ঢাকা, বুধবার, ১০ পৌষ ১৪৩১, ২৫ ডিসেম্বর ২০২৪, ২২ জমাদিউস সানি ১৪৪৬

স্বাস্থ্য

নষ্ট হচ্ছে যন্ত্রপাতি, অপারেশনে লাগছে ২১ দিন

55 | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ১৬২০ ঘণ্টা, জুলাই ১৩, ২০২০
নষ্ট হচ্ছে যন্ত্রপাতি, অপারেশনে লাগছে ২১ দিন

ঢাকা: বাংলাদেশে নাক, কান ও গলার চিকিৎসার জন্য ‘ন্যাশনাল ইনস্টিটিউট অব ইএনটি’ একমাত্র বিশেষায়িত সরকারি হাসপাতাল। এখানে দেশের বিভিন্ন অঞ্চল থেকে রোগী এসে চিকিৎসা নিচ্ছেন। বহির্বিভাগে দৈনিক গড়ে প্রায় ৫০০ রোগীর ব্যবস্থাপনাপত্র ও চিকিৎসা প্রদান করা হয়। বর্তমানে প্রয়োজন ও চাহিদার তুলনায় কম চিকিৎসক কর্মরত থাকায় সারা দেশ থেকে আগত রোগীর নাক, কান ও গলা চিকিৎসা সেবা প্রদানে দীর্ঘ সময় লাগছে। এখানে রোগী ভর্তি হওয়ার পর অপারেশনের জন্য সিরিয়াল পেতে গড়ে সর্বোচ্চ ২১ দিন পর্যন্ত সময় লাগছে।

সারাদেশে দরিদ্র রোগীরাই বেশি চিকিৎসা নেন ন্যাশনাল ইনস্টিটিউট অব ইএনটি হাসপাতালে। কেনা হয়েছে কোটি টাকার চিকিৎসা সরঞ্জামাদি।

অথচ পর্যাপ্ত ও দক্ষ লোকবল না থাকায় এসব যন্ত্র এখনও চালু হয়নি। ফলে রোগীরা দামি আইসিইউয়ের কোনো সুফল পাচ্ছেন না। লোকবলের অভাবে কোটি টাকা ব্যয়ে কেনা সব যন্ত্র অব্যবহৃত পড়ে আছে এবং নষ্ট হয়ে যাচ্ছে। আইসিইউয়ের জন্য অতি প্রয়োজনীয় এই যন্ত্রগুলোর প্রত্যেকটি ৭০ লাখ টাকা করে কেনা হয়েছে।
 
বার্ষিক উন্নয়ন কর্মসূচির (এডিপি) আওতায় বাস্তবায়নাধীন যেসকল প্রকল্প দুই থেকে তিন বছর পূর্বে সমাপ্ত হয়েছে সেগুলোর মধ্যে কিছু কিছু নির্বাচিত প্রকল্পের প্রভাব মূল্যায়নের লক্ষ্যে বাস্তবায়ন পরিবীক্ষণ ও মূল্যায়ন বিভাগের (আইএমইডি) মাধ্যমে পরামর্শক প্রতিষ্ঠান নিয়োগ করা হয়। এর মধ্যে এস্টাবলিশমেন্ট অব ন্যাশনাল ইনস্টিটিউট অব ইএনটি ফাস্ট ফেইজ ইন ঢাকা’ সমাপ্ত প্রকল্পের প্রভাব মূল্যায়নের কার্যক্রম গ্রহণ করা হয়।

৬২ কোটি ৪১ লাখ টাকা ব্যয়ে জুলাই ২০০৮ থেকে জুন ২০১৮ সালে প্রকল্পটি বাস্তবায়ন করা হয়েছে। চলতি বছরের মে মাসে প্রকল্পটির ওপর বাস্তবায়ন পরিবীক্ষণ ও মূল্যায়ন বিভাগ (আইএমইডি) প্রভাব মূল্যায়ন প্রতিবেদন করেছে। জনগণের টাকায় বাস্তবায়িত প্রকল্পে জনগণ কেমন সেবা পাচ্ছে এটা দেখতেই সরেজমিন পরিদর্শন করে আইএমইডি। প্রতিবেদনের খসড়া কপি চূড়ান্ত করা হয়েছে। আগস্ট মাসের মধ্যে খসড়া কপি প্রিন্ট করে বই আকারে বের করা হবে। পরে আইএমইডি প্রতিবেদন সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয় ও হাসপাতাল কর্তৃপক্ষকে দেওয়া হবে। বাংলাদেশে নাক, কান ও গলার জন্য ন্যাশনাল ইনস্টিটিউট অব ইএনটি একমাত্র বিশেষায়িত সরকারি হাসপাতালে সমস্ত দুর্বল দিকগুলো সমাধানেরও তাগিদ দেওয়া হবে।
 
আইএমইডির মহাপরিচালক (পরিবীক্ষণ ও মূল্যায়ন সেক্টর-৫, স্বাস্থ্য ও গৃহায়ন) মো. মোখলেছার রহমান সরকার বাংলানিউজকে বলেন, বাংলাদেশে নাক, কান ও গলার জন্য ন্যাশনাল ইনস্টিটিউট অব ইএনটি একমাত্র বিশেষায়িত সরকারি হাসপাতাল। কিন্তু এখনো হাসপাতালের লক্ষ্যগুলো পূরণ হয়নি। হাসপাতালে দামি দামি যন্ত্রপাতি জনবলের অভাবে নষ্ট হচ্ছে। এছাড়া রোগির চাপ বেশি থাকায় সঠিক সময়ে চিকিৎসা সেবা মিলছে না।
 
সরেজমিন পরিদর্শন প্রসঙ্গে ডিজি বলেন, আমরা সবেমাত্র মনিটরিং শেষ করেছি। এখন খসড়া কপি প্রিন্ট করতে পাঠাবো। এরপরেই সংশ্লিষ্টদের প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ নিতে বলবো। প্রকল্পটি পরিদর্শনের সময় আমরা সংশ্লিষ্টদের নিয়ে মিটিং করেছি। মিটিংয়ে প্রকল্প সংশ্লিষ্টদের হাসপাতালের দুর্বল দিকগুলো জানিয়েছি। তারা (হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ্য) আমাদের বলেছে  করোনার কারণে ৬ মাস কাজ করতে পারেনি। এই জন্য হাসপাতালে প্রয়োজনীয় অনেক কাজ বাকি রয়ে গেছে।
 
আইএমইডির প্রতিবেদনে আরো উঠে এসেছে, ন্যাশনাল ইনস্টিটিউট অব ইএনটি হাসপাতালে ২০১৯ সালে মোট ভর্তিকৃত রোগীর সংখ্যা ৩ হাজার ৪৮৭ জন, যা ২০১৮ সালের তুলনায় ৯ দশমিক ৪৪ শতাংশ বেশি। অথচ সঠিক সময়ে চিকিৎসা সেবা মিলছে না। ফলে চিকিৎসার অভাবে অনেক রোগ দীর্ঘায়িত হচ্ছে। বর্তমানে এই হাসপাতালে ১৩৫টি শয্যা রয়েছে, যা প্রয়োজনের তুলনায় অনেক কম। এর ফলে আন্তঃবিভাগে ভর্তির জন্য সিরিয়াল দিয়ে রোগীদের দীর্ঘ সময় দাঁড়িয়ে থাকতে হয়। ১৩৫টি বেডের মধ্যে ৮১টি বেড ফ্রি সেবার আওতায়। এখানে গরিব, দুস্থ ও প্রতিবন্ধী রোগীদের চিকিৎসার ভার বহন করার কথা সমাজসেবা অধিদপ্তরের। অথচ এখানে সমাজসেবা অধিদপ্তরের কোন কার্যক্রম চলামন নেই। ফলে বিনামূল্যে চিকিৎসা খাতা কলমে থাকলেও বাস্তবে নেই।
 
প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, প্রকল্পটির অধিকাংশ যন্ত্রপাতি ২০১৮ সালে হাসপাতালটি এসে পৌঁছায়। আর যন্ত্রপাতি সংগ্রহের সার্বিক দায়িত্বে ছিল সিএমএসডি (বাংলাদেশ কেন্দ্রীয় ওষুধাগার)। সময় মতো যন্ত্রপাতি স্থাপন করতে না পারায় স্বাস্থ্য সেবা দিতে ব্যাঘাত ঘটে। বর্তমানে ল্যাবরেটরি, স্লিপ, অপারেশন থিয়েটারের গুরুত্বপূর্ণ কিছু যন্ত্রপাতি অচল রয়েছে। এছাড়া ন্যাশনাল ইনস্টিটিউট অব ইএনটি হাসপাতালে নিবিড় পরিচর্যা কেন্দ্রের (আইসিইউ) জন্য আটটি অত্যাধুনিক আর্টিফিশিয়াল রেসপিরেটরি ভেন্টিলেটর (এআরভি) মেশিন কেনা হয়েছিল। জনবলের অভাবে এ পর্যন্ত আইসিইউ ইউনিট ও স্লিপ ল্যাব চালু করা সম্ভব হয়নি। আর্টিফিশিয়াল রেসপিরেটরি ভেন্টিলেটর (এআরভি) মেশিন অকেজো অবস্থায় পাওয়া যায়। ছয়টি অর্টিফিশিয়াল রেসপিরেটরি ভেন্টিলেটর (এআরভি) মেরামত করা হয়েছে। তবে আশঙ্কা করা যাচ্ছে, স্থায়ী জনবল নিয়োগ না দিলে পরবর্তী সময়ে আইসিইউ ইউনিটের যন্ত্রপাতি আবারও অকেজো হয়ে যেতে পারে।

অ্যানেসথেসিওলজি বিভাগের চিকিৎসক অপ্রতুলতা, প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত সিনিয়র স্টাফ নার্স ও অন্যান্য জনবলের অভাবে আইসিইউ চালু করা সম্ভব হচ্ছে না। তবে হাসপাতালের পরিচালক চলতি বছরের ২০ জানুয়ারি অ্যানেসথেসিয়া ও আইসিইউ চালুর জন্য সিনিয়ার নার্স নিয়োগের অনুরোধক্রমে মহাপরিচালক নাসিং ও মিডওয়াইফ অধিদপ্তর বরাবর চিঠি দিয়েছে।
 
আইএমইডির প্রতিবেদনে আরও উঠে এসেছে, বর্তমানে হাসপাতালটিতে হিস্টপ্যাথলজি পরীক্ষার মাধ্যমে ক্যান্সার শনাক্ত করা হচ্ছে। কিন্তু সার্জারি পরবর্তী রেডিওথেরাপির কোনো ব্যবস্থা নেই। এছাড়া বর্তমানে হাসপাতালটিতে রেডিয়েশন ও অনকোলজির চিকিৎসকের জন্য সৃজনকৃত পদের বিপরীতে কোন চিকিৎসক কর্মরত না থাকায় ক্যান্সারের সম্পূর্ণ চিকিৎসা সম্ভব হচ্ছে না। বর্তমানে এই হাসপাতালে ৩০ শতাংশ পদ শূন্য রয়েছে। টেকনিশিয়ান পদে জনবলের ঘাটতি রয়েছে। বর্তমানে সৃজনকৃত পদের বিপরীতে কোন থেরাপিস্ট নেই। বেসরকারি পর্যায়ে থেরাপি গ্রহণ যথেষ্ট ব্যয় বহুল হওয়ায় নিম্ন আয়ের রোগিরা নানা সমস্যায় পড়েছেন। প্রকল্পটি সমাপ্ত হওয়ার ছয় বছর পেরিয়ে গেলেও নাক, কান ও গলা রোগের দক্ষ জনবল তৈরিতে হাসপাতালটি এখনো পেশাদারি একাডেমিক কোর্স চালু করতে পারেনি।
 
আইএমইডি রিপোর্ট প্রসঙ্গে স্বাস্থ্য সেবা বিভাগের উপ-প্রধান (স্বাস্থ্য) মো. মজিবুর রহমান বাংলানিউজকে বলেন, প্রকল্পটি নিয়ে আইএমইডি একটি প্রতিবেদন তৈরি করেছে। তবে প্রতিবেদনটি এখনো আমাদের হাতে আসেনি। প্রতিবেদন তৈরির সময় তাদের (আইএমইডি) সঙ্গে আমাদের মিটিং হয়েছে। এই হাসপাতালে রোগীদের চাপ বেশি যে কারণে সময় বেশি লাগে। আমরা সিদ্ধান্ত নিয়েছে এই হাসপাতালে আরো ১২০টি বেড বৃদ্ধি করতে হবে তবেই রোগীর চাপ কমবে। দ্বিতীয় ফেইসে প্রকল্প চালু করে কয়েকটি ফ্লোরের স্পেস বাড়াতে হবে।
 
তবে জনবল সংকট ও কোটি টাকার যন্ত্রপাতি নষ্টের হয়ে যাওয়ার বিষয়ে কোনো মন্তব্য করেননি স্বাস্থ্য সেবা বিভাগের উপ-প্রধান (স্বাস্থ্য)।

বাংলাদেশ সময়: ১৬১৬ ঘণ্টা, জুলাই ১৩, ২০২০
এমআইএস/এজে/

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।