ঢাকা, সোমবার, ৮ পৌষ ১৪৩১, ২৩ ডিসেম্বর ২০২৪, ২০ জমাদিউস সানি ১৪৪৬

ভারত

ত্রিপুরায় স্বর্ণশিল্পীদের সোনালি দিন এখন অতীত!

সুদীপ চন্দ্র নাথ, স্টাফ করেসপন্ডেন্ট | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ১৭৩৩ ঘণ্টা, মার্চ ১৬, ২০২৩
ত্রিপুরায় স্বর্ণশিল্পীদের সোনালি দিন এখন অতীত!

আগরতলা (ত্রিপুরা): ধনী বা গরিব- সবাই নিজ নিজ আর্থিক অবস্থাভেদে স্বর্ণালংকার কিনে রাখেন। খুঁজে এমন একটি পরিবার পাওয়া মুশকিল, যে বাড়িতে সোনার তৈরি কোনো কিছু পাওয়া যাবে না।

বিশেষ করে ভারতীয় উপমহাদেশে স্বর্ণের চাহিদা সবচেয়ে বেশি।

তাই শহর থেকে গ্রাম, সব জায়গাতেই স্বর্ণের দোকান খুঁজে পাওয়া যায়। মানুষের হাতে বাড়তি অর্থকড়ি এলেই স্বর্ণালংকার কিনে থাকেন।  

প্রতিনিয়তই স্বর্ণালংকারের চাহিদা বৃদ্ধি পেলেও রাজধানী আগরতলাসহ ত্রিপুরা রাজ্যের স্বর্ণ শিল্পীদের আর্থিক অবস্থা দিন দিন খারাপ হচ্ছে বলে জানাচ্ছেন এই শিল্পের সঙ্গে যুক্ত কারিগররা। তাদের ভাষায়, স্বর্ণশিল্পীদের সোনালি দিন এখন অতীত। এই কাজ করে পরিবার-পরিজন নিয়ে বেঁচে থাকাই কঠিন হয়ে পড়েছে।

রাজধানী আগরতলার কাঁসারী পট্টি, শান্তিপাড়া এলাকায় কয়েকশ ছোট ছোট দোকান রয়েছে, এক সময় যেগুলোতে বসে হাজারো স্বর্ণশিল্পী নানান সব অলংকার তৈরি করতেন। এক একটা দোকানে গাদাগাদি করে বসে কাজ করতেন শিল্পীরা। কাজের চাপ এতো বেশি ছিল যে, নাওয়া-খাওয়ারও সময় পেতেন না! সেই এলাকা দিয়ে গেলেই শিল্পীদের হাতুড়ির টুংটাং আওয়াজ শোনা যেত সারাক্ষণ। এখন সেই জৌলুস আর নেই এলাকাগুলোতে।

আগে একটা সময় ছিল, যখন এই দোকানগুলোর ছোট ছোট চৌকিতে যন্ত্রপাতি রেখে কাজ করতেন শিল্পীরা। প্রতিটি চৌকির সামনে একজন করে বসতেন আর কাজ করতেন। এখনো সেই দোকানঘর আছে, রয়েছে চৌকিগুলোও, শুধু নেই শিল্পীরা। ঘরগুলোর বেশিরভাগ চৌকি ফাঁকা, দু-একজনকে বসে কাজ করতে দেখা যায়।

আগরতলার কাঁসারী পট্টি এলাকার উত্তম দেবনাথ নামে এক শিল্পীর সঙ্গে কথা হয়। তিনি বাংলানিউজকে জানান, এখন স্বর্ণশিল্পীদের অবস্থা খুব খারাপ। চরম আর্থিক সংকটের মধ্যে দিন কাটাচ্ছেন তারা। আগে স্থানীয় শিল্পীরা যে পরিমাণ কাজ করতেন, এখন তার ১০ ভাগও নেই। পেটের তাগিদে বাধ্য হয়ে অনেক শিল্পী এই পেশা ছেড়ে অন্য পেশায় চলে যাচ্ছেন।  
রাজ্যের স্বর্ণশিল্পীদের এমন অবস্থার কারণ সম্পর্কে বলতে গিয়ে তিনি জানান, এইসব শিল্পীরা মূলত বড় বড় জুয়েলারি প্রতিষ্ঠানগুলোর ওপর নির্ভরশীল। স্বর্ণশিল্পীরা এইসব প্রতিষ্ঠানের কাজই করে থাকেন। কিন্তু সম্প্রতি জুয়েলারি প্রতিষ্ঠানের মালিকরা স্থানীয় শিল্পীদের কাজ না দিয়ে বহিঃরাজ্য থেকে তৈরী করা গহনা নিয়ে আসছেন বিক্রির জন্য। মূলত কলকাতা, দিল্লী ও মুম্বাই থেকে গহনা আনা হচ্ছে। আর সামান্য কিছু কাজ স্থানীয় শিল্পীদের দিয়ে করাচ্ছেন। ক্রেতারা যখন নগদ অর্থ দিয়ে স্বর্ণসামগ্রী কিনতে আসেন, তখন তারা বড় প্রতিষ্ঠানে চলে যান, স্বর্ণের ছোট দোকানগুলোতে আসেন না।

এহেন অবস্থায় স্বর্ণশিল্পীরা মূলত শহরতলীর দোকানের কাজ এবং যারা পুরোনো গহনা গলিয়ে নতুন গহনা তৈরী করছেন, সেইসব কাজ করে জীবিকা নির্বাহ করছেন। এইসব ছোটখাটো কাজ করে পরিবার নিয়ে বেঁচে থাকাটা কষ্টকর হয়ে দাঁড়িয়েছে। তাই পরিবার প্রতিপালনের জন্য অনেকেই এই পেশা ছেড়ে দিয়েছেন। আবার অনেকে একবেলা এই কাজ করেন, আর অন্য সময় বিভিন্ন সামগ্রীর ফেরিওয়ালার কাজ করছেন। কেউ অটো, ই-রিক্সা চালাচ্ছেন, কেউবা ব্যবসা করছেন।  

উত্তম দেবনাথ নিজেও ইলেকট্রিক সামগ্রী ফেরির কাজ করছেন বলে জানান। সকাল থেকে দুপুর পর্যন্ত অলংকার তৈরী করেন, আর বিকেল বেলা ফেরি করেন।

কীভাবে আবার স্বর্ণ শিল্পীদের সোনালি দিন ফিরে আসবে বলে মনে করেন? এই প্রশ্নের জবাবে স্বর্ণশিল্পী উত্তম দেবনাথ বলেন, আগে জুয়েলারি মালিকরা স্থানীয় শিল্পীদের দিয়ে কাজ করাতো। তখন তাদেরও লাভ হতো, আমাদেরও উপার্জন হতো। এখন তারা আরও বেশী লাভের আশায় অন্য জায়গা থেকে অলংকার তৈরী করাচ্ছে। মালিকরা যদি বেশী লাভের কথা চিন্তা না করে এই সব শিল্পীদের কথা চিন্তা করে, তাদের আরও বেশি বেশি কাজ দেয়, তাহলে স্বর্ণ শিল্পীদের আর্থিক অবস্থার উন্নতি হবে।  

তিনি আরও জানান, অনেকে ভাবেন, অন্য রাজ্য থেকে নিয়ে আসা অলংকারগুলো মেশিনে তৈরি করা! আসলে তা কিন্তু না। কিছু কিছু চেইনজাতীয় গহনা ছাড়া বাকিগুলো হাতেই তৈরি করতে হয়। রাজ্যের শিল্পীরাও দক্ষ হতে এইসব সামগ্রী তৈরি করতে পারেন।  

তবে এই স্বর্ণশিল্পীর আশঙ্কা, এভাবে চলতে থাকলে একটা সময় স্বর্ণশিল্পী খুঁজে পাওয়া কষ্টকর হয়ে দাঁড়াবে।

সঞ্জীব দেবনাথ নামে ওপর এক স্বর্ণশিল্পী নিজেদের সম্পর্কে বর্ণনা করতে গিয়ে বলেন, তাদের অবস্থা খুবই খারাপ। প্রতিদিন হাতে কাজও থাকে না। এই অবস্থা চলতে থাকলে নতুন শিল্পী উঠে আসা তো দূরের কথা, বর্তমানে যারা কাজের সঙ্গে যুক্ত রয়েছেন, তারাও এই কাজ ছেড়ে অন্য কাজে চলে যেতে বাধ্য হচ্ছেন। সব মিলিয়ে তারা এখন অপেক্ষার প্রহর গুণছেন। যদি কখনো আবার তাদের সেই সোনালি দিন ফিরে আসে!

বাংলাদেশ সময়: ১৬৪৫ ঘণ্টা, মার্চ ১৬, ২০২৩
এসসিএন/এনএস

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।