ঢাকা, সোমবার, ৮ পৌষ ১৪৩১, ২৩ ডিসেম্বর ২০২৪, ২০ জমাদিউস সানি ১৪৪৬

স্বাস্থ্য

শত কোটি টাকার মালিক স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের ‘মালেক ড্রাইভার’

স্টাফ করেসপন্ডেন্ট | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ০১৪২ ঘণ্টা, সেপ্টেম্বর ২১, ২০২০
শত কোটি টাকার মালিক স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের ‘মালেক ড্রাইভার’ আবদুল মালেক

ঢাকা: রাজধানীর তুরাগে সাত তলার দুটি বিলাসবহুল বাড়িতে ২৪ টি ফ্ল্যাট, একইস্থানে অন্তত ১২ কাঠার আরেকটি প্লট ছাড়াও হাতিরপুলে নির্মাণাধীন ১০ তলা ভবনের মালিক স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের গাড়িচালক আবদুল মালেক।  

তৃতীয় শ্রেণীর পদস্থ একজন গাড়িচালক হলেও ব্যক্তিগত গাড়ি হিসেবে ব্যবহার করতেন অধিদপ্তরের মহাপরিচালকের জন্য বরাদ্দকৃত পাজেরো গাড়ি।

স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের প্রশাসনকে জিম্মি করে হস্তক্ষেপ করতেন ডাক্তারদের, তাদের বদলি-পদন্নোতিতেও। নিয়োগ, বদলি ও পদন্নোতিতে তদবিরের নামে আদায় করে নিয়েছেন বিপুল পরিমাণ অর্থ। যার বদৌলতে অল্প দিনেই শত কোটি টাকারও বেশি অর্থ-সম্পদের মালিক বনে গেছেন এই মালেক ড্রাইভার। শুধু তাই নয়, অধিদপ্তরের বিভিন্ন পদে চাকরি দিয়েছেন নিজের আত্মীয়-স্বজনকে।

রোববার (২০ সেপ্টেম্বর) তুরাগের কামারপাড়া এলাকার একটি ৭তলা ভবন থেকে আবদুল মালেককে গ্রেফতার করে র‌্যাপিড অ্যাকশান ব্যাটালিয়ন (র‌্যাব-১)। এ সময় তার কাছ থেকে একটি বিদেশি পিস্তল, একটি ম্যাগাজিন, পাঁচ রাউন্ড গুলি, দেড় লাখ জাল বাংলাদেশি টাকা, একটি ল্যাপটপ ও একটি মোবাইল উদ্ধার হয়।

র‌্যাব জানায়, সম্প্রতি র‌্যাবের নজরদারিতে একজন ব্যক্তির সন্ধান পাওয়া যায়, যিনি স্বল্প সময়ে বিপুল পরিমান সম্পদের মালিক হয়েছেন। অবৈধ সম্পদের রক্ষনাবেক্ষনের জন্য তিনি অবৈধ আগ্নেয়াস্ত্রও ব্যবহার করছেন- এমন তথ্যের ভিত্তিতে তুরাগের কামরপাড়া এলাকার একটি বাড়ি থেকে আবদুল মালেককে গ্রেফতার করা হয়েছে। তাকে প্রাথমিক জিজ্ঞাসাবাদে বিপুল পরিমান অবৈধ অর্থ-সম্পদের তথ্য পাওয়া গেছে।

তাকে প্রাথমিক জিজ্ঞাসাবাদের ভিত্তিতে সংশ্লিষ্ট র‌্যাব কর্মকর্তারা জানান, ব্যক্তিগত জীবনে দুটি বিবাহ করেছেন আবদুল মালেক। প্রথম স্ত্রী নার্গিস আক্তারের নামে তুরাগ থানাধীন দক্ষিণ কামারপাড়া রমজান মার্কেটের পাশে ৬ কাঠা জায়গার উপর ৭ তলার (হাজী কমপ্লেক্স) দুটি আবাসিক ভবন রয়েছে, যাতে সর্বমোট ২৪ টি ফ্ল্যাট রয়েছে। সেখানেই আরও আনুমানিক ১০/১২ কাঠার প্লট রয়েছে। বর্তমানে স্বপরিবারে সেখানকার একটি ভবনের তৃতীয় তলায় বসবাস করেন এবং বাকি ফ্ল্যাটগুলো কয়েকটি ভাড়া দেওয়া রয়েছে। এর বাইরে ২৩, ফ্রি স্কুল রোড, হাতিরপুলে পৈতৃক সাড়ে চার কাঠা জায়গার ওপর দশতলা নির্মাণাধীন ভবন আছে।  

মেয়ে বেবির নামে দক্ষিণ কামারপাড়ায় প্রায় ১৫ কাঠা জায়গার উপর 'ইমন ডেইরি ফার্ম' নামে একটি গরুর খামার রয়েছে, যাতে প্রায় ৫০ টি বাছুরসহ গাভী রয়েছে।

স্বাস্থ্য অধিদপ্তরে ড্রাইভার্স অ্যাসোসিয়েশন নামে একটি সংগঠন তৈরি করে নিজে সেই সংগঠনের সভাপতি পদে অধিষ্ঠিত হয়েছেন। এই সংগঠনের একক ক্ষমতায় তিনি স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের চালকদের উপর একছত্র আধিপত্য কায়েম করেছেন। চালকদের নিয়োগ, বদলি ও পদন্নোতির নামে তিনি বিপুল পরিমাণ অর্থ আদায় করেছেন।

স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের পরিচালক প্রশাসনকে জিম্মি করে বিভিন্ন ডাক্তারদের বদলি ও পদন্নোতি এবং তৃতীয়-চতুর্থ শ্রেণীর কর্মচারীদের নিয়োগের নামে বিপুল পরিমাণ অর্থ আদায় করেছেন এই মালেক ড্রাইভার।

অধিদপ্তরের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা ও চিকিৎসক নেতাদের আনুকূল্যে এত বেপরোয়া হয়ে উঠেছিলেন আবদুল মালেক। এছাড়া স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের প্রশাসনে কর্মরত একাধিক কর্মচারীর সঙ্গে ভালো যোগাযোগ ছিল। সেই সম্পর্ক কাজে লাগিয়ে দীর্ঘদিন ধরে বেপরোয়া নিয়োগ ও বদলি বাণিজ্য চালিয়ে যাচ্ছিলেন তিনি।

স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের বিভিন্ন পদে নিজের পরিবারেরই সাতজন চাকরি দিয়েছেন মালেক ড্রাইভার। মেয়ে নৌরিন সুলতানা বেলিকে অধিদপ্তরের অফিস সহকারী পদে, ভাই আব্দুল খালেককে অফিস সহায়ক পদে, ভাতিজা আব্দুল হাকিমকে অফিস সহায়ক পদে, বড় মেয়ে বেবির স্বামী রতনকে ক্যান্টির ম্যানেজার হিসেবে, ভাগ্নে সোহেল শিকারীকে ড্রাইভার পদে, ভায়রা মাহবুকে ড্রাইভার পদে, নিকট আত্মীয় কামাল পাশাকে অফিস সহায়ক পদে চাকরি দিয়েছেন।

র‌্যাব সূত্র আরো জানায়, আবদুল মালেক স্বাস্থ্যশিক্ষা অধিদপ্তরের মহাপরিচালক এ এইচ এম এনায়েত হোসেনের গাড়ি চালক। যদিও মহাপরিচালক অন্য একটি গাড়ি ব্যবহার করেন এবং চালকও আলাদা। অথচ আবদুল মালেক মহাপরিচালকের জন্য বরাদ্দকৃত একটি সাদা পাজেরো জিপ (গাড়ি নং- ঢাকা মেট্রো গ- ১৩-২৯৭৯) নিয়মিত ব্যক্তিগত গাড়ি হিসেবেই ব্যবহার করতেন।

এর বাইরে স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের আরও দুটি গাড়ি ব্যক্তিগত কাজে ব্যবহার করেন। একটি পিকআপ (ঢাকা মেট্রো ঠ-১৩-৭০০১) তার ডেইরি ফার্মের দুধ বিক্রি এবং তার মেয়ের জামাই পরিচালিত অধিদপ্তরের ক্যান্টিনের মালামাল পরিবহনের কাজে ব্যবহার করা হয়, যার গাড়িচালক মাহবুব। অপর একটি মাইক্রো (ঢাকা মেট্রো - চ - ৫৩-৬৭৪১) স্বাস্থ্য অধিদপ্তরে কর্মরত মালেকের পরিবারের অন্যান্য সদস্যরা ব্যবহার করেন, যার গাড়িচালক কামরুল।

র‌্যাবের এক কর্মকর্তা জানান, স্বাস্থ্য অধিদপ্তরে সিন্ডিকেট করে সীমাহীন দুর্নীতির মাধ্যমে শত কোটি টাকারও বেশি অর্থ অবৈধভাবে হাতিয়ে নিয়েছেন মালেক ড্রাইভার। তার বিদেশে পাচার এবং জ্ঞাত আয় বহির্ভূত সম্পদ অর্জনের অভিযোগে তাকে দুদকে তলব করা হয়েছে।

র‌্যাবের লিগ্যাল অ্যান্ড মিডিয়া উইংয়ের পরিচালক লে. কর্নেল আশিক বিল্লাহ জানান, আবদুল মালেক স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের পরিবহন পুলের একজন গাড়িচালক ও তৃতীয় শ্রেণীর কর্মচারী। অষ্টম শ্রেণী পাস আবদুল মালেক ১৯৮২ সালে প্রথমে প্রেষনে সাভার স্বাস্থ্য প্রকল্পের গাড়িচালক হিসেবে যোগ দেন। ১৯৮৬ সালে তিনি তৃতীয় শ্রেণীর কর্মচারি হিসেবে নিয়োগ পান এবং অধিদপ্তরে চালক হিসেবে যোগ দেন।

তার বিরুদ্ধে অস্ত্র আইনে ও জাল টাকা রাখার দায়ে বিশেষ ক্ষমতা আইনে মামলা দায়ের করা হয়েছে। পরবর্তীতে ব্যাপক জিজ্ঞাসাবাদে তার সঙ্গে সংশ্লিষ্ট সকলের নাম বেরিয়ে আসবে বলেও জানান র‌্যাবের এই কর্মকর্তা।

তিনি বলেন, যেহেতু মালেক বিপুল পরিমাণ অবৈধ সম্পদের মালিক, সেহেতু তার সম্পদ রক্ষা ও ব্যক্তিগত নিরাপত্তার স্বার্থে মালেক অবৈধ অস্ত্র সঙ্গে রাখতেন বলে প্রাথমিক জিজ্ঞাসাবাদে জানিয়েছেন। তার বিপুল পরিমাণ অবৈধ অর্থ-সম্পদ এবং অর্থ পাচারের বিষয়গুলো দুদক ও সিআইডি তদন্ত করে দেখবে।

বাংলাদেশ সময়: ০১৪১ ঘণ্টা, সেপ্টেম্বর ২১, ২০২০
পিএম/ওএফবি

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।