ঢাকা, সোমবার, ৮ পৌষ ১৪৩১, ২৩ ডিসেম্বর ২০২৪, ২০ জমাদিউস সানি ১৪৪৬

স্বাস্থ্য

এক বছরের কাজ ১৭ দিনে শেষ, লুট কয়েক কোটি টাকা 

মাসুদ আজীম, স্টাফ করেসপন্ডেন্ট | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ১৩২৭ ঘণ্টা, নভেম্বর ২৯, ২০১৯
এক বছরের কাজ ১৭ দিনে শেষ, লুট কয়েক কোটি টাকা 

স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের স্বাস্থ্য শিক্ষা ব্যুরোতে গত অর্থবছরে (২০১৮-১৯) ছয়টি গণসচেতনতামূলক প্রচারণা সার্ভিস প্যাকেজ ছিল, যেগুলোর মাধ্যমে দেশব্যাপী মানুষদের স্বাস্থ্য বিষয়ে সচেতন করার কথা। কিন্তু সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা গত ১৩ জুন এসব প্যাকেজের কার্যাদেশ দেন ও ৩০ জুনের মধ্যে সংশ্লিষ্টদের কাজ শেষ করার নির্দেশ দেন। অর্থাৎ এক্ষেত্রে মাত্র ১৭ দিনের মধ্যে এক বছরের কাজ সম্পন্ন হয়েছে। এভাবে এই প্রক্রিয়ার মাধ্যমে হাতিয়ে নেওয়া হয়েছে কয়েক কোটি টাকা। আর এই কাজটি করেছেন স্বাস্থ্য শিক্ষা ব্যুরোর ডেপুটি চিফ ও প্রোগ্রাম ম্যানেজার মো. নাছির উদ্দিন।

ঢাকা ও ঢাকার বাইরের কয়েকজন বিভাগীয় স্বাস্থ্য কর্মকর্তা বাংলানিউজকে বলেন, এই কাজগুলো মূলত এনজিও’র মাধ্যমে করার কথা। ছয়টি প্যাকেজের একটি ছিল ব্রেস্ট ক্যান্সার সচেতনতামূলক কর্মসূচি।

এর মাধ্যমে বিভাগীয় ও জেলা পর্যায়ে সচেতনতামূলক অনুষ্ঠান ও আলোচনা সভা করা, এরপর বিভাগীয়/জেলা স্বাস্থ্য কর্মকর্তার কাছ থেকে সনদ নেওয়ার কথা। কিন্তু এসবের কিছুই হয়নি। এর মাধ্যমে হাতিয়ে নেওয়া হয়েছে কয়েক কোটি টাকা।

অনুসন্ধানে জানা গেছে, শৃংখলাভঙ্গের অপরাধে স্বাস্থ্য অধিপ্তরের স্বাস্থ্য শিক্ষা ব্যুরোর সাবেক সহকারী প্রধান মো. নাছির উদ্দিনের বিরুদ্ধে ২০১৫ সালের সেপ্টেম্বরে বিভাগীয় মামলা দায়ের করা হয়। তার বিরুদ্ধে আনা অভিযোগগুলো প্রমাণিত হলে শাস্তি হিসেবে বেতন দুই ধাপ অবনমিত করে সর্বনিন্ম ধাপে নির্ধারণ করা হয়। কিন্তু এই আদেশ না মেনে তিনি আগের হারেই বেতন তুলতে থাকেন। পরবর্তীকালে বিষয়টি কর্তৃপক্ষের নজরে আসলে ২০১৬ সালের ২২ জুন মাসে মন্ত্রণালয় থেকে তার শাস্তি নিশ্চিত এবং অতিরিক্ত গৃহীত বেতনভাতা আদায় করতে নির্দেশ দেওয়া হয়। একইসঙ্গে বিধি ভঙ্গ করে স্বাস্থ্য শিক্ষা ব্যুরোতে অনুপ্রবেশ করায় সরকারি চাকরিতে যোগদানের তারিখ থেকে দুই বছরের জুনিয়র বিবেচ্য এবং দণ্ডপ্রাপ্ত কর্মকর্তা হিসেবে পদোন্নতির অযোগ্য বলে বিবেচ্য হবেন বলেও আদেশ দেওয়া হয়।

কিন্তু এত কিছুর পরেও মো. নাছির উদ্দিন ২০১৯ সালের মে মাসে স্বাস্থ্য শিক্ষা ব্যুরোর ডেপুটি চিফ ও প্রোগ্রাম ম্যানেজার হিসেবে পদায়ন নিয়ে এসেছেন। দায়িত্ব গ্রহণের পর থেকেই তিনি আগের মতো নানা অনিয়মে জড়িয়ে পড়েন। এমনকি এই পদের দায়িত্বপ্রাপ্তদের জন্য ব্যক্তিগত গাড়ির বরাদ্দ না থাকলেও তিনি ব্যবহার করছেন দু’টি পাজেরো।

এই কর্মকর্তা কীভাবে আবার পদোন্নতি পেয়ে ফিরে আসলেন জানতে চাইলে স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের মহাপরিচালক অধ্যাপক ডা. আবুল কালাম আজাদ বাংলানিউজকে বলেন, এ বিষয়ে আমার জানা নেই। মন্ত্রণালয় থেকে আদেশ করা হয়েছে।

অনুসন্ধানে জানা যায়, উল্লেখিত কর্মকর্তা স্বাস্থ্য শিক্ষা ব্যুরোর ১৯৯৫ সালের নিয়োগবিধির বহির্ভূত ও অনুপ্রবেশকারী। স্বাস্থ্য শিক্ষা ব্যুরোর নিয়োগ বিধিমালায় সুস্পষ্ট উল্লেখ রয়েছে, হেলথ এডুকেটর পদে সরাসরি নিয়োগপ্রাপ্ত কর্মচারীরা ১০ বছর চাকরিপূর্তি সাপেক্ষে ৬০ ভাগ পদোন্নতির মাধ্যমে ও ৪০ ভাগ পিএসসির মাধ্যমে সরাসরি নিয়োগে জুনিয়র স্বাস্থ্য শিক্ষা কর্মকর্তা পদে পদোন্নতি পাবেন। একই ভাবে ৬০ ভাগ জুনিয়র স্বাস্থ্য শিক্ষা কর্মকর্তা পদোন্নতির মাধ্যমে ও ৪০ ভাগ পিএসসির মাধ্যমে সরাসরি নিয়োগের মাধ্যমে সিনিয়র স্বাস্থ্য শিক্ষা কর্মকর্তা পদে নিয়োগপ্রাপ্ত হবেন।

কিন্তু মো. নাছির উদ্দিন কখনো হেলথ এডুকেটর বা পিএসসির মাধ্যমে সরাসরি নিয়োগ বিজ্ঞপ্তির মাধ্যমে নিয়োগ করা জুনিয়র স্বাস্থ্য শিক্ষা কর্মকর্তা ছিলেন না। ১৯৯৯ সালে এডিবি সাহায্যপুষ্ট দ্বিতীয় স্বাস্থ্য ও পরিবার পরিকল্পনা সেবা প্রকল্পের আওতায় (উন্নয়ন খাতে) স্বাস্থ্য শিক্ষা কর্মকর্তা ও সমাজ কল্যাণ কর্মকর্তা পদে নিয়োগপ্রাপ্ত হন তিনি। সমাজ কল্যাণ কর্মকর্তা ও স্বাস্থ্য শিক্ষা কর্মকর্তা কোনো সরকারি ফিডারভুক্ত পদ নয়।

অনুসন্ধানে আরও জানা যায়, মো. নাছির উদ্দিনকে ২০০৬ সালের ১৬ জুন স্বাস্থ্য অধিদফতরে মূলে সরাসরি নিয়োগযোগ্য গবেষণা কর্মকর্তা পদে (নিজ বেতনে) পদায়ন করা হয়, যা স্বাস্থ্য শিক্ষা ব্যুরোর নিয়োগ বিধিমালার পরিপন্থি বলে তৎকালীন প্রধান ২০০৭ সালের ১০ আগস্ট স্বাস্থ্য শিক্ষা ব্যুরো তাকে পূর্বপদে বদলির প্রস্তাব করে এবং নিয়োগবিধি বহির্ভূত স্থায়ীকরণের আদেশ বাতিলের জন্য ২০০৮ সালের ২৮ ডিসেম্বর দু’টি পৃথক চিঠি মহাপরিচালক বরাবর পাঠায়। তাছাড়া স্বাস্থ্য শিক্ষা ব্যুরোর নিয়োগবিধির কোন শর্ত পূরণ না করায় উন্নয়ন খাত/প্রকল্প থেকে অনুপ্রবেশকারী মো. নাছির উদ্দিনকে স্বাস্থ্য শিক্ষা ব্যুরো থেকে অপসারণের জন্য মহাপরিচালক বরাবর তৎকালীন স্বাস্থ্য শিক্ষা ব্যুরোতে কর্মরত কর্মকর্তারা অভিযোগপত্র দাখিল করেন।

সম্প্রতি দুদকের অনুসন্ধানে আজিমপুর মাতৃসদন ও শিশুস্বাস্থ্য প্রশিক্ষণ প্রতিষ্ঠানের তত্ত্বাবধায়ক ও টেন্ডার-সংক্রান্ত দরপত্র মূল্যায়ন কমিটির সভাপতি ডা. ইশরাত জাহান ছাড়াও ১২ জনের সংশ্নিষ্টতা পাওয়া যায়। সেখানে ঢাকা জেলা সিভিল সার্জন কার্যালয়ের সিনিয়র স্বাস্থ্য শিক্ষা কর্মকর্তা মো. নাছির উদ্দিনের নামও উঠে আসে।

এদিকে নাছির উদ্দিনের অপকর্মে অতিষ্ট হয়ে তার নামে একাধিকবার স্বাস্থ্য অধিদপ্তরসহ মন্ত্রণালয়ে যথাযথ কর্তৃপক্ষের কাছে অভিযোগ করা হয়। ২০১৫ সালে তার বিরুদ্ধে মন্ত্রণালয়ের এক সচিবের সই করা অভিযোগনামায় বলা হয়েছিল, অফিসের কর্মকর্তা-কর্মচারীদের সঙ্গে তিনি প্রায়ই উদ্দেশ্যপ্রণোদিতভাবে দুর্ব্যহার, অশালীন ও ঔদ্ধত্যপূর্ণ আচরণ করতেন। এমনকি প্রকাশ্যে ভয়ভীতি প্রদর্শন করেছেন। অফিসের সব কর্মকর্তা-কর্মচারী তার যন্ত্রণায় অতিষ্ট। তাছাড়া বহিরাগত বা সন্ত্রাসী এনে অফিসে হুমকি-ধামকি দেওয়ার একাধিক অভিযোগও রয়েছে তার বিরুদ্ধে।

এরপর ২০১৫ সালের ২৭ মে নাছির উদ্দিনকে নেত্রকোনার সিনিয়র স্বাস্থ্য কর্মকর্তা হিসেবে বদলি করা হয়। কিন্তু তিনি সেখানে না গিয়ে স্বাস্থ্য অধিদপ্তরে থেকেই দূর্নীতির কার্যক্রম চালাতে থাকেন। এসময় তাকে অফিস কক্ষ ও ব্যবহার্য মালামাল দপ্তরের স্টোর অ্যান্ড সাপ্লাই অফিসের কাছে বুঝিয়ে দেওয়ার নির্দেশ দিলেও তিনি তা অগ্রাহ্য করে একই স্থানে অবস্থান করেন।

এছাড়া ২০১৪ সালে কক্সবাজারে দায়িত্বে থাকা অবস্থায় নাছির উদ্দিনের বিরুদ্ধে বেসরকারি প্রতিষ্ঠান ‘পরিপ্রেক্ষিত’ অভিযোগ করে। সেবার ‘মাদকাসক্ত ও মানসিক রোগ প্রতিরোধ’ শীর্ষক প্রচারাভিযানের দায়িত্বে থাকা ওই প্রতিষ্ঠানের কাছে তিনি নারী সরবরাহের মতো অশালীন প্রস্তাব দেন বলে অভিযোগ রয়েছে। সেখানে তিনি মদ্যপ ও অসংযত অবস্থায় মহেশখালীতে চলমান কর্মশালায় উপস্থিত হয়ে অন্যদের সঙ্গে বাকবিতণ্ডায় জড়িয়ে পড়লে উপস্থিত সাংবাদিকরা তাকে ঢাকায় পাঠানোর ব্যবস্থা করেন।

এ বিষয়ে তদন্ত কমিটি গঠন করা হলে নাছির উদ্দিন বহিরাগত সন্ত্রাসীদের নিয়ে কমিটির সভাস্থল স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের যুগ্মসচিবের (আইন) অফিসকক্ষ ও কক্সবাজার জেলার সিভিল সার্জনের কার্যালয়ে আক্রমণ করেন এবং মারধরের চেষ্টা করলে অন্য কর্মকর্তাদের বাধায় সেখান থেকে চলে আসেন। তবে পরে আবার সরকারি অফিসের বাইরে ওইসব কর্মকর্তাদের হয়রানি ও হুমকি দেন। এসব অভিযোগের অনুলিপি বাংলানিউজের হাতে রয়েছে।

অভিযোগ প্রসঙ্গে জানতে চাইলে মো. নাছির উদ্দিন বাংলানিউজকে বলেন, আমার শাস্তি হয়েছিল ভুয়া রিপোর্টের ভিত্তিতে। তাছাড়া শাস্তির সময় ইতোমধ্যে শেষ। আমি এখানে পদোন্নতি নিয়ে আসিনি, চলতি দায়িত্বে এসেছি।  

চাকরির বিষয়ে তিনি বলেন, কাগজপত্রে কোনো জালিয়াতি হয়নি। প্রকল্প থেকে পিএসসির মাধ্যমে রাজস্ব খাতে এসেছি।  

সাম্প্রতিক দুর্নীতির অভিযোগ প্রসঙ্গে স্বাস্থ্য শিক্ষা ব্যুরোর ডেপুটি চিফ ও প্রোগ্রাম ম্যানেজার নাছির উদ্দিন বলেন, বহিরাগত সদস্য হিসেবে কমিটির একটি সভায় গিয়েছিলাম ও সই করেছি। এর বেশি কিছু জানি না।  

সামগ্রিক বিষয়ে স্বাস্থ্য ও পরিবার কল্যাণ মন্ত্রণালয়ের স্বাস্থ্য সেবা বিভাগের অতিরিক্ত সচিব (প্রশাসন) মো. হাবিবুর রহমান বাংলানিউজকে বলেন, ওই কর্মচারীর বিষয়ে অবগত হয়েছি প্রায় দেড় মাস আগে। সেই সময়ই সংশ্লিষ্টদের প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নিতে নির্দেশ দিয়েছি।

বাংলাদেশ সময়: ০৮২২ ঘণ্টা, নভেম্বর ২৯, ২০১৯
এমএএম/একে

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।