ঢাকা, সোমবার, ৮ পৌষ ১৪৩১, ২৩ ডিসেম্বর ২০২৪, ২০ জমাদিউস সানি ১৪৪৬

স্বাস্থ্য

দেশের প্রান্তিক পর্যায়ে রয়ে গেছে পুষ্টির ঘাটতি

মাসুদ আজীম, স্টাফ করেসপন্ডেন্ট | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ১১৩৫ ঘণ্টা, নভেম্বর ১২, ২০১৮
দেশের প্রান্তিক পর্যায়ে রয়ে গেছে পুষ্টির ঘাটতি ছবি: সংগৃহীত (প্রতীকী)

ঢাকা: দেশের প্রত্যন্ত অঞ্চলের মা ও শিশুরা সরকারের নিউট্রিশন (পুষ্টি) সার্ভিসের সুযোগ-সুবিধা ভোগ করলেও কিশোর-কিশোরীরা এ সেবা থেকে অনেকাংশে বঞ্চিত হচ্ছে। এছাড়া গর্ভবতী নারী এবং শূন্য থেকে পাঁচ বছর বয়সী শিশুদের ওজন পরিমাপের জন্য যন্ত্রপাতি ব্যবহৃত হচ্ছে অর্ধেকেরও কম।

সম্প্রতি বাংলাদেশের দুর্গম এলাকায় পুষ্টিসেবার বর্তমান অবস্থা ও চাহিদা সম্পর্কে গবেষণালব্ধ ফলাফলে এ তথ্য উঠে এসেছে।  

বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ের (বিএসএমএমইউ) পাবলিক হেলথ অ্যান্ড ইনফরমেটিকস বিভাগ এ গবেষণা কার্যক্রম পরিচালনা করেছে।

গবেষণাটি চালানো হয়েছে দেশের চরাঞ্চল, উপকূলীয় এলাকা, হাওর ও পাহাড়ি অঞ্চলগুলোতে। বিশেষ করে যে এলাকাগুলোর যোগাযোগ ব্যবস্থা অন্যান্য এলাকার তুলনায় নাজুক।

গবেষণায় দেখা যায়, দেশের চর ও দ্বীপ এলাকায় নারী শিশুরা আয়রন ও ক্যালসিয়াম সম্পূর্ণরূপে গ্রহণ করছে। আবার পাহাড় ও উপকূলীয় এলাকায় কৃমির ওষুধ ও সম্পূরক  আয়রনের ব্যবহার বেশি করছে কিশোরীরা। তবে সমন্বিত পুষ্টির ব্যবহার কোথাও হচ্ছে না। ফলে এসব অঞ্চলে পুষ্টির ঘাটতি থেকে যাচ্ছে। এ অবস্থার জন্য অসচেতনতার পাশপাশি ঠিকমত সরকারি সুযোগ-সুবিধা পৌঁছানোর ঘাটতির বিষয়টি উল্লেখ করা হয়েছে গবেষণায়।

গবেষণায় মূলত যে বিষয়গুলো উঠে এসেছে সেগুলো হলো- এলাকাগুলোতে সরকারের প্রকল্পগুলোর মাধ্যমে শিশুদের অসুস্থতার সমন্বিত ব্যবস্থাপনায় ৬২ শতাংশ, জন্মের পূর্ববর্তী সেবায় ৫২ শতাংশ, মায়ের দুধ পানের মাধ্যমে ৩৮ শতাংশ এবং কিশোরীদের সেবায় ১৪ শতাংশ পুষ্টি সুবিধা পাচ্ছে ওইসব এলাকার মানুষরা। সরকার পরিচালিত ২৯টি সেবা যা ১৫টি উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্স এবং ১৪টি ইউনিয়ন সাব-সেন্টারের মাধ্যমে পেয়ে থাকে।

চলতি বছরের ফেব্রুয়ারি থেকে সেপ্টেম্বর পর্যন্ত বাংলাদেশের কুড়িগ্রাম, সিরাজগঞ্জ, বাগেরহাট, খুলনা, কিশোরগঞ্জ, সুনামগঞ্জ, নেত্রকোনা, রাঙামাটি, ভোলা, কক্সবাজার, নোয়াখালী জেলার ১৫টি প্রত্যন্ত উপজেলাতে ঘুরে প্রতিবেদনটি তৈরি করা হয়েছে। যথাযথ নজরদারীর মাধ্যমে সর্বমোট ৮৭৯ জন লোক এই গবেষণার জন্য পর্যবেক্ষণের আওতায়  ছিল। এর মধ্যে ২৯৪ জন গর্ভবতী নারী, ২৯২ জন ০ থেকে পাঁচ বছর বয়সী শিশুর মা, ২৯৩ জন কিশোর-কিশোরী ছিল। এদেরকে সংশ্লিষ্ট বিষয়ে ৫৫টি সাধারণ প্রশ্ন, ১৫টি গভীর সাক্ষাৎকার ও ৩০টি ফোকাস গ্রুপ আলোচনায় অংশগ্রহণ করানো হয়েছে। এসব কর্মকাণ্ডের ভিত্তিতে গবেষণার জন্য তথ্য সংগ্রহ করা হয়েছে।

গবেষণার ফলাফলে দেখা যায়, এলাকাগুলোর গর্ভবতী মায়েদের পুষ্টির অবস্থা জানার ক্ষেত্রে ওজন পরিমাপের প্রয়োজনীয় যন্ত্রপাতি আছে ৯০ শতাংশ। যার মধ্যে সচল ৭৬ দশমিক ৭ শতাংশ এবং ব্যবহার হচ্ছে ৫০ শতাংশ। এছাড়া উচ্চতা মাপার জন্য যন্ত্রপাতি আছে ৪৩ দশমিক ৩ শতাংশ, সচল ৩৩ দশমিক ৩ শতাংশ এবং ব্যবহার হচ্ছে মাত্র ৩ দশমিক ৩ শতাংশ।

এছাড়া শূন্য থেকে পাঁচ বছর বয়সী শিশুদের মায়েদের পুষ্টির অবস্থা জানার ক্ষেত্রে ওজন পরিমাপের প্রয়োজনীয় যন্ত্রপাতি আছে ৮৬ দশমিক ৭ শতাংশ, সচল ৭০ শতাংশ এবং ব্যবহৃত হচ্ছে ৩৩ দশমিক ৩ শতাংশ।  

আয়োডিন পরিমাপের জন্য বিদ্যমান যন্ত্রপাতি ২০ শতাংশ, সচল ১০ শতাংশ এবং যার কোনো ব্যবহার হচ্ছে না। উচ্চতা পরিমাপের জন্য যন্ত্রপাতি রয়েছে ৫০ শতাংশ, সচল ৩৬ দশমিক ৭ শতাংশ এবং ব্যবহার হচ্ছে মাত্র ৬ দশমিক ৭ শতাংশ।  

দৈর্ঘ্য মাপার জন্য আছে ২৩ দশমিক ৩ শতাংশ, সচল ১৬ দশমিক ৭ শতাংশ এবং কোনো ব্যবহার নেই। পুষ্টির মান নির্ধারণের জন্য বুকের দৈর্ঘ্য মাপার ফিতা ৫৩ দশমিক ৩ শতাংশ এবং ব্যবহার হচ্ছে ১০ ভাগ।  

এছাড়া শারীরিক বৃদ্ধি পরিমাপক কার্ড (জিএমপি) রয়েছে ৩৩ দশমিক ৩ শতাংশ মানুষের এবং ১০ শতাংশ মানুষ তা ব্যবহার করেন।

গবেষণায় দেখা যায়, এই প্রত্যন্ত অঞ্চলগুলোর উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সের তথ্য অনুসারে গর্ভবতী মায়েরদের জন্য সম্পূরক আয়রন, ফলিক এসিড ও ক্যালসিয়ামের গড় পরিমাণ যথাক্রমে ৭৩ দশমিক ৩ ও ৭৮ দশমিক ৬ শতাংশ এবং ইউনিয়ন সাব সেন্টার অনুসারে ৬০ ও ৫৭ দশমিক এক শতাংশ। এছাড়া উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্স অনুসারে সম্পূরক আয়রন, ফলিক এসিডের গড় পরিমাণ শূন্য থেকে পাঁচ বছর বয়সী শিশুদের ৪৬ দশমিক ৭ শতাংশ, শূন্য থেকে পাঁচ বছর বয়সী শিশুদের মায়েদের ৪৬ দশমিক ৭ শতাংশ এবং কিশোর-কিশোরীদের রয়েছে ৭৩ দশমিক ৩ শতাংশ। আর ইউনিয়ন সাব সেন্টারের তথ্য অনুসারে সম্পূরক ক্যালসিয়ামের গড় পরিমাণ শূন্য থেকে পাঁচ বছর বয়সী শিশুদের ৫৭ দশমিক ১ শতাংশ, শূন্য থেকে পাঁচ বছর বয়সী শিশুদের মায়েদের ৫৭ দশমিক ১ শতাংশ এবং কিশোর-কিশোরীদের রয়েছে ৭৮ দশমিক ৬ শতাংশ।

এদিকে উপজেলা স্বাস্থ্য কম্পলেক্সে ০-৫ বছর বয়সী শিশুদের জন্য খাবার স্যালাইন আছে ৬৬ দশমিক ৭ শতাংশ এবং ইউনিয়ন সাব-সেন্টারে ৫০ শতাংশ। উপজেলা স্বাস্থ্য কম্পলেক্সে ০-৫ বছর বয়সী শিশুদের সম্পূরক জিংক আছে ৪৬ দশমিক ৭ শতাংশ এবং ইউনিয়ন সাব-সেন্টারে ৩৫ দশমিক ৭ শতাংশ। ২-৫ বছর বয়সী শিশুদের জন্য প্রয়োজনীয় অ্যালবেনডাজল ওষুধ (ক্রিমির) উপজেলা স্বাস্থ্য কম্পলেক্সে আছে ১৩ দশমিক ৩ শতাংশ এবং ইউনিয়ন সাব-সেন্টারে ৩৫ দশমিক ৭ শতাংশ। আবার ২-৫ বছর বয়সী শিশুদের জন্য প্রয়োজনীয় অ্যালবেনডাজল (চুষে খাওয়ার ক্ষেত্রে) ওষুধ উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে আছে ২৬ দশমিক ০৭ শতাংশ এবং ইউনিয়ন সাব-সেন্টারে ৪২ দশমিক ৯ শতাংশ। কিশোর-কিশোরীদের প্রয়োজনীয় অ্যালবেনডাজল ওষুধ (ক্রিমির) উপজেলা স্বাস্থ্য কম্পলেক্সে আছে ৬ দশমিক ৭ শতাংশ এবং ইউনিয়ন সাব-সেন্টারে ৩৫ দশমিক ৭ শতাংশ। আবার কিশোর-কিশোরীদের অ্যালবেনডাজল (চুষে খাওয়ার ক্ষেত্রে) ওষুধ উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে আছে ১৩ দশমিক ৩ শতাংশ এবং ইউনিয়ন সাব-সেন্টারে ৩৫ দশমিক ৭ শতাংশ।

এ বিষয়ে বিএসএমএমইউ’র ইনফরমেটিকস বিভাগের সহকারী অধ্যাপক ডা. মো. খালেকুজ্জামান বাংলানিউজকে বলেন, ‘আমাদের উপস্থাপিত তথ্য উপাত্তের উপর ভিত্তি করে সরকার যদি প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ নেয় তাহলে এক্ষেত্রে সফলতা আসতে বাধ্য। ’

এলাকাগুলোতে বেসরকারি প্রতিষ্ঠানগুলোও ব্যাপক কর্মকাণ্ড পরিচালনা করছে। এক্ষেত্রে একটু গুরুত্বপূর্ণ দিক হলো সেখানে নারী কর্মীদের অনেক প্রয়োজন।

এছাড়া এ বিষয়ে রোববার (১১ নভেম্বর) বিএসএমএমইউ’তে একটি বৈজ্ঞানিক সেমিনার অনুষ্ঠিত হয়। সেমিনারে প্রধান অতিথির বক্তব্যে বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য অধ্যাপক ডা. কনক কান্তি বড়ুয়া বলেন, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিক্যাল বিশ্ববিদ্যালয়ের বর্তমান প্রশাসন চিকিৎসা শিক্ষা ও চিকিৎসাসেবার সঙ্গে সঙ্গে গবেষণা কার্যক্রমকেও অত্যন্ত গুরুত্ব দিচ্ছে। চিকিৎসা শিক্ষা, চিকিৎসাসেবা ও গবেষণায় বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিক্যাল বিশ্ববিদ্যালয়কে আন্তর্জাতিক মানে উন্নীত করতে বর্তমান প্রশাসনের নিরলস প্রচেষ্টা অব্যাহত রয়েছে।

উপাচার্য তার বক্তব্যে বাংলাদেশের দুর্গম এলাকায় পুষ্টিসেবার বর্তমান অবস্থার প্রকৃত চিত্র তুলে ধরায় বিশ্ববিদ্যালয়ের পাবলিক হেলথ অ্যান্ড ইনফরমেটিকস বিভাগের সংশ্লিষ্ট শিক্ষকসহ অন্যান্যদের ধন্যবাদ জানান।

বাংলাদেশ সময়: ০৬৩৫ ঘণ্টা, নভেম্বর ১২, ২০১৮
এমএএম/জিপি

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।