ঢাকা: বিশ্বের প্রায় প্রতিটি দেশ কাজেকর্মে গতি আনতে ইন্টারনেটের প্রতি ঝুঁকে পড়েছে। সবাই বুঝে গিয়েছেন বর্তমান বিশ্বে সার্বিকভাবে প্রতিযোগিতায় টিকে থাকতে হলে তথ্যপ্রযুক্তি খাত জোরালো করা ছাড়া কোনো গতি নেই।
এ-প্রসঙ্গে লিভারেজিং আইসিটি ফর গ্রোথ, এমপ্লয়মেন্ট অ্যান্ড গভর্নেন্স (এলআইসিটি) প্রকল্পের পরামর্শক অজিত কুমার সরকারের সাথে কথা হয় বাংলানিউজের। তিনি জানান, এটা বিবেচনায় নিয়ে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ২০০৯ সালে ক্ষমতা গ্রহণ করেই ডিজিটাল বাংলাদেশ গড়ায় জন্য দেশবাসীর কাছে আহবান জানিয়েছিলেন। এখন সবকিছু ছাপিয়ে সামনে উঠে এসেছে ‘ডিজিটাল বাংলাদেশ’ ধারণাটি।
অর্থাৎ একবিংশ শতকে বিশ্বে কম্পিউটার ও ইন্টারনেটকেন্দ্রিক যোগাযোগের ক্ষেত্রে নতুন ধ্যান ধারণার ‘সাইবার জগৎ‘ সৃষ্টি করেছে। তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তির অভূতপূর্ব সম্প্রসারণ থেকেই এই জগতের সৃষ্টি।
সরকারি-বেসরকারি উদ্যোগ গত সাড়ে ছয় বছরে তথ্য ও সেবা প্রদানে ‘ই-সার্ভিস’, যোগাযোগে ‘পেপারলেস কমিউনিকেশন’ এবং আর্থিক লেনদেনে ‘ক্যাশলেস ইকোনমি’ চালু হয়েছে অনেক প্রতিষ্ঠানে।
বাংলানিউজকে অজিত কুমার সরকার জানান, এক্ষেত্রে অনেকটাই এগিয়ে বাংলাদেশ ব্যাংক। তারা একাই ৮৫টিরও বেশি সফটওয়্যার ব্যবহার করছেন। বাংলাদেশ ব্যাংক ই-সার্ভিস, পেপারলেস কমিউনিকেশন ও ক্যাশলেস ইকোনমি-র একটি মডেল দাঁড় করতে যাচ্ছে।
তথ্যপ্রযুক্তিতে কে কতোটা এগিয়ে থাকবে তা নিয়ে ইতোমধ্যে শুরু হয়েছে তীব্র প্রতিযোগিতা। বিশ্বে এখন একে অপরকে পেছনে ফেলতে চলছে তথ্য ও ডাটা চুরি ও কম্পিউটার-ইন্টারনেটচালিত ব্যবস্থাকে পুরোপুরি অচল করে দেয়ার চেষ্টায় মেতে আছে।
তথ্যপ্রযুক্তি ও নিরাপত্তা বিশেষজ্ঞদের ধারণা, আগামীতে যে যুদ্ধ হবে তা সাইবার জগতের নিরাপত্তা ও সার্বভৌমত্ব রক্ষার। অর্থাৎ যতোটা না ভূখণ্ডের নিরাপত্তা ও সুপেয় পানির অধিকারের লড়াই, তারও চেয়ে বেশি সাইবার জগতের আধিপত্য নিয়ে।
এটা দেখে বিশ্বে সাইবারস্পেসের যুদ্ধকে বলা হচ্ছে পঞ্চম ডোমেইনের যুদ্ধ। অনেক দেশই এজন্য আধুনিক অস্ত্রের সক্ষমতা অর্জনের পাশাপাশি পঞ্চম ডোমেইন সাইবারস্পেস-যুদ্ধ মোকাবেলার প্রস্তুতি নিচ্ছে।
বিশ্বে এ যুদ্ধের অস্ত্রকে বলা হচ্ছে লজিক বোমা। কেউ কেউ একে ‘ডিজিটাল কন্টিনেন্টাল ব্যালেস্টিক মিসাইল’ হিসেবেও আখ্যায়িত করছেন। এযুদ্ধে প্রযুক্তি পণ্যে প্রোগ্রামিং কোড সংযোজন, সফটওয়্যার টেম্পার ও ওয়েবসাইট হ্যাক করে মেধাস্বত্ব, তথ্য ও ডাটা চুরি করা হচ্ছে।
আবার কম্পিউটার-ইন্টারনেট ব্যবস্থা পুরোপুরি অচল করে দেয়া হয়। ২০১৩ সালে যুক্তরাষ্ট্রভিত্তিক সাইবার নিরাপত্তা প্রতিষ্ঠান ম্যাকাফি ও সেন্টার ফর স্ট্রাটেজিক অ্যান্ড ইন্টারন্যাশনাল স্টাডিজের এক গবেষণায় বলা হয়েছে, মেধাস্বত্ব ও ব্যবসায়িক তথ্য চুরি, সাইবার অপরাধ, সেবা প্রদানে বাধা, হ্যাকিং ইত্যাদি কারণে বিশ্বে ক্ষতির পরিমাণ প্রায় ৩০০ বিলিয়ন মার্কিন ডলার।
২০১৪ সালে ইনটেল সিকিউরিটির প্রতিবেদনে বলা হয়, বিশ্বে সাইবার আক্রমণজনিত আর্থিক ক্ষতির পরিমাণ ৩৭৫ বিলিয়ন মার্কিন ডলার।
অবশ্য বাংলাদেশ এখনো ঝুঁকিতে পড়েনি। কেননা বাংলাদেশে কম্পিউটার-ইন্টারনেটকেন্দ্রিক সাইবার জগৎ গড়ে উঠেছে দেরিতে। ১৯৯২ সালে বিনামূল্যে আন্তর্জাতিক সাবমেরিন ক্যাবলে যুক্ত হওয়ার প্রস্তাব ফিরিয়ে দেয়ার কারণেই আমাদের সাইবার জগতে প্রবেশে দেরি হয়েছে।
প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ২০০৮ সালের ডিসেম্বরে জাতীয় নির্বাচনের প্রাক্কালে ডিজিটাল বাংলাদেশ বিনির্মাণের ঘোষণা দেন। ২০০৯ সালের জানুয়ারিতে সরকার গঠন করেই ডিজিটাল বাংলাদেশ বিনির্মাণের ঘোষণা দেন।
এরপরেই দেশে কম্পিউটার-ইন্টারনেটকেন্দ্রিক সাইবার জগতে প্রবেশের পথ প্রশস্ত হয়। রাজনৈতিক অঙ্গীকার থাকায় দেশের প্রায় সব ক্ষেত্রেই তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তির ব্যবহার প্রসারিত হয়েছে।
এখন বিদ্যুৎ কেন্দ্র, শিক্ষা, স্বাস্থ্য, কৃষি ও আর্থিক ব্যবস্থাপনায় কম্পিউটার-ইন্টারনেট ব্যবহূত হচ্ছে। কম্পিউটার-ইন্টারনেট চালিত ব্যবস্থাকে সুরক্ষিত ও নিরবচ্ছিন্ন করার জন্য ইতোমধ্যেই অনেক দেশ পদক্ষেপ গ্রহণ করেছে।
এলআইসিটি প্রকল্পের পরামর্শক আরও জানান, অবশ্য দেশে সাইবার ক্রাইম প্রতিরোধ আড়াই হাজার সরকারি কর্মকর্তাকে উন্নত প্রশিক্ষণ দিচ্ছেন। বিশ্বব্যাংক এলআইসিটি প্রকল্পের অধীনে এজন্য ৫৬০ কোটি টাকা ঋণ সহায়তা দিচ্ছে।
যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট বারাক ওবামা নিজ দেশের ডিজিটাল অবকাঠামোকে ডিজিটাল সম্পদ এবং স্ট্রাটেজিক ন্যাশনাল সিকিউরিটি হিসেবে ঘোষণা করেছেন।
বিভিন্ন দেশ বিস্ময়কর প্রাযুক্তিক দক্ষতা কাজে লাগিয়ে প্রতিদ্বন্দ্বী রাষ্ট্রগুলোর অতি গোপনীয় নথিপত্র ফাঁস করছে। প্রতিনিয়তই তাদের হস্তগত হচ্ছে অনেক গোপনীয় নথি।
এজন্য ডিজিটাল বাংলাদেশ বিনির্মাণের অভিযাত্রায় গড়ে ওঠা সাইবার জগৎ আক্রান্ত হলে তা সঙ্গে সঙ্গে প্রতিহত করার সামর্থ্য তৈরির ওপর আমাদের গুরুত্ব দেওয়ার সময় এসেছে। । নইলে লজিক বোমায় আমাদের কম্পিউটার সিস্টেম, ওয়েবসাইট ও সফটওয়্যার সবই অকেজো হয়ে যেতে পারে। এজন্য সবিশেষ গুরুত্ব দিতে হবে- আমদানিকৃত প্রযুক্তিপণ্যে বিশেষ করে সফটওয়্যারে প্রতিরক্ষাসহ গুরুত্বপূর্ণ তথ্য ও ডাটা চুরির সংযোজিত প্রোগ্রামিং কোড চিহ্নিত করার দক্ষতা অর্জন।
পাশাপাশি কম্পিউটার সিস্টেমের দুর্বলতা খুঁজে বের করার জন্য ইথিক্যাল হ্যাকিংয়ের আইনি ভিত্তি দেয়া, সার্টিফায়েড ইথিক্যাল কোর্স চালু করার ব্যবস্থা, সাইবার সংক্রান্ত গোয়েন্দা তত্পরতা মোকাবেলায় কাউন্টার সাইবারইন্টেলিজেন্স (সিআই) গড়ে তোলা, সাইবার সিকিউরিটি এক্সপার্ট তৈরির লক্ষ্যে ব্যাপক প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা।
বাংলাদেশ সময়: ০৮২৭ ঘণ্টা, আগস্ট ১৫, ২০১৫
সম্পাদনা: জেএম