ঢাকা, সোমবার, ৮ পৌষ ১৪৩১, ২৩ ডিসেম্বর ২০২৪, ২০ জমাদিউস সানি ১৪৪৬

স্বাস্থ্য

ডাক্তারই যখন স্তনক্যান্সারের রোগী

সাজেদা সুইটি, সিনিয়র করেসপন্ডেন্ট | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ১২০২ ঘণ্টা, নভেম্বর ৫, ২০১৫
ডাক্তারই যখন স্তনক্যান্সারের রোগী ছবি: কাশেম হারুণ/বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম

ঢাকা: স্তনক্যান্সারের অসংখ্য রোগীর নিরাময়ে সদাব্যস্ত তিনি। হাস্যোজ্জ্বল মুখে রোগীদের অভয় দিচ্ছেন, নানা উপায় বাতলে দিচ্ছেন।

কে বলবে, এ হাসিমুখের মানুষটি নিজেই স্তনক্যান্সারের রোগী!

স্বনামধন্য চিকিৎসক অধ্যাপক কর্নেল (ডা.) সেলিনা আক্তার একজন ক্যান্সার সারভাইবার। তাকে দেখে অনুপ্রাণিত হন রোগীরা। পরিচিত অনেকেই তার নামটি উদাহরণ হিসেবে টানেন। যারা লজ্জা-সঙ্কোচ-ভয়ে রোগ লুকান, তাদের উৎসাহের অপর নাম ডা. সেলিনা।

তার শরীরে রোগ ধরা পড়ে ২০১৩ সালে। দেশে ও সিঙ্গাপুরে চিকিৎসা নিয়েছেন। এখন দিব্যি রোগী দেখছেন, বিভাগের কাজ তদারকি করছেন।

বাংলানিউজের সঙ্গে আলাপচারিতায় নিজের অভিজ্ঞতা-উদ্বেগ-আশার কথা তুলে ধরেন তিনি। উনার সঙ্গে আলাপ হয়েছিলো ঢাকা সেনানিবাসের ‘আর্মড ফোর্সেস ইনস্টিটিউট অব প্যাথলজি’ ভবনে তার নিজ কক্ষে।

এ সাহসী নারী সেনাবাহিনীতে আছেন ৩১ বছর ধরে। প্যাথলজিস্ট হিসেবে ৯০ সাল থেকে, এফএনএসি (কোষ বের করে রোগ শনাক্ত) করেন ৯৩ সাল থেকে। বাংলাদেশে সর্বপ্রথম ফেলোশীপ করেছেন তিনি, ‘বাংলাদেশ কলেজ অব ফিজিশিয়ানস অ্যান্ড সার্জনস’ থেকে।

স্বামী ব্রিগেডিয়ার জেনারেল আনোয়ারও চোখের বিশেষজ্ঞ চিকিৎসক। এখন এলপিআর-এ রয়েছেন। একমাত্র মেয়ে নওরীন আনোয়ার সফটওয়্যার ইঞ্জিনিয়ার, কানাডায় মন্ট্রিয়ালে থাকে।

‘কেমোথেরাপি নেওয়ার পর হাড়ে ব্যথা করতো। ত্বক-নখের রং কালো হয়ে গেল, চুল ঝরে গেল। কেমো চুল গজাতে দেয় না। চিকিৎসা শেষে গজিয়েছে, গায়ের রং ঠিক হয়েছে। শুধু ডানহাতের মধ্যমার নখটি খয়ে গেছে’- আঙুলটি দেখান তিনি।  

মনে মনে সান্ত্বনাও পান এ চিকিৎসক। বলেন, রোগীদের কষ্ট আরও ভালো বুঝতে পারছি। কাউন্সিলিং করি সেভাবে।

অন্যদের জন্য কিছু পরামর্শ তুলে ধরেন এ সুযোগে:

লক্ষণ
সিস্ট, নিপল ডিসচার্জ (রক্ত), লাম্প ফিক্সড বা অনিয়মিত হলে ডাক্তারের শরণাপন্ন হতে বলেন তিনি।

পরামর্শ দেন, ‘প্রথমে মেমোগ্রাম (স্তনের এক্স-রে), সঙ্গে এফএনএসি (কোষ বের করে পরীক্ষা)। প্রথমে স্তনক্যান্সার ধরা নাও পড়তে পারে। ফলোআপে থাকতে হবে। অন্তত তিনমাসের মধ্যে আবার চেক করাতে হবে।

‘স্তনে সিস্ট বা ব্যথা মানেই স্তনক্যান্সার নয়’- বলেন তিনি। পিরিয়ড চলাকালে স্তনে সিস্ট দেখা দিতে পারে, সেরেও যায়। গ্রানুলুমা (স্তনে দুধ জমা হয়ে চারদিকে শক্ত হয়ে যাওয়া) এবং অ্যাবসেস’র (পুঁজ) কারনে স্তনে ব্যথা হতে পারে।

প্রথমদিকে ক্যান্সারে কোনো ব্যথা থাকে না। পরে বেড়ে চাপ তৈরি করে ব্যথা দেয়।

খরচ কমানো সম্ভব
সরকারি হাসপাতালে চিকিৎসা নিতে বলেন তিনি। তবে দালালের হাতে পড়া চলবে না। পরীক্ষার পরে রিপোর্ট নিয়ে সার্জনের কাছে যেতে হবে। অনেকে গাইনী চিকিৎসকের কাছে যান। কিন্তু অপারেশন ব্রেস্ট সার্জনের হাতেই হবে।

সরকারি হাসপাতালে বিনামূল্যে বা কমমূল্যে চিকিৎসা নিতে পারবে রোগী। এখানে মেমোগ্রাম ২ হাজার টাকা, এফএনএসি ৪শ টাকা, দরিদ্রদের ক্ষেত্রে ২৫০ টাকা রাখা হয়। অপারেশনও সরকারি হাসপাতালে করলে কম খরচে হয়ে যাবে।

চাই সমন্বিত উদ্যোগ
দেশে ক্যান্সার সাপোর্ট গ্রুপকে শক্তিশালী করতে হবে বলে মনে করেন তিনি।

একটি জাতীয় সমন্বিত কমিটি থাকতে হবে। সচেতনতা বাড়াতে প্রচার চালাতে হবে। স্তন ক্যান্সার নিরাময়যোগ্য। স্তন না ফেলে শুধু টিউমার ফেলে ও অন্য ব্যবস্থায় রোগী বেঁচে যেতে পারেন।

তিনি বলেন, পৃথিবীর সব দেশে সিঙ্গল ব্রেস্ট কেয়ার সেন্টার দরকার। সেন্টারে কাউন্সিলর থাকা জরুরি। ফার্মাসিস্ট সরাসরি রোগীর সঙ্গে কথা বলবেন। ড্রাগস কী লাগবে, সাপ্লিমেন্ট কী হবে, কী কী জটিলতা হতে পারে- জানাবেন তিনি।

হুট করেই কেমো নয়
আলট্রাসনোগ্রাফি, মেমোগ্রাফি, এফএনএসি করে রোগ ধরা পড়লে চিকিৎসা নিতেই হবে। সার্জন পেট স্ক্যান করতে বলবেন। তারপরই প্ল্যানটা করতে হবে। ক্যান্সার কোনো স্টেজে আছে দেখতে হবে। তবেই সিদ্ধান্ত- রেডিও কেমো আগে, নাকি সার্জারি।

সেলিনা বলেন, কেমোথেরাপি সবচে ভাইটাল পার্ট। কেউ কেউ ইচ্ছেমতো কেমো দেয়। রোগী টলারেট করতে না পারলেও দেয়। উচ্চতা ও ওজন দেখে সিদ্ধান্ত নিতে হবে। সে কতোটা সইতে পারে। লাম্প পেলেই অনেকে চরম সিদ্ধান্ত নিয়ে বসেন।

অপারেশন হবে ব্রেস্টসার্জনের হাতেই
তিনি বলেন, ব্লাড ক্যান্সারসহ অন্য ক্যান্সারেরও ঝুঁকি এসে যায় ভুল অপারেশনে। মৌচাক ভেঙে দিলে চারদিকে মৌমাছিরা ছড়িয়ে পড়ে, তেমনি ক্যান্সারও। তাই সাবধান থাকা জরুরি। অনেকে অপারেশন করতে চায় না, ভয় পায়। কিন্তু বোঝা উচিৎ, জীবন আগে। ভালো সার্জনের হাতে অপারেশন করাতে হবে।

অনকোলজিস্ট বাড়াতে হবে
অনকোলজিস্ট বাড়াতে হবে, প্রশিক্ষণ দিতে হবে। ট্রেক্সাসের মেরি অ্যান্ডারসন, সিঙ্গাপুরে ন্যাশনাল ইউনিভার্সিটি হসপিটাল, ক্যান্সার সেন্টারের মতো প্রতিষ্ঠানে প্রশিক্ষণ দেওয়া প্রয়োজন তাদের।

মাউন্ট এলিজাবেথ হাসপাতালে খরচটা বেশি পড়ে। সেখানে আমাদের দেশের রোগীদের উপযোগী প্রশিক্ষণ পাওয়া যাবে না হয়তো।

মূল কারণ
কোথাও কোথাও মিথ রয়েছে যে, বক্ষবন্ধনী, লোশন-পারফিউম ব্যবহারে স্তনক্যান্সার হয়। কিন্তু এর সত্যতা পাওয়া যায় না।

বরং হরমোনাল ইমব্যালেন্স, জেনেটিক কারণ, ক্যান্সারের জিন থাকলে হঠাৎ মিউটেশন হতে পারে। স্টিমবাথ নিলে ক্ষতি হতে পারে। ওরাল কনট্রাসেপটিভ পিল খেলে হরমোন সমস্যা হতে পারে, যাতে ক্যান্সার হতে পারে।

ব্যায়াম না করা, রিচ ফুড বেশি খাওয়া, হতাশা, অধিক প্রিজার্ভেটিভ দেওয়া খাবার খাওয়া ঠিক নয়।

আলাপের শেষের দিকে ল্যাবটি ঘুরে দেখান তিনি। কাজ করছেন দেলোয়ার, জয়নুল, সাজ্জাদ, মিরু, তারানা, ইশতিয়াক নামের সেনা-চিকিৎসক ও টেকনিশিয়ানরা।

সেলিনা জানান, ১২ থেকে ২৪ ঘণ্টায় রোগ সম্পর্কে জানা যেতে পারে। কোনো ক্ষেত্রে দেরিও হয়, অন্তত তিনদিন লেগে যায়। এ সময় অনেক রোগী ভয় পেয়ে যান, মানসিকভাবে ভেঙে পড়েন। কাউন্সিলিংটা এজন্য এতো প্রয়োজন।

জানালেন, এ হাসপাতালে সবাই চিকিৎসা নিতে পারে। কুর্মিটোলা জেনারেল হাসপাতালে এলেও এখানে পাঠিয়ে দেওয়া হয়। এখানে অত্যাধুনিক মানের যন্ত্রপাতি রয়েছে।

বাংলাদেশ সময়: ১২০১ ঘণ্টা, নভেম্বর ০৩, ২০১৫
এসকেএস/বিএস

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।