ঢাকা, সোমবার, ৮ পৌষ ১৪৩১, ২৩ ডিসেম্বর ২০২৪, ২০ জমাদিউস সানি ১৪৪৬

স্বাস্থ্য

এমবিবিএস পাস না করেও সকল রোগের চিকিৎসক!

সিনিয়র করেসপন্ডেন্ট | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ২২০১ ঘণ্টা, জানুয়ারি ১৬, ২০২০
এমবিবিএস পাস না করেও সকল রোগের চিকিৎসক!

রাজশাহী: ব্যবস্থাপত্রে বড় বড় ডিগ্রি, এমবিবিএস পাস না করেও তারা সকল রোগের চিকিৎসক। এমনকি করছেন অস্ত্রোপচারও। অথচ তারা পল্লী চিকিৎসক।

আরএমপি (রুরাল মেডিক্যাল প্র্যাকটিশনার) কোর্স করেই এমবিবিএস চিকিৎসকের মতোই করছেন জটিল সব রোগের চিকিৎসা। ডিজিটাল ব্যানার ও চটকদার বিজ্ঞাপন দিয়ে নিজের নামে ভিজিটিং কার্ড ও প্যাড ছাপিয়ে আইন অমান্য করছেন।



নামের আগে পদবি লিখছেন ‘ডাক্তার’। তাদের ভুল চিকিৎসা, মাত্রাতিরিক্ত ওষুধের প্রেসক্রিপশনের কারণে হরহামেশাই মারাত্মক স্বাস্থ্যঝুঁকিতে পড়তে হচ্ছে সাধারণ রোগীদের।  ডাক্তার রূপধারী এই পল্লী চিকিৎসকদের ওপর প্রশাসনের নজর বা নিয়ন্ত্রণ কোনোটাই নেই। একারণে প্রতিনিয়ত প্রতারিত হচ্ছেন সেবা নিতে আসা শহর ও গ্রামের অসংখ্য মানুষ।

জানা যায়, আরএমপি, ডিএমএফ ও এলএমএএফ কোর্স করে নামের আগে ‘ডাক্তার’ লিখে রোগী দেখলেও এই পল্লী চিকিৎসকদের রোগী দেখার আইনগত অনুমোদন বা যোগ্যতা কোনোটাই নেই। এই চিকিৎসকদের অনেকেই ন্যূনতম এসএসসিও পাস করেননি।

সাধারণ রোগীদের প্রাথমিক স্বাস্থ্য পরামর্শ প্রদান এবং জটিল-স্পর্শকাতর রোগীদের বিশেষায়িত সরকারি  হাসপাতাল বা বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকদের কাছে প্রেরণের নিয়ম। অথচ তারা করছেন ঠিক এর উল্টো। চিকিৎসার নামে সাধারণ-জটিল সকল রোগের অপচিকিৎসা দিয়ে চলেছেন তারা। অসহায় রোগীদের তারা ব্যবহার করছেন ‘গিনিপিগের’ মতো।

খোঁজ নিয়ে জানা যায়, রাজশাহীতে ডাক্কার রূপধারী পল্লী চিকিৎসকদের দৌরাত্ম্য দিনকে দিন বেড়েই চলেছে। রাজশাহী মহানগরের তুলনায় গ্রাম-গঞ্জে ও উপজেলা শহর এলাকায় এদের দৌরাত্ম্য তুলনামূলকভাবে বেশি। চটকদার সাইন বোর্ড টাঙ্গিয়ে নিজেদের নামের আগে ‘ডাক্তার’ উপাধি আর ‘ডিপ্লোমা, প্যারামেডিক, এলএমএএফ, ডিএইসএস, শিশু বিশেষজ্ঞ, কমিউনিটি মেডিকেল অফিসার’—এর মতো নামে ভারী শব্দ লাগিয়ে দেদারছে অপ-‘চিকিৎসা-বাণিজ্য’ চালাচ্ছেন এরা। চেম্বার খুলে সাইনবোর্ডে নামের সঙ্গে ‘ডাক্তার’ উপাধি ও ডিগ্রির বহর যোগ করে এভাবেই প্রতারণা করে যাচ্ছেন।

গ্রামাঞ্চলে চিকিৎসক সংকট থাকায় এবং মানুষের সচেতনতার অভাবকে পুঁজি করে বছরের পর রোগী দেখে যাচ্ছেন তারা। রোগমুক্তি তো দূরের কথা, এসব ভুয়া চিকিৎসকের ওষুধ খেয়ে নানান জটিলতায় ভুগছেন হাজারো রোগী।  

এছাড়া মাঝেমধ্যেই তাদের ভুল চিকিৎসার কারণে রোগী মারা যাওয়া মতো ঘটনাও ঘটছে। আবার অ্যান্টিবায়োটিক ওষুধের যথেচ্ছ ব্যবহারের কারণে রোগকে আরো জটিল থেকে জটিলতর পর্যায়ে নিয়ে নিরাময়-অসম্ভব করে ফেলছেন।

নিজের চেম্বার খোলার পাশাপাশি এসব পল্লী চিকিৎসক ওষুধও বিক্রি করছেন। নিজেই ডাক্তার, নিজেই আবার ওষুধবিক্রেতা। একারণে রোগীদের মাত্রাতিরিক্ত ওষুধের প্রেসক্রাইবও করছেন দেদারসে। নিজেদের আর্থিকভাবে প্রতিষ্ঠিত করতে গ্রামের অশিক্ষিত-অল্প শিক্ষিত তথা গরিব মানুষদের আর্থিকভাবে সর্বস্বান্ত করে ফেলছেন এরা।

বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকেরা বলছেন, পল্লী চিকিৎসকের কাছে ভুল চিকিৎসার কারণে রোগীরা মারাত্মক স্বাস্থ্যঝুঁকিতে পড়ছেন। রোগের প্রাথমিক অবস্থায় তারা উচ্চমাত্রার অ্যান্টিবায়োটিক দিয়ে দিচ্ছেন। সামান্য অসুখেও তারা উচ্চমাত্রার অ্যান্টিবায়োটিক সেবনের পরামর্শ দিচ্ছেন। অ্যান্টিবায়োটিকের যথেচ্ছ ব্যবহারের কারণে রোগ-প্রতিরোধ ক্ষমতা নষ্ট হয়ে রোগীরা আক্রান্ত হচ্ছেন জটিল রোগে। ফলে রোগ নিরাময়ে সময় বেশি লাগছে।

অনেক রোগী রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতাও হারিয়ে ফেলছেন। এতে পরবর্তী সময়ে একদিকে অ্যান্টিবায়োটিক কাজ করছেন না, অন্যদিকে রোগীর খরচও বাড়ছে। এসব রোগীর রোগ নির্ণয়েও অনেক সময় হিমশিম খেতে হচ্ছে বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকদের।

সরেজমিনে দেখা যায়, রাজশাহী শহর ও আশপাশের গ্রাম-গঞ্জে শত শত লাইসেন্সবিহীন  ডাক্তার নামধারী চেম্বার খুলে জাঁকিয়ে বসেছেন।

রাজশাহীর বাগমারা উপজেলার শিবজাইট বাজারের সার ব্যবসায়ী ভু্ক্তভোগী ইমরান আলী জানান, তার দুই বছরের শিশুর শরীরে ফোঁড়া হয়েছিল। পরে তিনি স্থানীয় পল্লী চিকিৎসক শাহিনুরের কাছে যান। এ সময় তার ছেলেকে ভালো করার জন্য ইনজেকশন দেওয়া হয়। কিন্তু ভালো হওয়ার বদলে সেখানে ইনফেকশন হয়ে পচন ধরে।  

পরে তাকে রাজশাহী মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে নিয়ে চিকিৎসা করানো হয়। চিকিৎসক তাকে বলেছেন ভুল চিকিৎসার কারণে তার ছেলের এই অবস্থা হয়েছে। পরে তাকে পুরোপুরি সুস্থ করতে প্রায় ৩০ হাজার টাকা খরচ হয়েছে ওই ব্যবসায়ীর।    

গত বছরের ৭ আগস্ট রাজশাহীর মোহনপুর উপজেলার মেলান্দি গ্রামে পল্লী চিকিৎসকের ভুল চিকিৎসায় প্রত্যাশা নামের এক শিশুর মৃত্যুর অভিযোগ ওঠে। প্রত্যাশার পেটে তীব্র ব্যথা হওয়ায় তাকে স্থানীয় পল্লী চিকিৎসক গিয়াস উদ্দিনের কাছে নিয়ে যাওয়া হয়। তিনি কোনো প্রকার পরীক্ষানিরীক্ষা ছাড়াই প্রত্যাশাকে একটি সিরাপ পান করান। এতে তার অবস্থার অবনতি হয় এবং হাসপাতালে নিয়ে যাওয়ার পথেই তার মৃত্যু হয়।

এর আগে, ২০১৭ সালে রাজশাহীর পুঠিয়া উপজেলার একটি বেসরকারি ক্লিনিকে ভুল অস্ত্রোপচারের কারণে সিজারিয়ান অপারেশনের সময় প্রসূতিসহ নবজাতকের মৃত্যু হয়। অস্ত্রোপচারটি করেছিলেন মো. জাহাঙ্গীর আলম নামের একজন ভুয়া চিকিৎসক। তখন আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীর তদন্তে উঠে আসে, জাহাঙ্গীর আলম আগে একটি ওষুধের দোকানে চাকরি করতেন। তিনি নিজেই রোগীর প্রেসক্রিপশন লিখতেন। তারপর একটি বেসরকারি ক্লিনিকে ডাক্তারের সহযোগী হিসেবে কাজ করেন।  কিছুদিন পরেই তিনি নিজেকে এমবিবিএস ডাক্তার পরিচয় দিয়ে চিকিৎসা শুরু করেন।

এদিকে, রাজশাহীর বাগমারা উপজেলার শিবজাইট বাজার এলাকার দেখা যায়, সেখানে একটি দোকানে লেখা ‘শিবজাইট প্রেসক্রিপশন পয়েন্ট’।  স্বত্ত্বাধিকারীর নাম ডা. মো. শহিনুর ইসলাম। প্রেসক্রিপশনে লিখা- বিএসসি, এমপিএইচ, আরএমপি (ঢাকা), শিশুদের ওপর বিশেষ প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত (আইএমসিআই)। তার দোকানের সাইনবোর্ডে উল্লেখ করা হয়েছে- ‘এখানে সকল প্রকার রোগের প্রাথমিক চিকিৎসা করা হয়’। এমবিবিএস ডিগ্রি না থাকলেও তিনি নামের আগে ‘ডাক্তার’ লিখেছেন আবার সকল রোগের চিকিৎসাও তিনি করে চলেছেন।

তবে এসব প্রশ্নে শহিনুর ইসলাম তার নামের আগে ডাক্তার লেখার বিষয়টি সরাসরি এড়িয়ে যান। কথা বলেননি অন্য বিষয়গুলো নিয়েও। কেবল জানান, চার বছরের কোর্স করার পর সব নিয়ম মেনেই তিনি রোগী দেখেন। বিষয়টি উপজেলা স্বাস্থ কর্মকর্তারাও জানেন বলে দাবি করেন শহিনুর ইসলাম।    

রাজশাহীর বাগমারা উপজেলা স্বাস্থ্য কর্মকর্তা আনোয়ারুল কবির বলেন, আরএমপি কোর্স করেই পল্লী চিকিৎসকরা বিভিন্ন রোগের চিকিৎসা করছেন। এটি পুরোপুরি বন্ধ করা না হয় অথবা প্রেসক্রিপশনে তারা কি কি ঔষধ লিখতে পারবেন-এ ব্যাপারে যদি আইনগত কোনো নির্দেশনা থাকতো তবে আমরা ব্যবস্থা নিতে পারতাম। এ ধরনের সুনির্দিষ্ট কোনো নির্দেশনা নেই। এর ফলে আমরা কাউকে আইনের হাতে সোপর্দ করতেও পারছি না।

জানতে চাইলে রাজশাহীর সিভিল সার্জন ডা. এনামুল হক বলেন, ন্যূনতম এমবিবিএস বা বিডিএস ডিগ্রি প্রাপ্তগণ ব্যতীত কেউ নামের আগে ডাক্তার পদবি লিখতে পারবেন না। কিন্তু পল্লী চিকিৎসকরা নামের আগে ডাক্তার লিখছেন। আমরা এ ব্যাপারে অত্যন্ত কঠোর। বিভিন্ন সময়ে তাদের সাথে কথা বলে সতর্ক করা হয়েছে। তবে কেউ লিখলে আইনগত ব্যবস্থা নেওয়ার দায়িত্ব ভ্রাম্যমাণ আদালতের। এখানে আইনগত বিষয়ে ব্যবস্থা নেওয়ার এখতিয়ার তাদের হাতে নেই।

রাজশাহী বিভাগীয় স্বাস্থ্য পরিচালক গোপেন্দ্র নাথ আচার্য বলেন, ‘বিএমডিসি (বাংলাদেশ মেডিক্যাল অ্যান্ড ডেন্টাল কাউন্সিল) অ্যাক্ট অনুযায়ী কেবল এমবিবএস পাসকৃত চিকিৎসক ও ডেন্টাল সার্জনরা তাদের নামের আগে ডা. (ডাক্তার) লিখেতে পারবেন। কিন্তু আমাদের দেশে রুরাল মেডিক্যাল প্র্যাকটিশনার (আরএমপি), মেডিক্যাল অ্যাসিসটেন্ট ও ফার্মাসিস্টরা এমবিবিএস চিকিৎসকের মতোই করছেন জটিল সব রোগের চিকিৎসা। গ্রামে-গঞ্জে তো বটেই শহরের অলিগলিতেও এখন তাদের বিচরণ। এই চিত্র কেবল রাজশাহীর নয়, গোটা দেশেরই। কিন্তু এটি একটি শাস্তিযোগ্য অপরাধ। কিন্তু আইন থাকলেও তা বাস্তবায়নের সুনির্দিষ্ট নীতিমালা নেই।

‘এর সুযোগ নিয়ে এ ধরনের ব্যক্তিরা নিজেদের ডাক্তার বানিয়ে সর্বরোগের চিটকিৎসা করছেন। এটা এখন অনেকটাই ওপেন সিক্রেট হয়ে গেছে’।

তবে স্বাস্থ্যবিভাগ ও আইন প্রয়োগকারী সংস্থার সমন্বয়ে নিয়মিত মোবাইল কোর্ট পরিচালিত হলে এদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া যেতো। তাই তারা বিষয়টি নিয়ে ইতোমধ্যে কাজ শুরু করেছেন। আইনি জটিলতা কাটিয়ে অদূর ভবিষ্যতে তাদের বিরুদ্ধে অভিযান শুরু হবে বলেও উল্লেখ করেন বিভাগীয় স্বাস্থ্য পরিচালক।

রাজশাহীর অতিরিক্ত জেলা প্রশাসক (সার্বিক) মুহাম্মদ শরিফুল হক জানান, এ ধরনের অপচিকিৎসকদের বিষয়ে তারা অবগত রয়েছেন। কিন্তু জেলা প্রশাসনকে প্রতিদিন অনেকগুলো সরকারি কাজ সম্পাদন করতে হয়। এর বাইরে বিভিন্ন ইস্যুতে তাদের নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেটরা রোজই মোবাইল কোর্ট পরিচালনা করছেন’।  

এই বিষয়টি নিয়েও তারা এর আগে মোবাইল কোর্ট পরিচালনা করেছেন। তবে ‘জনস্বাস্থ্য’র বিষয়টি সবার আগে। তাই শিগগিরই এ ব্যাপারে বেশি বেশি মোবাইল কোর্ট পরিচালনা করা হবে। ‘বিএমডিসি অ্যাক্ট অনুযায়ী এমবিবিএস পাসকৃত চিকিৎসক ও ডেন্টাল সার্জন ছাড়া কাউকেই তাদের নামের আগে ডা. (ডাক্তার) লিখেতে দেওয়া হবে না। এছাড়া তাদের চিকিৎসা প্রদানের ক্ষেত্র যাচাই করে প্রয়োজনীয় আইনগত ব্যবস্থা নেওয়া হবে। কারণ এটা শাস্তিযোগ্য অপরাধ।  

বাংলাদেশ সময়: ১৬৫৮ ঘণ্টা, জানুয়ারি ১৬, ২০২০
এসএস/জেএম

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।