ঢাকা, বৃহস্পতিবার, ২০ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ০৫ ডিসেম্বর ২০২৪, ০২ জমাদিউস সানি ১৪৪৬

ভারত

মমতার দলেও ভাঙনের সুর!

ভাস্কর সরদার, সিনিয়র করেসপন্ডেন্ট | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ১৭৩১ ঘণ্টা, ফেব্রুয়ারি ১১, ২০২২
মমতার দলেও ভাঙনের সুর!

কলকাতা: পশ্চিমবঙ্গে ক্ষমতাসীন তৃণমূল কংগ্রেসের সাংগঠনিক দায়িত্ব থেকে নিজেকে সরিয়ে নিতে পারেন দলের সর্বভারতীয় সাধারণ সম্পাদক অভিষেক বন্দ্যোপাধ্যায়? শুধুমাত্র দক্ষিণ ২৪পরগণার ডায়মন্ড হারবারের সংসদ সদস্য হিসেবে নিজেকে ধরে রাখতে চান অভিষেক! এমনই নানান প্রশ্ন ঘুরছে পশ্চিমবঙ্গের রাজ্য রাজনীতিতে।

এর কারণ অভিষেক শুধু মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের ভাতিজা নন, বলা যায় বর্তমানে তিনি দলের সেকেন্ড-ইন-কমান্ড।

আবার অনেকক্ষেত্রে দলনেত্রীকেও ছাপিয়ে যান অভিষেক। যে কারণে দলের অনেকেই সহ্য করতে পারছে না ভাতিজাকে! এমনটাও কানাঘুষা চলছে রাজনৈতিক অঙ্গনে।

তবে অভিষেক সরে গেলে আবার দলের পতন শুরু হবে? এটা বুঝতে হলে একটু পেছনের দিকে যেতে হবে। ২০১৭ সালের ৩ নভেম্বর দিল্লিতে গিয়ে বিজেপিতে যোগ দেন করেন মুকুল রায়। এক সময় যাকে সঙ্গে করে মমতা তৈরি করেছিলেন তৃণমূল দল। এরপর ২০১৯ সাল ভারতের লোকসভা ভোট। যেই ভোটে দ্বিতীয়বার দিল্লির মসনদে বসেন প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি। সেবার বিজেপি ‘ঝড়’ বড়ভাবে প্রথম আঁচ পায় পশ্চিমবঙ্গবাসী। আঁচ পান মমতাও। সেই গেরুয়া ঝড়ে বাংলার ৪২টা আসনের মধ্যে ১৮টাই যায় বিজেপির দখলে। অর্থাৎ রাজ্যের প্রতিনিধিত্ব করতে দিল্লির সংসদ ভবনে যায় পশ্চিমবঙ্গের ১৮ জন বিজেপি সাংসদ।

এরপরই তৃণমূলে শুরু হয় এক অশনি সঙ্কেত। একে একে নেতা-মন্ত্রী-কর্মীরা পা বাড়ান বিজেপির দিকে। পরিস্থিতি এমন পর্যায়ে পৌঁছায় তৃণমূলই থাকবে কিনা এ নিয়ে বড় প্রশ্ন দেখা দেয় দলের অভ্যন্তরে। এমন শোচনীয় পরিস্থিতিতে অভিষেক নিজের উদ্যোগে বাংলায় নিয়ে আসেন ভোটকুশলী প্রশান্ত কিশোরকে। যার পোশাকি নাম পিকে। এই পিকে ভারতের যে রাজ্যের রাজনৈতিক দলের মাথায় হাত রেখেছেন তারাই ক্ষমতার স্বাদ পেয়েছেন। বলা হয়, ২০১৪ সালে মোদীর প্রধানমন্ত্রী হওয়ার পেছনে তার বড় ধরনের অবদান আছে।

ফলে প্রথম দিকে মমতা এই ভোটকুশলীকে না পছন্দ করলেও পরে অভিষেকের কথা মেনে নেন। এরপর গ্রাম-শহর-জেলা-অলিগুলি ঘুরে বাংলার হয়ে ঘুঁটি সাজাতে শুরু করেন পিকে এবং তার টিম। এমনকি দলের প্রধানসহ নেতা-মন্ত্রীরা কী ভাষণ দেবেন, আর কী প্রকাশ্যে বলতে পারবেন না, কি করবেন, কী কী করতে পারবেন না তাও সাজিয়ে দেন পিকে। অর্থাৎ সব স্বাধীনতায় শেকল পরিয়ে দেন তিনি। ফের অসন্তোষের দানা বাধে দলের অন্দরে।

পরে মমতার কথায় অক্ষরে অক্ষরে সবাই পালন করতে থাকেন পিকের বাণী, এমনকি মমতাও। এরপরই দল ধীরে ধীরে ছন্দে ফিরতে থাকে এবং তার ফলাফল হিসেবে ২০২১ সালে বাংলা আবার ভরসা রাখে মমতার ওপর। সে সময় বিজেপি যখন বারবার হুঙ্কার দিচ্ছিল ২শ আসন নিয়ে বাংলায় ক্ষমতায় আসব, তখন তৃণমূলের কোনো নেতা-মন্ত্রী সাহস করে বলতে পারেননি কত আসনে জিততে পারে মমতার দল। একমাত্র পিকেই বলেছিলেন ২শ তো দুরস্ত, শত অঙ্কের ঘর পেরোবে না বিজপি। এবং বিপুল সংখ্যায় জিতবে তৃণমুল। ফলে, ২০২১ সালে মমতাকে তৃতীয়বারের জন্য পশ্চিমবঙ্গের ক্ষমতা পাইয়ে দেওয়ার পিছনে যাদের অবদান সবচেয়ে বেশি, তাঁরা হলেন অভিষেক বন্দ্যোপাধ্যায় এবং পিকে।

ফলে সেই অভিষেক যখন অভিমান করেন তখন বাংলার রাজনীতিতে চার্চার বিষয় হয়ে দাড়াবেই। এদিকে এই অভিষেক এবং পিকে দুজনের হাত ধরেই বাংলা ছেড়ে ভারতের বিভিন্ন রাজ্যে বিধানসভা ভোটে প্রার্থী দিয়েছে তৃণমুল। তখন দুজনেই একপ্রকার দলের থেকে সব সম্পর্ক ছিন্ন করতে চলছে। শুক্রবার(১১ ফেব্রূয়ারি) পিকে’র কোম্পানী আইপ্যাক’এর অফিশিয়াল টুইটার থেকে মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়কে ‘ফলো’করা বন্ধ করে দিয়েছে। পাশাপাশি অনেকদিন ধরেই মমতাসহ তৃণমূল নেতাদের সাথে দূরত্ব বেড়েছে এই ভোটকুশলীর। যদিও এ বিষয়ে আনুষ্ঠানিক কোনও ঘোষণা কোনও তরফেই করা হয়নি। তবে সম্পর্ক যে তলানিতে, তা এক প্রকার নিশ্চিত।

এদিন পিকের এক ঘনিষ্ঠ বলেছেন, পিকে যখন কোনও ব্যবসায়িক সম্পর্ক কারও সঙ্গে ছিন্ন করেন, তখন তা নিঃশব্দে করেন। সংবাদমাধ্যমে বিবৃতি দিয়ে বা ঢাকঢোল পিটিয়ে নয়। এরসাথে তিনি বলেছেন, তবে প্রশান্তের সঙ্গে তৃণমূলের এখনও চুক্তি রয়েছে। তবে সেই চুক্তি থেকে বেরিয়ে আসতে গেলে কী কী করতে হবে, তাও দু’পক্ষই জানে।

অপরদিকে, দলের পরিস্থিতি যেদিকে যাচ্ছে, তাতে দল থেকে সাংগঠনিক দায়িত্ব বিচ্ছিন্ন করতে পারেন অভিষেক বন্দ্যোপাধ্যায়। এমন সম্ভাবনা একেবারে উড়িয়ে দেওয়া যাচ্ছে না। অভিষেকের ঘনিষ্ঠ সূত্রের দাবি, আগামী ১৪ ফেব্রুয়ারি গোয়া রাজ্যে বিধানসভা ভোটের পর অভিষেক দল সংক্রান্ত সিদ্ধান্ত নিতে পারেন। তবে তৃণমূলের একাংশের বক্তব্য, গোয়ায় ভোট সোমবার। এখনও দিনদুয়েক বাকি। তারমধ্যে পরিস্থিতি বদলালেও বদলাতে পারে। কারণ ঘটনা প্রতিমুহূর্তে বাঁক নিচ্ছে।

তবে পরিস্থিতি যেদিকে চলেছে, তাতে বিরক্ত স্বয়ং দলনেত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ও। কারণ বিষয়টি দাঁড়িয়ে গিয়েছে একদিকে দলের মহাসচিব পার্থ চট্টোপাধ্যায় এবং রাজ্য সভাপতি সুব্রত বক্সী, অপরদিকে পিকে এবং অভিষেক। তবে রাজনৈতিক বিশেষজ্ঞদের মতে গোয়া থেকে ফিরে এলে একবার মমতা-অভিষেক মুখোমুখি বসলে সব অভিমান শেষ হয়ে যেতে পারে।

তবে অনেকের মতে তার সম্ভবনাও কম। কারণ সোমবার (৭ ফেব্রুয়ারি) যখন মমতা সমাজবাদী পার্টি হয়ে লখনউয়ে প্রচার করতে যান, অন্য বিমানে গোয় যাওয়ার কথা ছিল অভিষেকের। কিন্তু যেতে পারেননি। সাংবাদিকরা যখন মমতার কাছে জানতে চান গোয়ায় কে যাবেন? তখন নেত্রী, অভিষেকের নাম না নিয়েই বলেছেন, ওটা আমি দেখছি না, ওটা অন্য কেউ দেখছে। ফলে একটা দুরত্ব যে তৈরি হয়েছে তা স্পষ্টই বোঝা যাচ্ছে। আর তাতে সম্পর্ক ভেঙে যাওয়া কি সময়ের অপেক্ষা, না কি অন্যকোনো মাস্টাস্ট্রোক আছে? তা তো সময় বলবে!

বাংলাদেশ সময়: ১৭৩১ ঘণ্টা, ফেব্রুয়ারি ১১, ২০২১
ভিএস/এমএমজেড

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।