ঢাকা, সোমবার, ৮ পৌষ ১৪৩১, ২৩ ডিসেম্বর ২০২৪, ২০ জমাদিউস সানি ১৪৪৬

স্বাস্থ্য

আইবিএস চিকিৎসায় হোমিও সমাধান

| বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ১৫৩৬ ঘণ্টা, জুলাই ৬, ২০১৯
আইবিএস চিকিৎসায় হোমিও সমাধান

ঢাকা: আইবিএস হচ্ছে পেটের পীড়ার কয়েকটি উপসর্গ বা লক্ষণের সমষ্টি। এ রোগে পেট অধিকতর স্পর্শকাতর হয় বলে স্বাভাবিকের চেয়ে বেশি ক্রিয়াশীল হয়ে থাকে। 

পাশ্চাত্যে প্রতি ১০০ জনে অন্তত ১০-১৫ জন এ রোগে ভোগেন। এক সমীক্ষায় দেখা গেছে, বাংলাদেশে প্রতি ১০০ জন পুরুষের মধ্যে ২০ জন ও প্রতি ১০০ জন নারীর মধ্যে ২৭ জন এ রোগে আক্রান্ত।

এখন পর্যন্ত এ রোগের প্রকৃত কারণ জানা যায়নি। তবে এটা খাদ্যনালীর বা অন্ত্রের একটা রোগ।

এ রোগটি সাধারণত ২০ থেকে ৪০ বছর বয়সের মধ্যে মানবদেহে বাসা বাঁধে। নারী-পুরুষ সবার মধ্যে এ রোগ হয়ে থাকে।  

মোট জনসংখ্যার ২০ শতাংশ মানুষের মধ্যে এ রোগ নিরবে ছড়িয়ে পড়ে যা অধিকাংশ মানুষ টের পায় না। অর্থাৎ পরীক্ষা-নিরীক্ষার মাধ্যমে অপ্রমাণিত থেকে যায়। এক্ষেত্রে পুরুষের চেয়ে নারীরা অগ্রগামী। তবে শুধু প্রাপ্ত বয়স্কদের এ রোগ হবে, শিশু কিংবা কিশোরদের হবে না, এ কথা ঠিক নয়। এটি এমন একটি রোগ যা যেকোনো বয়সে হতে পারে।  

এক গবেষণায় দেখা যায়, আমেরিকায় প্রাপ্ত বয়স্কদের মধ্যে প্রতি পাঁচ/ছয়জনের একজনের দেহে এ রোগ ধরা পড়ে।

আইবিএস কি ?
আইবিএস হলো মানবদেহের একটি বিশৃঙ্খল অবস্থা যা পেটে ব্যথা (অ্যাবডোমিনাল পেইন) এবং ঘন ঘন পায়খানায় (টয়লেটে) ছুটে যাওয়ার ইচ্ছার মাধ্যমে প্রকাশ পায়। এটি একটি অধিকতর গুরুত্বপূর্ণ ইন্টেস্টাইন রোগ (ভাওয়েল ডিজিজ)। অধিকাংশ মানুষের মধ্যে এ রোগটির লক্ষণ অল্প অল্প দৃষ্টিগোচর হয়ে থাকে। এটির প্রাথমিক বৈশিষ্ট্য হলো গ্যাস্ট্রোইনটেস্টাইনাল বিশৃঙ্খলা। পেটের নিম্নভাগ হালকা ব্যথা (ডিসকম্পোর্ট) সহ ঘন ঘন মল (স্টুল) বের করে দেওয়ার প্রবণতা। বিভিন্ন সময়ে মলের পরিমাণ ও ঘনত্ব বিভিন্ন প্রকারের হয়ে থাকে। কখনো কোষ্টবদ্ধ (শক্তমল) আবার কখনো উদরাময় (নরম বা পানির মতো তরল মল)। অনেক সময় মল বের হওয়ার আগে কিংবা পরে যথেষ্ট পরিমাণ মিউকাস ক্ষরণ হয়ে থাকে।  

আইবিএসের প্রকারভেদ:
যে সমস্ত লক্ষণ খুব ঘন ঘন দেখা দেয়, তার ভিত্তিতে এ রোগটি নিম্নরূপে শ্রেণী বিভক্ত করা হয়।
১. স্প্যাস্টিক কোলন: পেটে ব্যথা এবং কোষ্টবদ্ধতা এটির প্রধান বৈশিষ্ট্য। সাধারণত পেটের বামপাশে অস্বস্তি থাকে এবং টয়লেট সেরে নেওয়ার পর কিছুটা শান্তি পাওয়া যায়। এক্ষেত্রে অনেক সময় কোষ্টবদ্ধতার পর উদরাময় দেখা যেতে পারে।
২. ফানসান্যাল ডায়রিয়া: ঘন ঘন উদরাময় হওয়ার প্রবণতা। তবে অধিকাংশ ক্ষেত্রে খুব ভোর বেলায় ঘুম থেকে জেগে ওঠার পরপরই পায়খানায় ছুটে যেতে হয়। মল পাতলা পানির মতো হতে পারে। এক্ষেত্রে রোগী দীর্ঘ সময় পর্যন্ত টয়লেটে যাতায়াত করে থাকে।
৩. ফোরগাট ডিসমোটিলিটি: পেটে প্রচণ্ড গ্যাস হওয়া এবং খাবার গ্রহণের পরে পেটে অস্বস্তিবোধ। প্রায়ই পেট ফেঁপে আকারে বড় হয়ে থাকে এবং ডানপাশে ব্যথা হয়।
 
আইবিএস কি কি কারণে হয়ে থাকে:
আধুনিক চিকিৎসা বিজ্ঞান এখনো এ রোগের প্রাইমারি বা প্রাথমিক কারণ খুঁজে পায়নি। তবে সেকেন্ডারি অনেক বিষয় এ রোগ জন্ম দেওয়ার ক্ষেত্রে অনেকাংশে দায়ী বলে গবেষণায় পাওয়া যায়। এক্ষেত্রে একটা বিষয় সাধারণ মানুষের জানা থাকা দরকার। সেটি হলো- মানবদেহের নার্ভ সিগন্যাল ও হরমোন ব্যবহারের মাধ্যমে ইন্টেস্টাইন ও ব্রেইনের মধ্যে গভীর সংযোগ বিদ্যমান। ওই সিগন্যালগুলো বাউয়েল ফানকসান ও লক্ষণসমূহকে প্রভাবিত করে। মানুষ যখন প্রচণ্ড মানসিক চাপে থাকে তখন নার্ভগুলো অত্যন্ত একটিভ বা কর্মদীপ্ত হয়ে যায়। ফলে ইন্টেস্টাইন বা অন্ত্রসমূহ সংবেদনশীল হয়ে পড়ে।  

এ রোগের উল্লেখযোগ্য সেকেন্ডারি কারণসমূহ উপস্থাপন করা হলো:
১. মানসিক চাপ 
২. বিভিন্ন খাদ্য হজম না হওয়া/এলার্জি 
৩. খাদ্যাভ্যাস হঠাৎ পরিবর্তন করা (অতিরিক্ত গরম কিংবা ঠাণ্ডা খাবার গ্রহণ) 
৪. অনিয়মিত খাদ্য সঠিক সময়ে গ্রহণ না করা
৫. দীর্ঘ সময় পেট খালি রাখা এবং গ্যাসে পরিপূর্ণ হওয়া
৬. পরিমিত ঘুম না হওয়া
৭. পর্যাপ্ত পানি পান না করা
৮. হঠাৎ বড় কোনো মানসিক আঘাত, ভয় বা শোক
৯. নার্ভাস সিস্টেমের দুর্বলতা 
১০. ভীষণ ক্রোধ এবং উদ্বেগ
১১. কোলন বা মলাশয়ের মধ্যে অস্বাভাবিক গাঁজন প্রক্রিয়া
১২. অতিরিক্ত অ্যালোপ্যাথিক ওষুধ ব্যবহার। যেমন- অ্যান্টিবায়োটিক, অ্যান্টিডিপ্রেসেন্ট (বিষন্নতার জন্য), সরবিটল (ফলজাত চিনি যা দিয়ে সিরাপ জাতীয় ওষুধ তৈরি হয়)
১৩. মাসিক ঋতু চলাকালীন হরমোনাল পরিবর্তন হওয়া 

আইবিএসের গুরুত্বপূর্ণ লক্ষণসমূহ:
এ রোগের লক্ষণসমূহ সব মানুষের ক্ষেত্রে একই হয় না। লক্ষণসমূহ ব্যক্তিভেদে ভিন্ন ভিন্ন হয়ে থাকে। কখনো হালকা আবার কখনো কঠিনভাবে প্রকাশ পায়। তবে অধিকাংশ মানুষের মধ্যে লক্ষণসমূহ খুবই হালকাভাবে প্রকাশিত হয়।  

নিম্নলিখিত লক্ষণগুলো যদি তিন মাস সময়ের মধ্যে প্রতি মাসে কমপক্ষে তিন দিন দেখা যায়, তাহলে চিকিৎসকরা আইবিএস বলে থাকেন।  

উল্লেখযোগ্য লক্ষণসমূহ নিম্নরূপ:
১. পেটে ব্যথা হওয়া ও টয়লেট সেরে নেওয়ার পর ব্যথা হ্রাস পাওয়া
২. প্রতিনিয়ত গ্যাস হওয়া এবং পেটের মধ্যে কলকল শব্দ হওয়া
৩. হজমের গোলোযোগ, কোষ্টবদ্ধতা ও পর্যায়ক্রমে উদরাময়
৪. পেট ফাঁপা, গলায় জ্বালা অনুভব ও বমি বমি ভাব
৫. ঘন ঘন মলদ্বার দিয়ে গ্যাস বের হওয়া কিংবা ঢেকুর তোলা 
৬. ঘন ঘন পাতলা মল কিংবা পানির মতো তরল উদরাময়
৭. পায়খানায় যাওয়ার বেগ সামলাতে না পারা এবং মলদ্বারে ব্যথা
৮. কোষ্টবদ্ধ অবস্থায় মলের বেগ না আসা কিংবা খুবই শক্তমল কষ্টে অল্প অল্প বের হওয়া
৯. ক্ষুধা মন্দা হওয়া বা মোটেই না থাকা। আবার কখনো অতিরিক্ত ক্ষুধা থাকা
১০. প্রতিবার মলত্যাগের আগে বা পরে এবং মলের সঙ্গে মিউকাস ক্ষরণ
১১. ওজন হ্রাস পাওয়া
১২. মানসিক বিশৃঙ্খলা (যেমন- খিটখিটে মেজাজ, উত্তেজনা, অবসাদ ও উদ্বিগ্নতা)
১৩. কখনো কখনো যৌন ক্ষমতা হ্রাস পাওয়া
১৪. প্রচণ্ড শারীরিক দুর্বলতা, মস্তিষ্ক ক্লান্তি ও কাজের প্রতি অমনোযোগিতা

প্যাথলজিক্যাল পরীক্ষা-নিরীক্ষা:
সত্যিকার অর্থে চিকিৎসা বিজ্ঞানে এখনো পর্যন্ত আইবিএসের নির্দিষ্ট কোনো প্যাথলজিক্যাল পরীক্ষা নেই। তবে উপরোক্ত লক্ষণসমূহ বিচার বিশ্লেষণ করে চিকিৎসক আইবিএস নির্ধারণ করেন।  

তাছাড়া পারিবারিক ইতিহাস, রোগীর বয়স ও উপরোক্ত লক্ষণগুলো বিবেচনার ভিত্তিতে নিম্নোক্ত পরীক্ষাসমূহের প্রয়োজন হয়ে থাকে:
১. ব্লাড টেস্ট (সিবিসি অর্থাৎ রক্ত কণিকা পরীক্ষা)
২. ফুড এলার্জি টেস্ট
৩. স্টুল ব্লাড ও কালচার টেস্ট (ইনফেকসান পরীক্ষা)
৪. কোলোনোস্কোপি (কোলন বা মলাশয়ের অবস্থা পরীক্ষা)
৫. অ্যান্ডোসকপি (পাকস্থলীর অবস্থা পরীক্ষা) ক্ষেত্র বিশেষে প্রয়োজন হতে পারে 
৬. এসজিওটি এবং এসজিপিটি (লিভার এনজাইম পরীক্ষা)
৭. থাইরয়েড টেস্ট (ক্ষেত্র বিশেষে প্রয়োজন হতে পারে) 

চিকিৎসক আইবিএস নির্ণয়ের পর যা বর্জনীয়:
১. মশলা ও ঝালযুক্ত খাবার
২. ফ্যাট বা চর্বিযুক্ত খাবার
৩. দুধ ও দুধ জাতীয় খাদ্য (টক দই ব্যতিত)
৪. গম ও গমের তৈরি খাদ্য (সাদা আটা, ময়দা)
৫. সাদা চিনি ও চিনি দিয়ে তৈরি খাদ্য
৬. সোডা ও সোডা দিয়ে তৈরি খাদ্য 
৭. দুধ চা ও কফি
৮. অনিয়মিত খাবার এবং একসঙ্গে বেশি খাবার
৯. অনিদ্রা বা অনিয়মিত নিদ্রা
১০. জাঙ্ক ফুড/প্রক্রিয়াজাত খাবার
১১. ঘন ঘন অ্যান্টিবায়োটিক, অ্যান্টিডিপ্রেসেন্ট ও সরবিটল গ্রহণ
১২. অতিরিক্ত তেল বা তেলে ভাজা খাবার
১৩. অ্যালকোহল/মদ্যপান 
১৪. কার্বোনেটেড ব্যাভারেজ ড্রিংকিং
১৫. শাক-সবজি (সবুজ পাতা শাক)
১৬. কিছু কিছু ফল যা হজম হয় না/এলার্জি (ব্যক্তিভেদে ভিন্ন ভিন্ন ফল)

হোমিওপ্যাথি এমন একটি চিকিৎসা ব্যবস্থা যা কখনো রোগের চিকিৎসা করে না, শুধুমাত্র রোগীর চিকিৎসা করে থাকে। দৈহিক ও মানসিক অবস্থায় ফিরে পায় এবং সম্পূর্ণ আরোগ্য লাভ করে। হোমিওপ্যাথি মানবদেহে সুষ্ঠুভাবে মেটাবলিজম বা রাসায়নিক পরিবর্তন ক্রিয়া সুসম্পন্ন করে। ফলে ডিজেনারেটিভ জটিলতা বাধাপ্রাপ্ত হয়।  

হোমিও সমাধান
রোগ নয়, রোগীকে চিকিৎসা করার ক্ষেত্রে অভিজ্ঞ চিকিৎসকরা যেসব মেডিসিন প্রাথমিকভাবে ব্যবহার করে থাকেন- মার্ক সল, মার্ক কর, আর্জেন্ট নাইট, অ্যাসেফোয়েটিডা, কলোসিন্থ, লিলিয়াম টাইগ্রিনাম, লাইকোপোডিয়ম, নেট্রাম কার্ব, নাক্সভম, পডোফাইলাম, সালফার, অ্যালোসকোট্রিনা, পালসেটিলা, ফসফরাস, সাইলেসিয়া, থুজাসহ আরো অনেক ওষুধ লক্ষণের জন্য দেওয়া হতে পারে।

লেখক
স্বাস্থ্য বিষয়ক উপদেষ্টা, হিউম্যান রাইটস রিভিউ সোসাইটি কেন্দ্রীয় কমিটি
কো-চেয়ারম্যান, হোমিওবিজ্ঞান গবেষণা ও প্রশিক্ষণ কেন্দ্র

বাংলাদেশ সময়: ১১৩৩ ঘণ্টা, জুলাই ০৬, ২০১৯
আরবি/

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।