ঢাকা, সোমবার, ৮ পৌষ ১৪৩১, ২৩ ডিসেম্বর ২০২৪, ২০ জমাদিউস সানি ১৪৪৬

স্বাস্থ্য

মশা নিধনের ওষুধ অকার্যকর, নতুন আনতে লাগবে ৪ মাস

মাসুদ আজীম, স্টাফ করেসপন্ডেন্ট | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ১১৪৩ ঘণ্টা, জুলাই ২৭, ২০১৯
মশা নিধনের ওষুধ অকার্যকর, নতুন আনতে লাগবে ৪ মাস মশা নিধনে ছিটানো হচ্ছে ওষুধ/ছবি: সংগৃহীত

ঢাকা: ঢাকার উত্তর ও দক্ষিণ সিটি করপোরেশন মশা মারতে যে ওষুধ ব্যবহার করছে তা অকার্যকর। আন্তর্জাতিক উদরাময় গবেষণা কেন্দ্র, বাংলাদেশের (আইসিডিডিআর,বি) গবেষণায় সেটি প্রমাণিত। এ কারণে রাজধানীসহ দেশের ছয়টি বিভাগে ডেঙ্গু মহামারি আকার ধারণে পথে। আর নতুন ওষুধ আনতে সময় লাগবে কমপক্ষে চার মাস।

এ পর্যন্ত ডেঙ্গুতে প্রায় ১০ হাজার মানুষ আক্রান্ত হলেও মশার ওষুধ পরিবর্তনে কার্যকরী নিচ্ছে না নগর কর্তৃপক্ষ। বরং, সেই অকার্যকর ওষুধেই মশা মারার ব্যর্থ চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে তারা।

ওষুধ কেনার সঙ্গে জড়িত সরকারি প্রতিষ্ঠানগুলোর কর্মকর্তারা বলছেন, এখনও কোনো প্রতিষ্ঠানের কাছেই প্রস্তাবিত কোনো ওষুধের নাম জানায়নি সংশি¬ষ্টরা। এ সপ্তাহেও যদি কোনো ওষুধের নাম এবং স্যাম্পল আসে, সেগুলো পরীক্ষা-নিরীক্ষা করে ওষুধ কিনতে কমপক্ষে চার মাস সময় লাগতে পারে। আর ততোদিনে ফুরিয়ে যাবে ডেঙ্গুর মৌসুম। এ রোগে আক্রান্ত হয়ে ভুগতে হবে অসংখ্য মানুষকে।

তবে স্বাস্থ্য সংশ্লি¬ষ্টরা বলছেন, তারা গত ১৫ জুলাই ঢাকার উত্তর সিটি করপোরেশনের উদ্যোগে ডেঙ্গু বিষয়ে একটি সভা করেছেন। সেই সভায় স্বাস্থ্যসেবা সংক্রান্ত একজন কার্যকর ‘মেলাথিউন’ ওষুধের নাম প্রস্তাব করেন। এ ওষুধটি মশা মারার জন্য সিটি করপোরেশন আগে ব্যবহার করেছে বলেও জানান তারা। তাই এটি আমদানি করতে বিভিন্ন মন্ত্রণালয় ও দপ্তর থেকে অনুমোদনের জন্য ফাইল চালাচালি করে সময়ক্ষেপণ করতে হবে না।

দেশে প্রচলিত ও বহুল ব্যবহৃত কীটনাশক প্রতিরোধী হয়ে উঠেছে সব ধরনের মশা। ফলে রাজধানীসহ সারাদেশে নিয়মিত মশার ওষুধ ছিটানো হলেও মশা মরছে না। এমন তথ্য উঠে এসছে আইসিডিডিআরবি’র এক গবেষণায়। সম্প্রতি ঢাকার দু’টি সিটি করপোরেশনের সঙ্গে স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের এক যৌথ বৈঠকে এ গবেষণাতথ্য উপস্থাপন করা হয়। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সেন্টার ফর ডিজিজ কন্ট্রোল- সিডিসির অর্থায়নে রাজধানী ঢাকা শহরে এ গবেষণা পরিচালিত হয়।  

সেপ্টেম্বর ২০১৭ ও ফেব্রুয়ারি ২০১৮ পর্যন্ত পরিচালিত এ গবেষণায় দেখা যায়, ডেঙ্গু ও চিকনগুনিয়া জিবাণুবাহী এডিস এবং কিউলিক্স মশা ইতোমধ্যে ওষুধ প্রতিরোধী হয়ে উঠেছে। গবেষণার সারাংশে বলা হয়, চারটি কীটনাশকের ক্ষেত্রে এডিসের প্রতিরোধী হয়ে ওঠার প্রমাণ পাওয়া গেছে। কিছু কিছু এলাকায় ডেল্টামেথ্রিন ও মেলাথিউন অংশিক প্রতিরোধী হওয়ার প্রমাণ মেলে। তবে ‘বিন্ডিওক্রাব’ ব্যবহারে মশার মৃত্যু শতভাগ নিশ্চিত করা সম্ভব হয়েছে। অর্থাৎ, মশা এখনও বিন্ডিওক্রাব প্রতিরোধী হয়ে ওঠেনি। অন্যদিকে কিউলিক্স মশার ক্ষেত্রে ‘প্রপোক্সার’ এর কার্যকরিতা শতভাগ প্রমাণিত।    

বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার নির্দেশনায় বলা হয়েছে, কীটনাশক ব্যবহারের পর একটি নির্দিষ্ট সময়ের মধ্যে মশার মৃত্যুর হার যদি ৯০ শতাংশের নিচে হয় তাহলে এটা নিশ্চিত যে মশা কীটনাশক প্রতিরোধী হয়ে উঠেছে। অথচ আইসিডিডিআরবি’র গবেষণায় দেখা যায় এডিস ও কিউলিক্স মশার মৃত্যুহার শূন্যের কোঠায়। এমনকী কীটনাশকের মাত্রা দ্বিগুণহারে প্রয়োগ করলেও মশার মৃত্যু ঘটেনি বলে জানান গবেষণা সংশি¬ষ্টরা।

এ বিষয়ে স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের পরিচালক (রোগ নিয়ন্ত্রণ) অধ্যাপক ডা. সানিয়া তাহমিনা বাংলানিউজকে বলেন, আইসিডিডিআর’বি একটি গবেষণা চালিয়েছে। সেখানে এডিস ও কিউলিক্স মশার কীটনাশক প্রতিরোধী হয়ে ওঠার চিত্র পাওয়া যায়। যেহেতু ওষুধ কেনা ও প্রয়োগ করা সিটি করপোরেশনের কাজ তাই এ বিষয়টিতে তাদের গুরুত্ব দিতে হবে। কীটনাশক চাইলেই পরিবর্তন করা যায় না। নতুন কীটনাশক নিবন্ধন করতে হলে অনেক সময়ের প্রয়োজন হয়। এক্ষেত্রে সিটি করপোরেশনের পক্ষ থেকে কোনো ধরনের কারিগরি সহয়তা চাওয়া হলে আমরা সহযোগিতা করবো।

কিন্তু এরপর প্রায় দুই সপ্তাহের বেশি পেরিয়ে গেলেও কোনো কার্যকর পদক্ষেপ নেয়নি সিটি করপোরেশন। সংশি¬ষ্টরা জানায়, মশা মারার ওষুধ কিনবে সিটি করপোরেশন। তারা যে ওষুধ কিনবে, তার স্যাম্পল প্রথমে কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের উদ্ভিদ সংরক্ষণ উইংয়ের কাছে পাঠাবে। এই বিভাগ ওষুধের টেকনিক্যাল টেস্ট করবে। অর্থাৎ ওই ওষুধে যে উপাদানের কথা বলা হয়েছে, তা সঠিক পরিমাণে আছে কিনা এবং যে প্রতিষ্ঠান ওষুধ সরবরাহ করছে, তাদের লাইসেন্স আছে কিনা তা পরীক্ষা করে সিটি করপোরেশনকে রিপোর্ট দেবে। এরপর সিটি করপোরেশন একই ওষুধের স্যাম্পল সরকারের রোগতত্ত্ব, রোগ নির্ণয় ও গবেষণা প্রতিষ্ঠানকে (আইইডিসিআর) পাঠাবে।

আইইডিসিআরের কর্মকর্তারা নমুনা পাওয়ার পর মশার ওপর প্রয়োগ করবেন। মশার ওপর ওই ওষুধ কতটুকু কার্যকর হলো, সে বিষয়ে রিপোর্ট দেবে। তারপর সিটি করপোরেশন ওষুধ সরবরাহের জন্য সংশি¬ষ্ট প্রতিষ্ঠানকে কার্যাদেশ দেবে। এরপর ওষুধ আনা হলে আরেক দফা পরীক্ষা করবে আইইডিসিআর। পরীক্ষায় মানোত্তীর্ণ হলে তবেই সেটি ব্যবহার শুরু করা হবে।

নতুন ওষুধ কেনা প্রসঙ্গে জানতে চাইলে স্বাস্থ্য অধিদপ্তর ও কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের একাধিক কর্মকর্তা জানান, ওষুধ কিনবে সিটি করপোরেশন। কিন্তু তাদের কোনো গরজ লক্ষ্য করা যাচ্ছে না। এক্ষেত্রে আমরা আমাদের সব সাপোর্ট নিয়ে বসে থাকলেও কোনো লাভ নেই।

এ বিষয়ে কৃষি সম্প্রসারণ অধিদফতরের মহাপরিচালক মীর নূরুল আলম বাংলানিউজকে বলেন, এ বিষয়ে আমি বিস্তারিতভাবে অবগত নই। তাই কোনো মন্তব্য করতে পারছি না।

ওষুধ কেনা প্রসঙ্গে জানতে চাইলে আইইডিসিআরের পরিচালক অধ্যাপক ডা. মীরজাদী সেব্রিনা ফ্লোরা বলেন, ওষুধ কিনবে সিটি করপোরেশন। আমাদের কাছে নমুনা আসবে উদ্ভিদ সংরক্ষণ উইংয়ের পরীক্ষার পর আমরা ওই স্যাম্পলের গুণগতমান পরীক্ষা করবো। অর্থাৎ, যে মশার ওপর প্রয়োগ হবে, সে মশা সংগ্রহ করে তার ওপর প্রয়োগ করা হবে। পূর্ণাঙ্গ মশা মরে কিনা ও মশার লার্ভা ধ্বংস হয় কিনা, সেটা পরীক্ষা করা হবে। আমাদের কাছে নমুনা আসলে পরীক্ষা করতে দুই-তিন দিন সময় লাগবে। কিন্তু মাঠপর্যায়ে প্রয়োগ করতে সময় লাগে।

ওদিকে, স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের হেলথ ইমার্জেন্সি অপারেশনস সেন্টার ও কন্ট্রোলরুমের সবশেষ তথ্য অনুযায়ী অতীতের সব রেকর্ড ছাড়িয়ে চলতি মাসের গত ২৬ দিনে ডেঙ্গুজ্বরে আক্রান্ত হয়ে হাসপাতালে ভর্তি হয়েছেন ৭ হাজার ৫১৩ জন। শুধু গত ২৪ ঘণ্টায় আক্রান্ত হয়েছে ৩৯০ জন। গত এক জানুয়ারি থেকে এ পর্যন্ত মোট ভর্তি হয়েছেন ৯ হাজার ৬৫৭ জন। যাদের মধ্যে ছাড়পত্র পেয়েছেন ৭ হাজার ৪০৭ জন। বর্তমানে ভর্তি রয়েছেন ২২৪২ জন। এ পর্যন্ত এ রোগে মৃত্যু ঘটেছে ৮ জনের। হাসপাতালে একদিনে সবচেয়ে বেশি রোগী ভর্তি হয়েছে বুধবার ৫৬০ জন।  

এদিকে রাজধানীর পাশপাশি ডেঙ্গু রোগ ছড়িয়ে পড়েছে দেশের ছয়টি বিভাগেও। হেলথ ইমার্জেন্সি অপারেশনস সেন্টার ও কন্ট্রোলরুমের সহকারী পরিচালক ডা. আয়েশা আক্তার জানান, এ পর্যন্ত চট্টগ্রাম বিভাগে ৭২ জন, খুলনা বিভাগে ৪৬ জন, বরিশাল বিভাগে ৩৫ জন আক্রান্ত হয়েছেন।

এদিকে দুই সিটি করপোরেশনের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, বৃহস্পতিবার পর্যন্ত মশার ওষুধের কোনো নাম পায়নি। নাম পেলে মশার ওষুধ কেনা সংক্রান্ত কমিটির পরামর্শ পাওয়ার পর সেসব পরামর্শ স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়কে পাঠাবে দুই সিটি করপোরেশন। এ ব্যাপারে স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় ইতিবাচক মতামত দিলে, সেটি বাস্তবায়ন করবে দুই সংস্থা।

দুই সিটি করপোরেশনের স্বাস্থ্য বিভাগের কর্মকর্তারা জানান, বিদ্যমান ওষধুগুলো আইসিডিডিআর’বি ঘোষিত অকার্যকর ওষুধ। নতুন ওষুধ কেনার আগপর্যন্ত এসব ওষুধ ব্যবহার করবে দুই সিটি করপোরেশন। এই মুহূর্তে কোনো বিকল্প না থাকায় সরকার সংশি¬ষ্ট ওষুধগুলোকে কার্যকর প্রমাণের চেষ্টা করে যাচ্ছেন। যদিও এখন পর্যন্ত কোনো পরীক্ষায় এ ওষুধ কার্যকর বা মানসম্পন্ন প্রমাণিত হয়নি।

এ প্রসঙ্গে ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশনের প্রধান স্বাস্থ্য কর্মকর্তা ব্রিগেডিয়ার জেনারেল ডা. মো. মোমিনুর রহমান মামুন বাংলানিউজকে বলেন, মশার উপদ্রব কমাতে কেনা ওষুধগুলোর মাত্রা বাড়িয়ে ব্যবহার করা হচ্ছে। বিকল্প হওয়ার আগ পর্যন্ত এ ওষুধই ব্যবহার করা হবে। কোন ওষুধ কেনা হবে, সেটা নির্ধারণ হয়েছে কী? এমন প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, এ সংক্রান্ত বিষয়ে সিদ্ধান্ত নিতে একটি কারিগরি কমিটি গঠন করা হয়েছে। ওই কমিটি এখনও সেটা নির্ধারণ করতে পেরেছে কিনা, সেটা আমি জানি না। দ্রুততম সময়ে অন্য কোনো কার্যকর পদক্ষেপ নেওয়া হচ্ছে কিনা- জানতে চাইলে তিনি বলেন, এই মুহূর্তে এমন কোনো তথ্য দিতে পারছি না, যদি কোনো সিদ্ধান্ত নেওয়া হয় তখন আপনারা জানতে পারবেন।

এ প্রসঙ্গে স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের পরিচালক (রোগ নিয়ন্ত্রণ) অধ্যাপক ডা. সানিয়া তাহমিনা বলেন, গত ১৫ জুলাই উত্তর সিটি কর্পোরেশনের উদ্যোগে একটি সভা অনুষ্ঠিত হয়। সেখানে ‘মেলাথিউন’ ওষুধের নাম প্রস্তাব করা হয়। কিন্তু সেই সভার কোনো রেজ্যুলেশন আমাকে পাঠানো হয়নি। তাছাড়া সভায় একটি টেকনিক্যাল কমিটিও গঠন করা হয়। কিন্তু তারপর আর কিছুই আমদের জানানো হয়নি।

তবে এ বিষয়ে ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের মেয়র মোহাম্মদ সাঈদ খোকন বাংলানিউজকে বলেন, কেনা ওষুধগুলো মানসম্মত নয় বলে যে অভিযোগ করা হচ্ছে সেটা সঠিক নয়। আমরা এই ওষুধ ব্যবহার করে দেখেছি মশা মরছে।  

তাহলে প্রতিদিন এতো মানুষ কীভাবে ডেঙ্গু আক্রান্ত হচ্ছে জানতে চাইলে তিনি বলেন, প্রতি বছর এই মৌসুমে মশার উপদ্রব বাড়ে। সে ব্যাপারে আমাদের প্রস্তুতিও থাকে। এবারও ছিল, আমরা চেষ্টা করে যাচ্ছি। আশা করছি দ্রুততম সময়ে ডেঙ্গু পরিস্থিতির উন্নতি হবে। তবে এ ব্যাপারে পরিস্থিতি যতটা না, কোনো কোনো গণমাধ্যম তার চেয়ে বাড়িয়ে প্রচার করছে। এ কারণে জনগণ আতঙ্কিত হয়ে পড়ছে।  

নতুন ওষুধ কেনার কোনো সিদ্ধান্ত হয়েছে কিনা জানতে চাইলে সাঈদ খোকন বলেন, রাজধানীর মশার যেহেতু প্রতিরোধ ক্ষমতা বেড়েছে, সে কারণে কোন ওষুধ ব্যবহার করলে ভাল হবে, সেটা টেকনিক্যাল কমিটিকে যাচাই-বাছাই করে দেখতে বলা হয়েছে। এছাড়া এ ব্যাপারে স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়েরও সহায়তা চাওয়া হয়েছে। আশাকরি দ্রুততম সময়ে আমরা নতুন ওষুধ কেনার সিদ্ধান্ত নিতে পারবো।

বাংলাদেশ সময়: ০৭৪২ ঘণ্টা, জুলাই ২৬, ২০১৯
এমএএম/এএ

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।