ঢাকা, বৃহস্পতিবার, ১১ পৌষ ১৪৩১, ২৬ ডিসেম্বর ২০২৪, ২৩ জমাদিউস সানি ১৪৪৬

স্বাস্থ্য

মৃত্যুপুরী থেকে বলছি....

স্টাফ করেসপন্ডেন্ট | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ১৬৪৬ ঘণ্টা, এপ্রিল ১৭, ২০২০
মৃত্যুপুরী থেকে বলছি....

বরিশাল: বরিশালে ধীরে ধীরে বাড়ছে করোনা আক্রান্তের সংখ্যা। এখন পর্যন্ত গোটা বরিশাল বিভাগের মধ্যে ভোলা ছাড়া বাকি ৫ জেলায় ৩০ জন রোগী শনাক্ত হয়েছে। যার মধ্যে বরিশালের মুলাদী, পটুয়াখালীর দুমকি ও বরগুনার আমতলীতে একজন করে তিনজন মারা গেছেন।

এখন আক্রান্তদের মধ্যে চিকিৎসক, নার্সসহ ৬ জন স্বাস্থ্যকর্মী ও একজন সাংবাদিকও রয়েছেন। তবে রোগী ও তাদের স্বজনরা করোনা উপসর্গ গোপন করার প্রবণতা দিন দিন বাড়ছে এ অঞ্চলে।

ফলে নতুন করে উৎকণ্ঠা ও শঙ্কার সৃষ্টি হয়েছে চিকিৎসাকর্মীদের মধ্যে। বরিশালের বাবুগঞ্জে ৫ চিকিৎসাকর্মীর করোনা শনাক্ত হওয়ার পর অনুসন্ধানে নামে স্বাস্থ্য বিভাগ। প্রাথমিকভাবে উপসর্গ গোপন রাখা মারামারিতে আহত এক রোগীর মাধ্যমে এটি ছড়িয়েছে বলে ধারণা করছে স্বাস্থ্য বিভাগ।  

অপরদিকে শেবাচিম হাসপাতালেও এরকম একটি ঘটনা ঘটেছে। যদিও এ ঘটনায় এখন পর্যন্ত উপসর্গ গোপন রাখা এক রোগীর করোনা শনাক্ত হয়েছে। শনাক্ত হওয়ার পর যে রোগীকে করোনা ওয়ার্ডে পাঠানো হয়েছে। হাসপাতালের মেডিসিন ওয়ার্ডের ইউনিট-৩ লকডাউন ঘোষণা করার পাশাপাশি ২৪ জন চিকিৎসক ও নার্সসহ সংশ্লিষ্টদের পাঠানো হয়েছে কোয়ারেন্টিনে। যদিও এ নিয়ে উৎকণ্ঠার শেষ নেই চিকিৎসকদের মধ্যে।  

বরিশাল শের-ই-বাংলা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালের সবশেষ ঘটনা নিয়ে বঙ্গবন্ধু ক্লাবের আহ্বায়ক ও ইন্টার্ন চিকিৎসক ডা. তরিকুল ইসলাম তার ফেসবুক পেজে লিখেছেন। পাশাপাশি উপসর্গ গোপন না করার বিষয়ে যেন সাধারণ মানুষকে আরো সচেতন করতে ভূমিকা রাখে গণমাধ্যম সেই কামনা করেন তিনি।  

তিনি বলেন, উপসর্গ গোপন করায় আজ হাসপাতালের মেডিসিনের একটি ইউনিট লকডাউন করা হয়েছে, এভাবে রোগীরা উপসর্গ গোপন করলে হয়তো বাকি ইউনিটগুলোও বন্ধ হয়ে যাবে। ফলে শুধু করোনার জন্য অন্য বহু রোগে আক্রান্ত হাজারো রোগী চিকিৎসা বঞ্চিত হবেন।  

সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ফেসবুকে শেবাচিম হাসপাতালের ঘটনা নিয়ে লেখা তার স্ট্যাটাসটি হুবহু তুলে ধরা হলো….

১৬/০৪/২০২০
১১.৪৩
মৃত্যুপুরী থেকে বলছি....
এই যে ছবিগুলো দেখছেন এগুলো গত ১২.০৪.২০২০ শের-ই-বাংলা মেডিকেল কলেজের মেডিসিন ইউনিট-০৩ থেকে তোলা, ওইদিন আমাদের অ্যাডমিশন ছিল, ডিউটিতে ছিলাম আমি আর আমার কয়েকজন ভাই-বোন সহযোদ্ধা (ইন্টার্ন চিকিৎসক)। হঠাৎ একটা ছেলে আসে, ওর বাবা অসুস্থ, আমরা যেন তাড়াতাড়ি ওর বাবাকে দেখতে যাই, ওকে দেখে কি মনে হইছিল জানেন? আমার বাবা আমাকে হাসপাতালের বেডে বসে ডাকছে, কারণ কিছুদিন আগে আমার বাবাও অসুস্থ ছিল, তাই ওর জায়গায় নিজেকে রেখে আমি আর আমার বন্ধু Sajjatul Islam Sagor দৌড় দিয়ে রোগীর কাছে গেলাম। রোগী দেখে ক্লিনিক্যাল পরীক্ষা-নিরীক্ষা করে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থাপত্র দিলাম। প্রথমে আমরা স্ট্রোক ধারণা করেছিলাম, কিন্তু পরবর্তীতে পরীক্ষা-নিরীক্ষা করে ইলেক্ট্রোলাইট-ইমব্যালেন্স (Hyponatremia) পাওয়া গেলো, রোগীর সাথে তার স্ত্রী এবং ছেলে ছিল। তারা একবারও বলেনি রোগীর জ্বর ছিল, অনেকবার জিজ্ঞাসা করার পরও!! রুটিন এক্সামিনেশনের অংশ হিসেবে তাকে X-Ray করাতে বলা হল, X- Ray রিপোর্ট দেখে চিকিৎসকদের মন হলো করোনা হতে পারে!!! সাসপেক্টেড কেস হিসেবে তাকে করোনা পরীক্ষা করানোর জন্য বলা হলো, তখন রোগী পার্টি স্বীকার করলো রোগীর জ্বর ছিল!! আজ রিপোর্ট আসল, করোনা পজেটিভ!!! কাল আমাদের পরীক্ষা করা হবে, জানি না কপালে আল্লাহ কি রাখছেন। দোয়া করবেন সবাই আমার জন্য। তাইলে এইবার যারা সারা দিন গলাবাজি করেন তাদের বলি, এই রোগী যে তথ্য গোপন করল,এর কী হবে???? আমি যদি ইনফেক্টেড হই আমার বাবা-মা পরিবার কে সেই ক্ষতি পূরণ কে দেবে?? 

আপনি বলবেন, 'বাবা তুমি মারা গেলে রাষ্ট্র তোমার পরিবারকে ১০ লাখ টাকা প্রণোদোনা দেবে!! ""আচ্ছা ওই টাকা আমি আপনাকে দেব, আপনি প্রস্তুত আপনার জীবন এভাবে বিলিয়ে দিতে??? এর থেকে গুরুত্বপূর্ণ বিষয় কি জানেন?? মাননীয় প্রধানমন্ত্রী বলেছেন সরকারি ডাক্তারদের কথা যারা সরাসরি করোনা চিকিৎসার সাথে জড়িত!! তাইলে আমি কি?? আমি তো ইনটার্ন চিকিৎসক। আমি কি সরকারি না বেসরকারি??? আর আমার কি করোনা রোগী রিসিভ করার কথা???

আচ্ছা, এরপর আসেন আমি PPE পরিহিত ছিলাম কিনা, হ্যাঁ ছিলাম। ওইটা কি PPE জানেন?? ব্যক্তিগতভাবে জোগাড় করা PPE, বলতে পারেন সরকারি PPE কই?? সাহস থাকলে আমার রুমে আইসেন, দেখে যাবেন সরকারি ppe কি অবস্থা। এভাবে প্রধানমন্ত্রীকে ভুল তথ্য দিয়ে আমাদেরকে মেরে ফেলবেন না প্লিজ, আর রোগীদের হাত জোড় করে বলি তথ্য গোপন করে এভাবে চিকিৎসক সমাজসহ পুরো সমাজকে শেষ করবেন না।

একজন রোগীর তথ্য গোপন করার কারণে আজ যদি আমরা অনেকগুলো ডাক্তার আল্লাহ না করুক ইনফেক্টেড হই কাল আপনার চিকিৎসা দেবে কে?? ইতোমধ্যে শেরে-বাংলা মেডিকেল কলেজের আমাদের মেডিসিন-৩ ইউনিট বন্ধ ঘোষণা করা হয়েছে। এভাবে যদি বাকি সব ইউনিট বন্ধ হয়ে যায় কি হবে বলেন তো??? জানি না, কপালে আল্লাহ কি রেখেছেন, সবাই দোয়া কইরেন, যে পরীক্ষার ফলাফল নেগেটিভ আসে। আর শেষ একটা কথা বলে যাই, আর কোনো দিন আল্লাহ বলার সুযোগ দেবে কিনা জানি না। দয়া করে ডাক্তারদের জাতি ধরে গালি দেবেন না, ভালোমন্দ সব পেশায় আছে। বাবা হিসেবে যেমন এই পৃথিবীর কোন বাবা খারাপ না, মানুষ হিসেবে খারাপ হতে পারে। তেমনি  একজন প্রকৃত চিকিৎসক কোনো দিন খারাপ হতে পারেন না, কোন চিকিৎসক রোগীর খারাপ চান না। আমরা আপনাদের প্রণোদনা, সম্মানী, স্যালুট, সমবেদনা, বিমা এগুলো চাই না। আমরা চাই সম্মান, আমরা চাই ভালোবাসা। আমরা যে শুধু আপনাদের মুখে হাসি ফুটানোর জন্য নিজের জীবন হাসিমুখে বিলিয়ে  দিচ্ছি, আপনারা যে দিন এটা বুঝবেন সেদিন আমাদের কষ্ট স্বার্থক হবে। সব চিকিৎসকসহ সারা দেশবাসীর জন্য দোয়া করবেন,
আল্লাহ যদি বাঁচায়, তো দেখা হবে বিজয়ে ইন-শা-আল্লাহ। ’  

বাংলাদেশ সময়: ১৬৪০ ঘণ্টা, এপ্রিল ১৭, ২০২০
এমএস/এএ

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।