ঢাকা, সোমবার, ৮ পৌষ ১৪৩১, ২৩ ডিসেম্বর ২০২৪, ২০ জমাদিউস সানি ১৪৪৬

স্বাস্থ্য

বন্ধুদের পুরনো খাতার ফাঁকে ফাঁকে লিখে মেডিকেল ছাত্র!

ইসমাইল হোসেন, সিনিয়র করেসপন্ডেন্ট | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ১২১৬ ঘণ্টা, মার্চ ১১, ২০১৭
বন্ধুদের পুরনো খাতার ফাঁকে ফাঁকে লিখে মেডিকেল ছাত্র! মেডিকেল ছাত্র ইমরান হাসান। ছবি: রানা

ঢাকা: জন্মের দ্বিতীয় বছরে বাবার মৃত্যু, ঠাঁই হয়নি দাদার বাড়িতে। বিধবা-দরিদ্র নানীর ঘরে থেকে ঝি’য়ের কাজ করে বড় করে তুলেছেন মা।দারিদ্রের কষাঘাতে বন্ধুদের পুরনো খাতায় লিখেছেন, ক্ষেতে কাজ করে দিয়েছেন পরীক্ষার ফি, শিক্ষক-জনপ্রতিনিধির সহায়তায় শিক্ষাজীবনের প্রতিটি স্তরে সাফল্যের শিখরে ছিল স্থান, সেই ইমরান এখন মেডিকেল ছাত্র। দেড় যুগের কষ্টের কথা শোনালেন কয়েক মিনিটেই।

পটুয়াখালীর সরকারি সৈয়দ হাতেম আলী কলেজ থেকে উচ্চ মাধ্যমিকে উত্তীর্ণ হয়ে বর্তমানে স্যার সলিমুল্লাহ মেডিকেল কলেজে ডাক্তারি পড়ছে মো. ইমরান হাসান।

জন্ম তার গলাচিপা থানার গোলখালি গ্রামের দুঃখ-দুর্দশাগ্রস্ত এক পরিবারে।

বাবা দরিদ্র কৃষক খেয়ে না খেয়ে অন্যের জমিতে চাষ করে দিন পার করতেন। জন্মের দুই বছর পরই বাবা মারা যান ব্লাড ক্যান্সারে।
 
‘দাদা বাড়ি থেকে জানিয়ে দেয়া হলো আমাদের আর আশ্রয় দিতে পারবে না। আর কোনো অবলম্বন না থাকায় মায়ের সাথে নানা বাড়ি চলে আসি। নানা বাড়ি বলতে শুধুই আমার নানি। ’
 
দরিদ্র নানির নিজের নাওয়া-খাওয়া, সাথে বাড়তি দু’জন! অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আবদুল মুহিতসহ উপস্থিতিদের দৃষ্টি আকর্ষণ করে ইমরান বলেন, ‘বুঝতেই পারছেন স্যার, কতটা কঠিন ছিল আমাদের জীবন। আমার মা অন্যের বাড়িতে কাজ করে খেয়ে-না খেয়ে আমাকে বড় করেছে। ’
 
‘আমি যখন পঞ্চম শ্রেণিতে পড়ি তখন বৃত্তি পরীক্ষার জন্য ৫০ টাকা ফি। মা তখন অসুস্থ, ঘরে খাবারও নেই। টাকার অভাবে মাকে চিকিৎসা করা তো দূরের কথা, দু’মুঠো খাবারও দিতে পারিনি মুখে। এমন অবস্থায় পরীক্ষার ফি’র কথা মায়ের কাছে কোন মুখে বলবো!’
 
পিনপতন নীরবতার মধ্যে জীবনের গল্প বলছে ইমরান।
 
‘স্কুল থেকে ফিরে দেখি মা না খেয়ে আছে। এক প্রতিবেশী বললো, চল আমার ক্ষেতে কাজ কর, তোকে পরীক্ষার ফি দিয়ে দেব।

আমি না খেয়ে তখন ক্ষেতে কাজ করি। সারা বিকাল শেষে আমাকে ৩০ টাকা দিয়ে বললেন এটা দিয়ে তোর ফি দে।
 
পর দিন ওই ৩০ টাকা নিয়ে স্কুলে গিয়ে স্যারকে বলি, আমার মা তো অসুস্থ, আমার কাছে আর টাকা নেই। আপাতত ৩০ টাকা রাখেন, বাকি টাকা মা সুস্থ হলে পরিশোধ করবো। তখন স্যার ২০ টাকা মওকুফ করে দিলেন। আল্লাহর রহমতে আমি পঞ্চম শ্রেণিতে ট্যালেন্টপুলে বৃত্তি পাই এবং উপজেলায় প্রথম স্থান অধিকার করি।
 
ইমরানের কষ্টের জীবনে প্রথম সফলতায় মিরপুরে শহীদ সোহরাওয়ার্দী ইনডোর স্টেডিয়ামে নীরবতা ভেঙে হল ভর্তি হাজার হাজার দর্শকের হাতে তখন করতালি।
 
আবারও গল্প বলা শুরু… তখনও প্রতিবেশীদের অনেকে ব্যাঙ্গ করে বলছিল, আর লেখাপড়ার দরকার নেই। যার দু’বেলা খাবারই জোটে না তার আবার লেখাপড়ার কী দরকার।
 
‘কিন্তু আমার মা! কারো কথাই শোনেনি। ভর্তি করে দেয় গ্রামের হাইস্কুলে। ’
 
‘আমার এখনও মনে আছে, সহপাঠীদের পুরনো খাতা এনে তার ফাঁকে ফাঁকে লিখতাম। কাগজ-কলম কেনার সামর্থ ছিল না। কেরোসিনের অভাবে ঘরে আলো জ্বলতো না। সামনে জেএসসি পরীক্ষা, অনেক লেখাপড়া। কী আর করবো, প্রতিবেশীদের বারান্দায় গিয়ে সৌর বিদ্যুতের আলোয় পড়ে চলে আসতাম।
 
‘জেএসসিতে আমি গোল্ডেন ‘এ’ প্লাস-সহ ট্যালেন্টপুলে বৃত্তি পাই। ’ -এবার হাততালি আরও বেড়ে গেল।  
 
এরপর…
 
‘সামনে এসএসসি পরীক্ষা, ফরম পূরণের সময় হয়েছে। আমার কাছে তখন কোনো টাকা নেই। স্যারদের সহযোগিতায় ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যানের সহায়তায় কোনো রকম ফরম পূরণ করি। ’
 
‘আমি এসএসসি পরীক্ষায় গোল্ডেন ‘এ’ প্লাস পাই এবং বরিশাল বোর্ডে চতুর্থ স্থান অধিকার করি। আমাদের স্কুল থেকে প্রথমবারের মতো ‘এ’ প্লাস, গোল্ডেন ‘এ’ প্লাস এবং বোর্ডে কোনো প্লেস!’
 
‘ভেবেছিলাম, আর হয়তো লেখাপড়া কনটিনিউ করতে পারবো না। কিন্তু ইউনিয়ন পরিষদ চেয়ারম্যান আমাকে কলেজে ভর্তি করিয়ে দেন। ’
 
‘আমি এইচএসসি পরীক্ষায় গোল্ডেন ‘এ’ প্লাস পাই এবং বরিশাল বোর্ডে প্রথম স্থান অধিকার করি। ’ এ পর্যায়ে ফের ইমরানের বয়সী শিক্ষার্থীদের হাততালিতে কেঁপে উঠলো ইনডোরের হলরুম।
 
‘স্বপ্ন ছিল মেডিকেলে পড়বো, ডাক্তার হয়ে মানুষের সেবা করবো। কিন্তু সামর্থ ছিল না। ভর্তি পরীক্ষা দেই স্যার সলিমুল্লাহ মেডিকেল কলেজে। চান্স পাওয়ার পরও আমাকে ভাবতে হয়েছে- আমি কি ভর্তি হতে পারবো? আদৌ কি আমার ডাক্তার হওয়ার স্বপ্ন পূরণ হবে?’
 
তখন কলেজের প্রিন্সিপাল স্যার আমাকে দশ হাজার টাকা দেন, ভর্তি হই। মনে হচ্ছিলো, মেডিকেলে অনেক খরচ, আমার মায়ের পক্ষে কি এতো খরচ সম্ভব হবে, নাকি আমার ডাক্তার হওয়ার স্বপ্ন অপূর্ণই থেকে যাবে?’
 
‘এমন দ্বিধাদ্বন্দ্বের মধ্যে শুনলাম ডাচ বাংলা ব্যাংক বৃত্তির জন্য মনোনীত করেছে। আমি ও আমার মা খুশিতে আত্মহারা, কেউ অন্তত আমার পাশে এসে দাঁড়িয়েছে, ডাচ-বাংলা ব্যাংক আমার বাবার ভূমিকা পালন করবে…। ’
 
‘আমি এখনও গর্ব করে বলতে পারি, আমার মা এখনও মানুষের বাসায় ঝি’র কাজ করে আমার পড়ালেখা চালাচ্ছে। উদ্দেশ্য একটাই- আমাকে মানুষ করবে। এখন ভাল ডাক্তার হয়ে দেশের জন্য কিছু করতে পারি। আমার বাবা সুচিকিৎসার অভাবে মারা গেছেন। আর কোনো বাবাকে যেন চিকিৎসার অভাবে না মরতে হয়। ’
 
চোখ মুছতে মুছতে যখন ইমরান কথাগুলো বলছিলেন, তখন চোখ ছল ছল করছিল অনেকেরই।
 
ডাচ-বাংলা ব্যাংকের শিক্ষাবৃত্তির জন্য মনোনীত ইমরানের মতো দারিদ্রের কষাঘাত পেরিয়ে এমন গল্প বলছিল আরও কয়েকজন।
 
অনুষ্ঠানে ২০১৬ সালের এইচএসসি ও সমমান উত্তীর্ণ হয়ে বিশ্ববিদ্যালয় ও বিভিন্ন মেডিকেলে ভর্তি দুই হাজার ২৮ জন মেধাবী শিক্ষার্থীকে বৃত্তিপত্র দেওয়া হয়।
 
আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলো শিক্ষাবৃত্তি প্রদানের মতো কর্মকাণ্ড বেশী দৃষ্টি আকর্ষণ করবে বলে মনে করেন অর্থমন্ত্রী।
 
বাংলাদেশ সময়: ১৮০০ ঘণ্টা, মার্চ ১১, ২০১৭
এমআইএইচ/জেডএম

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।