ঢাকা, সোমবার, ৮ পৌষ ১৪৩১, ২৩ ডিসেম্বর ২০২৪, ২০ জমাদিউস সানি ১৪৪৬

স্বাস্থ্য

ডটস কর্মসূচিতে নিয়ন্ত্রণে যক্ষ্মা

মাজেদুল নয়ন, সিনিয়র করেসপন্ডেন্ট | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ০৪৩৮ ঘণ্টা, মার্চ ৪, ২০১৫
ডটস কর্মসূচিতে নিয়ন্ত্রণে যক্ষ্মা

ঢাকা: যক্ষ্মা রোগ সর্ম্পকে বাড়ছে জনসচেতনতা। এখন আর ভয়াবহ রোগ নয় যক্ষ্মা।

বরং নিয়মিত ওষুধ সেবনে সেরে উঠছে রোগটি। আর রোগীদের চিহ্নিত করা থেকে শুরু করে, সুস্থ করে তোলার গুরুদায়িত্বটি পালন করছে বেসরকারি সংস্থা ব্রাকের ডটস কর্মসূচি।
 
লক্ষ্মীপুরের কমলনগর উপজেলার তোরাবগঞ্জ বহুমুখী উচ্চ বিদ্যালয়ের নৈশপ্রহরী লোকমান হোসেন (৪৫) টানা এক মাসেরও বেশি সময় ধরে কাশি ও জ্বরে ভুগছিলেন। পল্লী চিকিৎসকের দেওয়া ওষুধ খেয়ে ও কবিরাজি করিয়ে সুস্থ হতে   পারেননি। কর্মস্থলে যেতে পারছিলেন না। এ পরিস্থিতিতে হতাশ হয়ে পড়েন লোকমান ও তার স্বজনরা।

তিন সপ্তাহের বেশি কাশি যক্ষ্মার লক্ষ্মণ হতে পারে, টেলিভিশনে এমন সচেতনতামূলক বিজ্ঞাপন নজরে আসে লোকমানের। পরের দিন তিনি ব্রাক স্বাস্থ্য কেন্দ্রে যান। সেখানে সেবিকাদের পরামর্শে কফ পরীক্ষা করান। কফ পরীক্ষায় ধরা পড়ে যক্ষ্মা। এ খবরে পরিবারের সদস্যরা আতঙ্কিত হয়ে পড়েন।
 
আক্রান্ত লোকমানকে ব্র্যাক স্বাস্থ্য সেবিকারা যক্ষ্মা নিরাময়যোগ্য বলে সাহস দেন। বিনামূল্যে ওষুধ সেবন করানো হয় তাকে। ছয়মাস ডটস পদ্ধতিতে (সরাসরি পর্যবেক্ষণের মাধ্যমে) ওষুধ সেবনে লোকমান সেরে ওঠেন। নিয়মিত ওষুধ খেয়ে দ্রুত সুস্থ হওয়ায় ব্র্যাক তাকে ৫শ’ টাকা পুরস্কারও দিয়েছে।
 
একই উপজেলার চর ফলকন ইউনিয়নের জাজিরা গ্রামের বাসিন্দা দিনমজুর শাহাদাত হোসেন (৩০) দীর্ঘ দিন জ্বর ও কাশি রোগে ভুগছেন। দিন দিন বাড়ছে বুকের ব্যথা, দুর্বলতা ও ক্ষুধামন্দা। ব্র্যাক কর্মকর্তা আবদুর রহিমের পরামর্শে কফ পরীক্ষা করলেও যক্ষ্মা ধরা পড়েনি।
 
ব্র্যাক তাকে এক্স-রে করার জন্য আর্থিক সহায়তা দেয়। এক্সরেতে তার যক্ষ্মা ধরা পড়ে। প্রতিদিন সকাল বেলা ব্র্যাক স্বাস্থ্য সেবিকা তার বাড়ি গিয়ে নিজ হাতে ওষুধ খাওয়ান। ছয়মাসের ওষুধ সেবনে শাহাদাতও সম্পূর্ণ সুস্থ হয়ে উঠেন।
 
এভাবেই ব্র্যাকের দেওয়া বিনামূল্যে ওষুধ, সেবা ও পরামর্শে লক্ষ্মীপুরে ৯৮ শতাংশ যক্ষ্মা রোগী সুস্থ হয়ে স্বাভাবিক জীবন যাপন করছেন।

২০০০ সাল থেকে লক্ষ্মীপুরে ব্র্যাকের যক্ষ্মার চিকিৎসা সেবা শুরু হয়। এ জেলার ৫টি উপজেলায় সব ইউনিয়নে (৫৮টি) বিনামূল্যে চিকিৎসা সেবা অব্যাহত রয়েছে। ১শ’ ২৩ জন স্বাস্থ্যকর্মী ও এক হাজার ২শ’ ৩০ জন স্বাস্থ্য সেবিকা আক্রান্ত রোগীদের বাড়ি বাড়ি গিয়ে নিজ হাতে ওধুষ সেবন কর‍ানো ও জনসচেতনতায় কাজ করছেন।
 
২০১৪ সালে জেলার রামগতি, কমলনগর, রায়পুর, রামগঞ্জ ও লক্ষ্মীপুর সদর উপজেলায় দুই হাজার ৪শ’ জন যক্ষ্মা রোগী চিকিৎসা সেবা পেয়ে সুস্থ হয়েছেন। প্রতি মাসে গড়ে ২শ’ জন আক্রান্ত রোগী সুস্থ হয়ে উঠছেন।
 
২০১৪ সালের অক্টোবর থেকে ডিসেম্বর মাসের জরিপে দেখা যায়, তিনমাসে লক্ষ্মীপুর জেলায় ৬শ’ তিনজন যক্ষ্মায় আক্রান্ত হয়েছেন। এদের মধ্যে পুরুষ ৩শ’ ৯৫ জন ও নারী ২শ’ আটজন।

ওই তিন মাসের জরিপে দেখা গেছে, শূন্য থেকে চার বছর বয়সী আক্রান্ত শিশু তিনজন। পাঁচ থেকে ১৪ বছর বয়সী নয়জন, ১৫ থেকে ২৪ বছর বয়সী ৬৮ জন, ২৫ থেকে ৩৪ বছর বয়সী ১শ’ চারজন, ৩৫ থেকে ৪৪ বছর বয়সী ৯৭ জন, ৪৫ থেকে ৫৪ বছর বয়সী ১শ’ ১৪ জন, ৫৫ থেকে ৬৪ বছর বয়সী ৯৭ জন ও ৬৫ থেকে উপরের বয়সীদের ১শ’ ১১ জন যক্ষ্মা আক্রান্ত রোগী ধরা পড়ে। মোট আক্রান্তদের মধ্য ৬৫ শতাংশ পুরুষ ও ৩৫ শতাংশ নারী।

পরিসংখ্যানে দেখা গেছে, ৪৫ থেকে ৫৪ বছর বয়সী নারী ও পুরুষের মধ্যেই এ রোগের হার বেশি।

এর আগে, ২০১৩ সালে ১৯ হাজার ৬শ’ ৪০ জন সন্দেহজনক রোগীর কফ পরীক্ষা করা হয়। এতে দুই হাজার ৩শ’ ২৮ জন যক্ষ্মা রোগীকে সনাক্ত করা হয়। এদের মধ্যে শিশু যক্ষ্মা রোগীর সংখ্যা ৪৯ জন।

ব্র্যাকের লক্ষ্মীপুর জেলা পর্যবেক্ষক মাকছুদা আক্তার বলেন, যক্ষ্মায় ব্র্যাকের চিকিৎসা সেবার অনন্য বৈশিষ্ট হলো, ডটস পদ্ধতিতে চিকিৎসা সেবা। এতে আক্রান্ত রোগীর কাছে নয়, সেবিকাদের কাছে ওষুধ থাকে। সেবিকারাই বাড়ি গিয়ে রোগীদের ওষুধ সেবন করিয়ে থাকেন।
 
লক্ষ্মীপুর সদর উপজেলা ব্র্যাক ব্যবস্থাপক মোহাম্মদ বাবুল আক্তার বলেন, দরিদ্ররাই এ রোগে আক্রান্ত হন বেশি। পুষ্টির অভাবে রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা কমে যাওয়ায় তারা বেশি আক্রান্ত হয়ে থাকেন। বংশগতভাবেও এ রোগ হতে পারে। এছাড়াও যক্ষ্মা রোগে আক্রান্ত ব্যক্তির হাঁচি ও কাশির মাধ্যমে রোগের জীবাণু বাতাসে গিয়ে মিশে রোগের সংক্রমণ ঘটায়।

লক্ষ্মীপুর জেলা ব্র্যাক ব্যবস্থাপক অশোক কুমার সাহা বলেন, এ জেলায় যক্ষ্মা আক্রান্ত ৯৮ শতাংশ রোগী সম্পূর্ণ সুস্থ হয়েছেন। ব্র্যাক বিনামূল্যে ওষুধ ও চিকিৎসা সেবা দিয়ে যাচ্ছে। যক্ষ্মা সনাক্তকরণে আর্থিক সহায়তাও করছে। যক্ষ্মা প্রতিরোধে সচেতনতা প্রয়োজন।
 
ব্র্যাকের পরিচালক মো. আকরামুল ইসলাম টিবি, ম্যালেরিয়া, ওয়াশ, ডিইসিসি প্রসঙ্গে বলেন, স্বাস্থ্যখাতের কর্মসূচিগুলোর মধ্যে যক্ষ্মা নিরাময় সবচেয়ে সফল। সরকারি-বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের সমন্বয়ের কারণে সফলতা পাওয়া গেছে। বিশেষ করে যক্ষ্মা রোগীকে চিহ্নিত হওয়ার পর থেকেই নজরদারি রাখার কারণে লক্ষ্যমাত্রার তুলনায় অনেক বেশি সফলতা পাওয়া গেছে।

বাংলাদেশ সময়: ০৪৪০ ঘণ্টা, মার্চ ০৪, ২০১৫

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।