ঢাকা, সোমবার, ৮ পৌষ ১৪৩১, ২৩ ডিসেম্বর ২০২৪, ২০ জমাদিউস সানি ১৪৪৬

স্বাস্থ্য

চিকিৎসার নামে অপচিকিৎসা-১

সড়কজুড়ে রোগী ঠকানো বাণিজ্য!

এম. আব্দুল্লাহ আল মামুন খান, স্টাফ করেসপন্ডেন্ট | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ০৯২৩ ঘণ্টা, জুন ১১, ২০১৫
সড়কজুড়ে রোগী ঠকানো বাণিজ্য! ছবি: বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম

শিক্ষা ও সংস্কৃতির শহর ময়মনসিংহে এখন চিকিৎসাসেবা প্রতিষ্ঠানের ব্যাপক দাপট। শহরের চরপাড়া, ব্রাক্ষপল্লী, ভাটিকাশর ও বাঘমারা এলাকায় গত কয়েক বছরে গড়ে উঠেছে নামসর্বস্ব ও নিম্নমানের অসংখ্য ক্লিনিক আর ডায়াগনস্টিক সেন্টার।

যেগুলোর অধিকাংশেই স্থায়ী চিকিৎসক, দক্ষ টেকনিশিয়ান, নার্স, আয়া বা অন্যান্য স্টাফ না থাকায় চিকিৎসার নামে চলছে অপচিকিৎসা। হয়রানির শিকার হতে হচ্ছে রোগী ও তাদের স্বজনদের। কিন্তু ঠিকই প্রতিনিয়তই কাড়ি কাড়ি টাকা হাতিয়ে নিচ্ছে ক্লিনিকওয়ালারা। সম্প্রতি শহরের ক্লিনিকপাড়ার বেপরোয়া এই চিকিৎসা বাণিজ্য ও অনিয়মের নানা দিক অনুসন্ধান করে ধারাবাহিক প্রতিবেদন তৈরি করেছেন বাংলানিউজের স্টাফ করেসপন্ডেন্ট এম. আব্দুল্লাহ আল মামুন খান। পড়ুন প্রথম পর্ব
 
ময়মনসিংহ: ময়মনসিংহ শহরের ব্রাক্ষপল্লী-চরপাড়া সড়ক। এ সড়কের পাশেই বেশ নজরকাড়া একটি সাইনবোর্ডে। তাতে লেখা ‘নিউ লাইফ জেনারেল হাসপাতাল (প্রা.)। সরকারি অনুমোদনবিহীন এ ক্লিনিকটির সম্বল বলতে পৌরসভার ট্রেড লাইসেন্স!

অনুমোদনের জন্য আবেদন করলেও ঠিকই সাইনবোর্ডে শোভা পাচ্ছে ‘সরকার অনুমোদিত’ শব্দটি। কিন্তু নেই নিজস্ব স্থায়ী কোন চিকিৎসক কিংবা নার্স।

ভেতরের পরিবেশ আরো দুর্গন্ধময় এবং স্যাঁতসেঁতে। চিকিৎসার নামে ক্লিনিকটির প্রতারণার ফাঁদে প্রতিনিয়ত ঠকানো হচ্ছে গ্রামের সহজ-সরল রোগীদের। এ ক্লিনিকটির ঠিক সামনেই ফাস্ট ডায়াগনস্টিক সেন্টার অ্যান্ড জেনারেল হাসপাতাল।

এখানেও কোন স্থায়ী চিকিৎসক বা নার্স নেই। রোগী এলে চিকিৎসক, নার্স ডাকা হয়। কখনো আবার ক্লিনিকের লোকজনই চিকিৎসক সেজে বসে।  

সরকারি শর্ত পূরণ না করায় এখনো পায়নি স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের অনুমোদন। তবুও নিজেদের মতো করে স্বাস্থ্যসেবার নাম করে ভয়ঙ্কর প্রতারণা চালিয়ে যাচ্ছে অবৈধ এ ক্লিনিকটিও।

শুধু অনুমোদনহীন এ দু'ক্লিনিকই নয়, ব্রাক্ষপল্লী-চরপাড়া সড়কের প্রায় পৌনে এক কিলোমিটার সড়কজুড়ে সরকারি অনুমোদন নিয়ে রোগী ঠকানোর বাণিজ্য চালিয়ে যাচ্ছে আরো প্রায় ২৮টি ক্লিনিক ও ডায়াগনস্টিক সেন্টার। মানহীন এসব চিকিৎসাসেবা প্রতিষ্ঠান রোগীদের জন্য হয়ে উঠেছে বিষফোঁড়া।

ময়মনসিংহ জেলা সিভিল সার্জন অফিসের ভাষ্যমতে, শহরে অনুমোদিত ক্লিনিক রয়েছে ১০৯টি। আর ডায়াগনস্টিক সেন্টার ৭৯টি। অনুমোদনের জন্য আবেদন করেনি চারটি ক্লিনিক ও ডায়াগনস্টিক সেন্টার। আবেদন করেছে আরো পাঁচটি। তবে এর বাইরেও শহরের অলি-গলিতে আরো ক্লিনিক-ডায়াগনস্টিক সেন্টার গজিয়ে উঠেছে বলে জানিয়েছে একাধিক সূত্র।

সম্প্রতি সরেজমিনে সপ্তাহখানেক এসব ক্লিনিক-ডায়াগনস্টিক সেন্টারে বাংলানিউজ অনুসন্ধান চালিয়ে নানা অনিয়ম ও অব্যবস্থাপনার চিত্র ধরা পড়ে। নামসর্বস্ব এসব প্রতিষ্ঠানের বিরুদ্ধে বার বার অভিযোগ উঠলেও জেলা সিভিল সার্জন অফিস ও সংশ্লিষ্ট প্রশাসন রহস্যজনক কারণে প্রতারণামূলক এ বাণিজ্যের লাগাম টেনে ধরতে পারছে না।

কিছুদিন আগে ক্লিনিকপাড়ায় র‌্যাব ও প্রশাসনের উদ্যোগে ভ্রাম্যমাণ আদালত পরিচালিত হয়। এতে বেশ কিছু ক্লিনিককে জরিমানার টাকা গুণতে হয়। অত:পর জরিমানা দেয়া প্রতিষ্ঠানগুলো চলছে আগের মতোই। যেন দেখার নেই কেউ।

দেখা গেছে, শহরের ব্রাক্ষপল্লী-চরপাড়া সড়কে প্রায় ২৮ থেকে ৩০টি ক্লিনিক ও ডায়াগনস্টিক সেন্টার। ভাড়াটিয়া বাসায় গড়ে উঠা এসব ক্লিনিক ডায়াগনস্টিক সেন্টারের উল্লেখযোগ্য হচ্ছে- আছিয়া হাসপাতাল, নাসিরাবাদ হাসপাতাল, নিউ লাইফ জেনারেল হাসপাতাল, ফাস্ট জেনারেল হাসপাতাল, পদ্মা জেনারেল হাসপাতাল প্রাইভেট লিমিটেড, ইয়াসমিন নার্সিং হোম, বাঁধন হাসপাতাল প্রাইভেট লিমিটেড, জাহাঙ্গীর হেলথ কমপ্লেক্স, মোল্লা নার্সিং হোম, সুরক্ষা নার্সিং হোম, শিথিল ডায়াগনোস্টিক সেন্টার, এপেক্স হাসপাতাল প্রাইভেট লিমিটেড।

এছাড়া রয়েছে ন্যাশনাল নার্সিং হোম, ফাইজা হেলথ কেয়ার সেন্টার, নিউ পদ্মা ডায়াগনস্টিক সেন্টার, আকরাম প্যাথলজি ল্যাব, নিউ দেশ প্যাথলজি, নিউ আল শেফা প্রাইভেট হাসপাতাল, জীবনের আলো প্রাইভেট হাসপাতাল, বন্ধু হাসপাতাল, এশিয়া হাসপাতাল, ভিশন ডায়াগনস্টিক সেন্টার, আলামিন নার্সিং হোম, ইসলাম ডায়াগনস্টিক সেন্টার, পরিচর্যা হাসপাতাল, সোনালী হাসপাতাল প্রাইভেট লিমিটেড, আল-আমিন নার্সিং হোম, ইকরা ডিজিটাল ডায়াগনস্টিক সেন্টার ও স্টার ডায়াগনস্টিক সেন্টার।

সরেজমিনে গিয়ে এসব বেশিরভাগ ক্লিনিক ডায়াগনস্টিক সেন্টারের অস্বাস্থ্যকর, নোংরা, ময়লা, ঘিঞ্জি ও দুর্গন্ধময় পরিবেশ, আধুনিক যন্ত্রপাতির অভাব ও দুর্বল বর্জ্য ব্যবস্থাপনার চিত্র ফুটে উঠে। বিছানা অনুযায়ী প্রয়োজনীয় সংখ্যক দক্ষ চিকিৎসক, টেকনিশিয়ান, নার্স বা অন্যান্য স্টাফ নেই এসব স্বাস্থ্যসেবা প্রতিষ্ঠানে।

কোন কোন ডায়াগনস্টিক সেন্টারে এক্সরে কক্ষের চার পাশের দেয়ালে রেডিয়েশন বা বিকিরণ ঠেকাতে নেই সঠিক পুরুত্বের সিসাযুক্ত ধাতব আবরণ। আবার বেশিরভাগেরই নেই পরিবেশ অধিদপ্তরের ছাড়পত্র।

সরকারি অনুমোদন ছাড়াই বেপরোয়া ব্যবসা করা নিউ লাইফ জেনারেল হাসপাতালের অপারেশন থিয়েটারের বেহাল দশা দেখে বেরিয়ে আসার সময়ই ৫ জন রোগী ধরে নিয়ে এলেন একজন মাঝবয়সী দালাল। কথিত একজন নার্স দৌড়ের ওপর তাদের ভেতরে নিয়েই দরজা বন্ধ করে দিলেন।

এ অবস্থার কারণ জানতেই সংশ্লিষ্ট হায় হায় ক্লিনিকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক এ. কে. এম. আসাদুজ্জামান পাইলট নিজেকে সাংবাদিক পরিচয় দিয়ে আন্ডার গ্রাউন্ড এক সাপ্তাহিকের পরিচয়পত্র দেখালেন। বেশ দাপটের সঙ্গে বললেন, শহরের সব ক্লিনিকের অবস্থাই খারাপ। আপনারা লিখে কিছুই করতে পারবেন না। সব দোষ ডাক্তারদের। ওরা কসাই। ওদের কারণেই তো আমার মতো সবাই এরকম স্টাইলে ব্যবসা করতে পারছি।

এ ক্লিনিকের ঠিক সামনের ১১ বিছানার ফাস্ট ডায়াগনস্টিক সেন্টার অ্যান্ড প্রাইভেট হাসপাতালে গিয়ে দেখা গেলো, অপারেশন থিয়েটারে বসে গজ-ব্যান্ডেজ কাটছেন তুলি নামের এক তরুণী। তিনি না কী এ ক্লিনিকের নার্স! কিছু জিজ্ঞাসা করতেই হনহন করে সামনে দিয়ে চলে গেলেন পাশের কক্ষে। অত:পর দৌড়ে এলেন পারভীন নামের অপর এক কথিত নার্স। মূলত দুজনেই ক্লিনিকের আয়া!

কোন শিক্ষা প্রতিষ্ঠান থেকে পাস করেছেন, ডিপ্লোমাধারী কী না এসব প্রশ্ন করতেই যেন থ মেরে গেলেন। আমতা আমতা করে বলেন, খাতা কলমে আমার কোন শিক্ষা নেই। দেখে দেখে শিখতাছি।

১০ বিছানার পদ্মা জেনারেল হাসপাতালে গিয়েও দু্একজন কথিত নার্স আর ক্লিনিকটির পরিচালক ফারহানা আফরোজ ছাড়া কাউকেও পাওয়া গেলো না। সরকারি শর্ত অনুযায়ী অপারেশন থিয়েটারের আকার ১২০ বর্গফুট, অগ্নিনির্বাপক ব্যবস্থা থাকার কথা থাকলেও সেগুলো নেই। সরু সিঁড়ি দিয়ে উঠতে গেলে রোগীদের দফা-রফা হবার কথা।

অপারেশন থিয়েটারের আকার সম্পর্কে জানতে চাইলে ক্লিনিকটির পরিচালক পরিচয়দানকারী ফারহানা আফরোজ খানিকটা অসন্তুষ্ট হয়ে বললেন, বাড়ির মালিককে জিজ্ঞাসা করেন। তিনি বলতে পারবেন। চিকিৎসকরা বাইরে আছেন।

এ ক্লিনিকের গেটে পা ফেলতেই ব্যাগ হাতে রিকশা থেকে নামলেন এক পেশাদার দালাল। সঙ্গে তিন রোগী। ময়মনসিংহের ফুলবাড়িয়া থেকে এসেছেন। হাতে নোটবুক দেখেই চতুর দালাল নিজের নাম গোপন করে বললেন, আমি রোগীর আত্মীয়।

নামসর্বস্ব ক্লিনিক-ডায়াগনস্টিক সেন্টারের বিষয়ে ক্ষোভ প্রকাশ করে বাংলাদেশ প্রাইভেট ক্লিনিক এন্ড ডায়াগনস্টিক সেন্টার ওনার্স অ্যাসোসিয়েশনের ময়মনসিংহ জেলা শাখার সাধারণ সম্পাদক ডা: এ.কে.এম. ওয়ালিউল্লাহ বলেন, শহরে কমপক্ষে ৩শ’ ক্লিনিক ও ডায়াগনস্টিক সেন্টার রয়েছে। এর মধ্যে ৫০ থেকে ৬০টি আমাদের সংগঠনের সদস্য।

তিনি বলেন, প্রশাসনের যথাযথ নজরদারি না থাকায় ব্যাঙের ছাতার মতো ক্লিনিক গড়ে উঠেছে। নামসর্বস্ব বিভিন্ন ক্লিনিকে অপচিকিৎসা ও প্রতারণা চললেও প্রশাসনের কোন নিয়ন্ত্রণ নেই। জেলা সিভিল সার্জন অফিস তাদের খবর রাখে না। এসব ক্লিনিক কীভাবে লাইসেন্স পায়- প্রশ্ন রাখেন তিনি।

জনউদ্যোগের আহবায়ক অ্যাডভোকেট নজরুল ইসলাম চুন্নু বলেন, ময়মনসিংহের ক্লিনিক ব্যবসায় সরকারের সবার জন্য স্বাস্থ্য সেবা নিশ্চিত করার যে অঙ্গীকার ও সাধারণ জনগণের যে সাংবিধানিক অধিকার তা অনেকাংশেই ব্যাহত হচ্ছে। তারা রোগীর সেবার চেয়ে নিজস্ব ব্যবসাকেই বড় করে দেখে। প্রশাসনের উচিত এ বিষয়ে সার্বক্ষণিক তদারকি করা।  

স্থানীয় ব্যবসায়ী আব্দুল হান্নান অভিযোগ করেন, গ্রামের সহজ-সরল রোগী এখানে আসে বেশি। একেকজনের কাছ থেকে একেক রকম টাকা আদায় করা হয়। রোগীরাও প্রতারণার শিকার হয় কমবেশি। কিন্তু ঘটনা বাইরে বের হয় কম।

একই রকম তথ্য দিলেন স্থানীয় চরপাড়া এলাকার বাসিন্দা সজিব আহমেদ রুবেল। ক্ষোভের সঙ্গে তিনি বলেন, এসব ক্লিনিক নামসর্বস্ব, নোংরা। ডিগ্রিধারী কোন চিকিৎসক নেই। শিক্ষানবিশ চিকিৎসকরা ডাক পড়লে আসেন।

বড় বড় চিকিৎসক ওটি করে টাকা গুণে চলে যান।   ফি’র তালিকা বাবদ কোন চার্ট নেই। এখানে জবাই করে টাকা নেওয়াটাই নিয়ম। আমাদের স্বজনদের নিয়ে এসব ক্লিনিকে যেতেও ভয় হয়। প্রতিনিয়ত প্রতারণার চিত্র উদ্বেগ ও আতঙ্কের।

এ প্রসঙ্গে জানতে চাইলে ময়মনসিংহ জেলা সিভিল সার্জন ডা: মোস্তফা কামাল বলেন, এসব ক্লিনিক, ডায়াগনস্টিক সেন্টারে গলাকাটা ব্যবসা বন্ধের জন্য ব্যবস্থা নেওয়া হচ্ছে। ইতোমধ্যে তাদের জেলা সিভিল সার্জন অফিস থেকে চিঠি দেয়া হয়েছে। নিয়ম মাফিক ক্লিনিক বা ডায়াগনস্টিক সেন্টার না চললে বন্ধ করে দেয়া হবে বলেও জানিয়ে দেয়া হয়েছে।

বাংলাদেশ সময়: ০৯২৪ ঘণ্টা, জুন ১১, ২০১৫
জেডএম

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।