ঢাকা: আলোগতির কাছাকাছি ও প্রচণ্ড শক্তি উৎপন্ন করছে সম্প্রতি খুঁজে পাওয়া আন্তঃআণবিক পদার্থ কণা হিগস পার্টিকেল (হিগস-বোসন পার্টিকেল, ঈশ্বরকণা)।
আমাদের গ্রহ পৃথিবী, সৌরমণ্ডল, গ্যালাক্সিসহ বিশ্বব্রহ্মাণ্ড সৃষ্টির রহস্য উদঘাটনে বিজ্ঞানীরা যে কণা তাত্ত্বিকভাবে খুঁজে বেড়াচ্ছিলেন, মাত্র কয়েকদিন আগে তার সন্ধান পেয়েছেন দুটি পরীক্ষা দিয়ে।
তাত্ত্বিকভাবে তারা ধারণা করছিলেন, এই বিশ্বব্রহ্মাণ্ড সৃষ্টি হয়েছে অন্য একধরনের পদার্থ দিয়ে, যার অস্ত্বিত্ব নির্ধারণ তারা করতে পারছিলেন না। সেই পদার্থের নাম দিয়েছিলেন, ‘হিগস পার্টিকেল’ বা ‘হিগস বোসন’। কোনো কোনো বিজ্ঞানী এর নাম দিয়েছিলেন- ‘ঈশ্বরকণা’।
অবশেষে, সুইজারল্যান্ডের সীমান্ত এলাকা ঘিরে মাটির নিচের সর্ববৃহৎ একটি টানেলের মধ্য দিয়ে এই আন্ত:আণবিক কণার প্রোটনকে দুইদিক থেকে পরিচালনা করা হয়।
এরপর পৃথিবীর বিরল দৃশ্য দেখার সুযোগ ঘটে বিজ্ঞানীদের। টানেলের দুইদিক থেকে প্রোটন পরিচালনা করা হলে মুখোমুখি সংঘর্ষ হয়। এ সময় প্রচণ্ড সংঘর্ষে আলোরগতির কাছাকাছি গতি ও প্রচণ্ড শক্তি উৎপন্ন হয়, যা ইতোপূর্বে ঘটেনি।
অবাক করার মতো ঘটনা এই, এত প্রচণ্ড গতি ও মহাশক্তি উৎপন্ন হলেও শব্দ উৎপন্ন হয়েছে, মাত্র মশার গুণ গুণ শব্দের মতো যাকে, বিজ্ঞানীরা বলছেন, মশার বাজ (Buzz)।
আলোর গতির কাছাকাছি গতি ও প্রচণ্ড মহাশক্তি উৎপন্ন হওয়ার ছবি ২১ মে প্রকাশ করেছেন, ইউরোপীয়ান অর্গানাইজেশন ফর নিউক্লিয়ার রিসার্চ (সার্ন)-এর বিজ্ঞানীরা।
যে ভূগর্ভস্থ টানেলে এই প্রোটনকে পরিচালিত করে পরীক্ষা করা হয়, তার দৈর্ঘ্য ১৭ মাইল (২৭ কিলোমিটার)। এই পুরো টানেলের প্রক্রিয়াকে বলা হচ্ছে, লার্জ হেড্রোন কোলাইডর (Large Hadron Collider- এলএইচসি)।
সার্নের বিজ্ঞানীরা জানাচ্ছেন, চলতি সপ্তাহ জুড়ে চালানো পরীক্ষায় টানেলের দুইদিকের বিপরীতমুখী প্রোটনকে ১৩ টেরা-ইলেকট্রোভোল্ট শক্তিতে পরিচালনা করা হয়।
এ বিষয়ে সার্নের বিজ্ঞানী গ্রেগ রাকনিস বলেন, বিপরীতমুখী প্রোটনের সংঘর্ষের পর যে শব্দ হয়েছিল তা বলতে পারেন আপনার চারপাশে থাকা মশাদের গুণ গুণ শব্দের মতো।
পদার্থবিজ্ঞানীরা সংঘর্ষকে যে কাঠামোর মধ্যে পরিচালিত করেছেন, তার নাম, কোলিমেটরস (Collimators)। এই কাঠামো এলএইচসি’র চম্বুক ও প্রতিরোধক ব্যবস্থাকে নিরাপদ করেছে।
বিজ্ঞানী গ্রেগ রাকনিস বলেন, যখন ১০০ বিলিয়ন থেকে ১০০০ বিলিয়ন প্রোটনকে একটি গোলাকার আকৃতির পরিবাহীর মধ্যে পরস্পরমুখী পরিচালনা করা হয়, তখন অন্য আরেক ধরনের শক্তি উৎপন্ন হয়।
তিনি বলেন, যদি এই শক্তি উৎপন্ন না হতো, তাহলে এর গতিপ্রবাহ মূল পরিবাহীর বাইরে চলে যেতো। প্রাটন কাঠামোকে উত্তপ্ত করতো।
তিনি বলেন, প্রায় ৯, ৬০০ চম্বুক প্রোটনকে সার্কেলের ভেতরে আটকে রাখে, যাতে করে তাদের পরিচালনার গতিপ্রবাহ সার্কেলের ভেতরেই সীমাবদ্ধ থাকে।
পরবর্তী পর্যায়ের পরীক্ষা:
সার্নের বিজ্ঞানীরা জানিয়েছেন, এলএইচসি-এর পরবর্তী পরীক্ষা জুনমাসের প্রথমদিকে চালানো হবে। এই সময় প্রোটনকে ফের ১৩ টেরা-ইলেকট্রভোল্ট গতিতে পরিচালনা করা হবে। এই সময় বিভিন্নভাবে পরীক্ষা চালানো হবে। যেমন- ALICE, ATLS ও CMSG। এই সময় ডাটাও (তথ্য-উপাত্ত) তৈরি হবে।
দ্য এলএইচসি জানাচ্ছে, হিগস বোসন পদার্থ থেকে অন্যান্য পদার্থের ভরপ্রাপ্তির (mass) বিষয়টিও জানা যাবে। ২০১২ সালে টানালে চালানো পরীক্ষায় এই সব পদার্থের অস্তিত্ব পাওয়া যায়।
এলএইচসি আরো জানাচ্ছে, আগামী পরীক্ষাতে আরো পদার্থের অস্তিত্ব আবিষ্কার হতে পারে। পদার্থবিদেরা সেই অপেক্ষাতেই দিন গুনছেন।
অন্যান্য পদার্থের অস্তিত্বের যদি আবিষ্কার হয়, তাহলে এই পৃথিবী, সৌরমণ্ডল, গ্যালাক্সি, বিশ্বব্রহ্মাণ্ড সৃষ্টির রহস্য উদঘাটিত হবে। শুধু তাই-ই নয়, মানুষ কীভাবে পৃথিবীতে এলো, তারও কোনো হদিস সহসাই মিলে যেতে পারে, যার প্রমাণের জন্য অসংখ্য পদার্থবিদ, বিজ্ঞানীরা অপেক্ষা করে আছেন।
সার্ন (CERN):
ইউরোপিয়ান অর্গানাইজেশন ফর নিউক্লিয়ার রিসার্চ (সার্ন) পৃথিবীর অন্যতম সেরা গবেষণাগার। ১৯৫৪ সালে প্রতিষ্ঠিত পদার্থবিষয়ক এই গবেষণা প্রতিষ্ঠানের অবস্থান ফ্রান্স ও সুইজারল্যান্ডের সীমানা ঘিরে। সার্ন জেনেভা শহরের পশ্চিমে ফ্রান্স ও সুইজারল্যান্ড-এর মধ্যকার সীমান্তে অবস্থিত বিশ্বের সর্ববৃহৎ কণা পদার্থবিজ্ঞান গবেষণাগার।
সার্নকে বলা হয় ওয়ার্ল্ড ওয়াইড ওয়েবের (www) জন্মস্থান। মূলত এখান থেকেই ইন্টারনেটের বিকাশ শুরু হয়।
সার্নে ‘ঈশ্বর-কণা’ নামে পরিচিত ‘হিগস-বোসন কণা’র অস্তিত্ব প্রথম প্রমাণিত হয়, যার জন্য ২০১৩ সালে পদার্থবিজ্ঞানে নোবেল পুরস্কার পান ফ্রাঁসোয়া ইংলার্ত ও পিটার হিগস।
১৯৫৪ এর সেপ্টেম্বর ২৯-এ অনুষ্ঠিত এক সভায় সার্ন প্রতিষ্ঠার প্রস্তাবটি স্বাক্ষরিত হয়। প্রস্তাবে স্বাক্ষরকারী রাষ্ট্রের সংখ্যা শুরুতে মাত্র ১২ থাকলেও বর্তমানে এই সদস্য রাষ্ট্রের সংখ্যা বেড়ে ২০-এ দাঁড়িয়েছে।
সার্নে ‘ঈশ্বর-কণা’ নামে পরিচিত ‘হিগস-বোসন কণা’র অস্তিত্ব প্রথম প্রমাণিত হয়, যার জন্য ২০১৩ সালে পদার্থবিজ্ঞানে নোবেল পুরস্কার পান ফ্রাঁসোয়া ইংলার্ত ও পিটার হিগস।
লার্জ হেড্রোন কোলাইডর (Large Hadron Collider-LHC) পৃথিবীর বৃহত্তম কণা ত্বরক। ৯ টেরা-ইলেকট্রন ভোল্টের প্রোটনসমৃদ্ধ রশ্মির মুখোমুখি সংঘর্ষ ঘটানোর জন্য এটা তৈরি করা হয়েছে।
এ ধরনের সংঘর্ষ ঘটানোর মূল উদ্দেশ্য প্রমিত মডেলের সত্যতা ও সীমাবদ্ধতা নির্ণয় করা। কণা পদার্থবিজ্ঞানে বর্তমানে এই প্রমিত মডেলই সর্বাধিক গ্রহণযোগ্য তাত্ত্বিক মডেল হিসেবে বিবেচিত হয়।
এলএইচসি বিশ্বের সর্ববৃহৎ ও সবচেয়ে শক্তিশালী কণা ত্বরক। ৮৫টি দেশের ৮০০০-এরও বেশি বিজ্ঞানী এই ত্বরক নির্মাণ প্রকল্পে কাজ করেছেন। এছাড়া অসংখ্য বিশ্ববিদ্যালয় ও গবেষণাগার এই নির্মাণ প্রক্রিয়ায় সহায়তা করেছে।
২০০৭ খ্রিস্টাব্দের ১০ সেপ্টেম্বর প্রথমবারের মতো পুরো এলএইচসি-তে প্রোটন রশ্মি চালনা করা হয়। এর আগে ৮-১১ আগস্টের মধ্যে এতে প্রাথমিক কণা রশ্মি ঢোকানো হয়, তাপমাত্রা ধীরে ধীরে ১.৯ কেলভিনে (-২৭১.২৫ ডিগ্রি সেলসিয়াস) নামিয়ে আনা হয়। এর মধ্যে আনুষ্ঠানিকভাবে প্রথম উচ্চশক্তির সংঘর্ষ ঘটানো হয়, ২১ অক্টোবর। তাই, ২১ অক্টোবরকেই এলএইচসি’র উদ্বোধন দিবস বলা হয়।
এর আগেও অনেকগুলো হেড্রোন-কোলাইডর তৈরি করা হয়েছে। কিন্তু এলএইচসি-র মতো অন্য কোনোটিই এত আলোচিত হয়নি। এর কারণ, এলএইচসি’র উচ্চশক্তি। এর মধ্যকার সংঘর্ষের মাধ্যমে মহাবিশ্বের জন্মলগ্ন বা মহাবিষ্ফোরণের ঠিক পরের শর্তগুলো তৈরি করা যাবে বলে ধারণা করেন বিজ্ঞানীরা। অবশ্য এক্ষেত্রে শর্তগুলো খুব ছোট স্কেলে কাজ করবে।
বাংলাদেশ সময়: ০১২০ ঘণ্টা, মে ২৫, ২০১৫
এবি
** দেখা মিললো হিগস পার্টিকেলের!