ঢাকা: ভারতের কাছে ব্যান্ডউইথ রফতানি করতে যাচ্ছে বাংলাদেশ। ব্যান্ডউইডথ রফতানি করে বছরে ১০০ কোটি টাকা আয় হবে দেশের ইন্টারনেট ব্যবস্থাপনাকারী প্রতিষ্ঠান বাংলাদেশ সাবমেরিন ক্যাবল কোম্পানি লিমিটেড (বিএসসিসিএল)’র।
বৈশ্বিক অর্থনীতিতে তথ্যপ্রযুক্তি খাত গুরুত্বপূর্ণ স্থান দখল করে আছে। আর তথ্যপ্রযুক্তি খাতের অন্যতম এবং অপরিহার্য বিষয় হলো ইন্টারনেট।
মধ্য আয়ের দেশ গড়ার যে লক্ষ্য নিয়ে সরকার কাজ করে যাচ্ছে, তার পেছনেও অন্যতম চালিকাশক্তি হিসেবেই কাজ করবে ইন্টারনেট। ইতোমধ্যেই দেশের অর্থনীতিতে অন্যতম একটি গুরুত্বপূর্ণ খাত হিসেবে জায়গা দখল করে নিয়েছে দেশের তথ্যপ্রযুক্তি।
গত কয়েক বছরে সফটওয়্যার ও তথ্যপ্রযুক্তি খাতে বাংলাদেশের অর্জন ব্যাপক। তাই সফটওয়্যার ও তথ্যপ্রযুক্তি খাতের সাথে সংশ্লিষ্টরা মনে করছেন, আগামী ১০ থেকে ১৫ বছরের মধ্যে বাংলাদেশের বৈদেশিক আয়ের অন্যতম মূল খাতে পরিণত হবে। আর তার জন্য দেশব্যাপী উচ্চগতির ইন্টারনেট নিশ্চিত করতে হবে।
ওয়াই-ফাই, থ্রিজি এবং ওয়াইম্যাক্সের মাধ্যমে ওয়্যারলেস ইন্টারনেটের প্রসার ঘটলেও দেশে ব্রডব্যান্ড সংযোগ এখনও বিস্তৃত নয়। শুধু তাই নয়, বড় বড় শহর এবং খোদ রাজধানী ঢাকাতেও উচ্চগতির ব্রডব্যান্ড ইন্টারনেট সংযোগ সুলভ নয়। তাই দ্রুততম সময়ের মধ্যে দেশব্যাপী অবকাঠামো উন্নয়নের মাধ্যমে উচ্চগতির ব্রডব্যান্ড সংযোগ পৌঁছে দেওয়ার দাবি উঠছে বিভিন্ন মহল থেকে।
এমন পরিস্থিতিতে ব্যান্ডউইথ রফতানির সিদ্ধান্ত নিয়েছে দেশের ইন্টারনেট ব্যবস্থাপানাকারী প্রতিষ্ঠান বিএসসিসিএল। মূলত বাংলাদেশে যে পরিমাণ ব্যান্ডউইথ রয়েছে তার বড় একটি অংশই অব্যবহৃত থাকার প্রেক্ষিতে ব্যান্ডউইথ রফতানির মাধ্যমে বড় অংকের অর্থ আয় করার সিদ্ধান্ত নেয়া হয়েছে।
৬ জুন ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির বাংলাদেশ সফরকালে এ চুক্তির স্বাক্ষর হবে বলে জানিয়েছে বিএসসিসিএল কর্মকর্তারা। বিএসসিসিএল’র সাথে ভারতের টেলিকম সেবাদানকারী প্রতিষ্ঠান ‘ভারত সঞ্চার নিগম লিমিটেড (বিএসএনএল)’র মধ্যে এ চুক্তি হতে যাচ্ছে।
উভয় প্রতিষ্ঠানের ঊদ্ধর্তন কর্মকর্তাদের উপস্থিতিতে এ চুক্তি স্বাক্ষর হওয়ার কথা রয়েছে।
বর্তমান সাবমেরিন ক্যাবলের মাধ্যমে বাংলাদেশের প্রাপ্ত ব্যান্ডউইথ ২০০ গিগাবাইট পার সেকেন্ড (জিবিপিএস)। এর মধ্যে বিএসসিসিএল অভ্যন্তরীণভাবে বিক্রি করছে মাত্র ৩২ গিগাবাইট পার সেকেন্ড। সব মিলিয়ে ২০০ জিবিপিএস ব্যান্ডউইথের মধ্যে বাংলাদেশ ব্যবহার করতে পারছে সর্বোচ্চ ৬০ জিবিপিএস। বাকি ১৪০ জিবিপিএস ব্যান্ডউইথ অব্যবহৃত থেকে যাচ্ছে। এমনটাই জানালেন বিএসসিসিএল’র ব্যবস্থাপনা পরিচালক ইঞ্জিনিয়ার মো. মনওয়ার হোসেন।
চুক্তির বিষয়ে জানতে চাইলে বাংলানিউজকে তিনি বলেন, ২ জুন উভয় প্রতিষ্ঠানের শীর্ষ কর্মকর্তাদের মধ্যে চুক্তি স্বাক্ষর হওয়ার কথা ছিল। কিন্তু ৬ জুন যেহেতু ভারতের প্রধানমন্ত্রী সরকারি সফরে আসছেন তাই সফরের সময়টাতেই চুক্তিটি স্বাক্ষরের সিদ্ধান্ত নেয়া হয়েছে।
চুক্তির বিষয়টি মন্ত্রিসভায় পাশ হওয়ার পর আইন মন্ত্রণালয়ের ভোটিং শেষে এখন তা স্বাক্ষরের অপেক্ষায় আছে।
মনওয়ার হোসেন বলেন, তিন বছর মেয়াদের চুক্তি হতে যাচ্ছে ভারতের সাথে।
প্রাথমিকভাবে আমরা ১০ জিবিপিএস ব্যান্ডউইথ রফতানি করবো। আশা করছি, রফতানি শুরু হওয়ার পর ছয় মাস কিংবা এক বছরের মধ্যে ১০০ জিবিপিএস ব্যান্ডউইথ রফতানি করতে পারবো। তেমনটা হলে বছরে আমাদের আয় হবে ১০০ কোটি টাকার উপরে।
তিনি বলেন, আগামী বছরের মধ্যে দ্বিতীয় সাবমেরিন ক্যাবলের সাথে যুক্ত হওয়ার কাজ দ্রুত এগিয়ে চলেছে। এই সাবমেরিন ক্যাবলের সাথে যুক্ত হলে আমরা আরো ১৩০০ জিবিপিএস ব্যান্ডউইথ পাবো। তখন দেশের উচ্চ গতির ইন্টারনেট চাহিদা মিটিয়ে অন্যান্য দেশেও ব্যান্ডউইথ রফতানি করে বিপুল পরিমাণ বৈদেশিক মুদ্রা আয় করা যাবে।
ব্যান্ডউইথ রফতানি শুরুর জন্য ইতোমধ্যে রুটও ঠিক করা হয়েছে জানিয়ে তিনি বলেন, কক্সবাজার, চট্টগ্রাম, ব্রাহ্মণবাড়িয়া, কুমিল্লা এবং আখাউড়ার স্থলভাগ দিয়ে লিংক সাবমেরিন ক্যাবল গিয়ে যুক্ত হবে ভারতের গোহাটিতে। দেশের সাবমেরিন ক্যাবলের ল্যান্ডিং স্টেশন কক্সবাজার থেকে চট্টগ্রাম হয়ে কুমিল্লা পর্যন্ত আসবে ফাইবার অপটিক ক্যাবল লাইন। এরপর কুমিল্লা থেকে আখাউড়া সীমান্ত পেরিয়ে আগরতলা হয়ে ত্রিপুরা পর্যন্ত পৌঁছে যাবে ইন্টারনেট সংযোগ। এর জন্য নতুন করে প্রায় ৩২ কিলোমিটার নতুন লিংক লাইন তৈরি করতে হবে।
আমাদের নিজস্ব ন্যাশনাল টেরিস্টরিয়াল ট্রান্সমিশন নেটওয়ার্ক (এনটিটিএন) লাইসেন্স নেই বলে এই লিংক আমরা নিজেরা তৈরি করতে পারব না। এর জন্য বিটিসিএল কিংবা ফাইবার অ্যাট হোমকে দায়িত্ব দেওয়া হবে।
ব্যান্ডউইথ রফতানির জন্য আরও একটি রুট ঠিক করা হয়েছে জানিয়ে তিনি বলেন, এই রুটটি ব্রাহ্মণবাড়িয়া, সিলেট হয়ে তামাবিল সীমান্ত দিয়ে ভারতের মেঘালয়ের রাজধানী শিলং পর্যন্ত বিস্তৃত হবে। সেখান থেকে বিএসএনএল নিজস্ব ব্যবস্থাপনায় আসামে পৌঁছে যাবে বাংলাদেশ থেকে রপ্তানি হওয়া ব্যান্ডউইথ।
ভারতের মুব্বাইয়ে ৯টি ও চেন্নাইয়ে ৬টিসহ মোট ১৫টি সাবমেরিন ক্যাবল সংযোগ থাকলেও এর সবই ভারত মহাসাগর ও আরব সাগরের পাড়কেন্দ্রিক রাজ্যগুলোর সাথে সংশ্লিষ্ট। এসব ক্যাবলগুলোর ল্যান্ডিং স্টেশন থেকে 'সেভেন সিস্টার্স' রাজ্যগুলোর দূরত্ব অনেক বেশি এবং এসব এলাকায় এসব স্টেশন থেকে ইন্টারনেট সংযোগ দিতে গেলে দীর্ঘ পথ পাড়ি দিতে হয়। ফলে ইন্টারনেট সংযোগের খরচ অনেক বেড়ে যায়। সেক্ষেত্রে বাংলাদেশ থেকে এসব রাজ্যের জন্য ব্যান্ডউইথ কিনতে পারলে অবকাঠামো নির্মাণ ও পরিবহন খরচ দু’টোই কমে যায়। বাংলাদেশ থেকে একাধিক রুটে ব্যান্ডউইথ ভারতে নেওয়ার পরিকল্পনা রয়েছে ভারতের।
২০১৬ সালে দ্বিতীয় সাবমেরিন ক্যাবলের কার্যক্রম শুরু হলে বাংলাদেশের ইন্টারনেটের ইতিহাসে আরেক অধ্যায় সূচিত হবে বলে আশাবাদ ব্যক্ত করেন বিএসসিসিএলের ব্যবস্থাপনা পরিচালক মনওয়ার হোসেন।
তিনি জানান, দেশের চাহিদা মিটিয়ে বিএসসিসিএল ভারতের ব্যান্ডউইডথ রফতানি করার মাধ্যমে এক নতুন যুগের সূচনা করতে যাচ্ছে। সে দেশে ব্যান্ডউইডথ রফতানি করে বছরে ১০০ কোটি টাকা আয় করার সম্ভাবনা তৈরি হয়েছে।
চুক্তি স্বাক্ষরকালে ‘ভারত সঞ্চার নিগম লিমিটেড (বিএসএনএল)’র ব্যবস্থাপনা পরিচালক অনুপম শ্রিবাস্তব, পরিচালক সুজাতা রায় এবং মহাব্যবস্থাপনা পরিচালক আনন্দ খের উপস্থিত থাকবেন।
বাংলাদেশ সময়: ০৩৫০ ঘণ্টা, জুন ০১, ২০১৫
এমআইএইচ/ এমএইচপি/কেএইচ