনে চলতে হবে।
১. প্রত্যেকদিন রাতে সাবান দিয়ে আক্রান্ত অঙ্গ পরিষ্কার করতে হবে।
২. দিনে তিনবার চিকিৎসকের পরামর্শ অনুসারে হালকা ব্যায়াম করতে হবে।
৩. রাতে ঘুমানোর সময় পায়ের নিচে বালিশ দিয়ে ঘুমাতে হবে এবং দিনের বেলায় পা যথাসম্ভব উঁচু করে রাখতে হবে।
৪. আক্রান্ত অঙ্গ সব সময় শুকনো রাখতে হবে।
৫. প্রয়োজনে চিকিৎসকের পরামর্শক্রমে আক্রান্ত স্থানে মেডিকেটেড মলম লাগাতে হবে।

ফাইলেরিয়ার প্রতিষেধক
ফাইলেরিয়া ঝুঁকিপূর্ণ এলাকায় যারা বসবাস করেন অথবা যাদের পরিবারের সদস্যদের মধ্যে ফাইলেরিয়া আছে তাদের প্রতিষেধক ওষুধ খাওয়াটা জরুরি।

প্রতিষেধক ডোজ নিম্নরুপ :
২-৮ বছরের রোগীদের ক্ষেত্রে
Banocide 50 mg – ২টি
Alatrol- ১টি
Albendazole- ১টি

৮-১২ বছরের রোগীদের ক্ষেত্রে
Banocide 50 mg – ৪টি
Alatrol- ১টি
Albendazole- ১টি

১২ বছরের ঊর্ধ্বে রোগীদের ক্ষেত্রে
Banocide 50 mg – ৬টি
Alatrol- ১টি
Albendazole- ১টি

পার্শ্ব প্রতিক্রিয়া
এ ওষুধে কোনো পার্শ্ব প্রতিক্রিয়া নেই। তবে কারো কারো সামান্য মাথা ঘুরানো, বমি বমি ভাব ও পাতলা পায়খানা হতে পারে। তবে যার শরীরে ফাইলেরিয়াসিসের জীবানু বেশি শুধু তার ক্ষেত্রেই এ প্রতিক্রিয়া হতে পারে।

যারা এ ওষুধ খাবে না
১. গর্ভবতী মা
২. গুরুতর অসুস্থ ব্যক্তি
৩. ২ বছরের কম বয়সের শিশুরা

সৈয়দপুর ফাইলেরিয়া হাসপাতালের আবাসিক মেডিকেল অফিসার (আরএমও) এএফএম তৈয়ব হোসেন বাংলানিউজকে জানান, সরকারি সহযোগিতা পেলে ফাইলেরিয়া আক্রান্ত রোগীদের দ্রুত সুস্থ করে তোলা সম্ভব।

সরকার এ রোগ নিয়ে আগেও কোনোদিন ভাবেনি, বর্তমানেও ভাবছে না বলেও মন্তব্য করেন তিনি।

তবে তিনি সরকারে প্রতি কৃতজ্ঞতা স্বীকার করে বলেন, সরকারিভাবে একটি ওষুধ ফ্রি দেওয়া হয়। যা ফাইলেরিয়ায় আক্রান্ত রোগীদের জন্য অনেক কার্যকরী একটি ওষুধ।
তিনি জানান, একজন রোগী সঠিকভাবে ওষুধ সেবন করলে তিনি প্রায় ৯০ শতাংশ সুস্থ হয়ে উঠবেন।

তৈয়ব হোসেন বলেন, ফাইলেরিয়ায় আক্রান্ত রোগীদের চিকিৎসা দেওয়ার জন্য ডাক্তার সম্ভবত আমি ছাড়া আর কেউ নেই। যেহেতু বিশ্বের একমাত্র ফাইলেরিয়া হাসপাতালটি সৈয়দপুরে অবস্থিত, সেহেতু বিশ্বে এ রোগের জন্য একমাত্র ডাক্তার সম্ভবত আমিই।

তবে তিনি অনুরোধ করে বলেন, সরকার প্রত্যেক ডাক্তারকে যেন উন্নত চিকিৎসাবিদ্যা প্রশিক্ষণের জন্য থাইল্যান্ড এবং জাপানে পাঠানোর ব্যবস্থা করে। এতে করে আমাদের দেশের চিকিৎসা ব্যবস্থা আরো উন্নত হবে। দেশের মানুষকে চিকিৎসার জন্য আর বাইরে যেতে হবে না। ঘরে বসেই সাধারণ মানুষ ভালো মানের চিকিৎসা পাবেন।

বাংলাদেশ সময়: ২০৫০ ঘণ্টা, মে ১৯, ২০১৪

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।