তথ্য এক: জাতিসংঘ সাধারণ অধিবেশন কাভার করতে অনলাইন সংবাদমাধ্যমের প্রতিনিধিদের জন্য ’৬০ শতাংশ নিজস্ব কনটেন্ট’ কে অন্যতম ক্রাইটেরিয়া হিসেবে নির্দিষ্ট করা হয়েছে।
তথ্য দুই: আর অনলাইনে কোনও লেখা কপি পেস্ট কিংবা কাট পেস্ট করলে জেকোয়েরির মাধ্যমে তা ধরে ফেলা যায়।
মূলধারার অনলাইন সাংবাদিকতা চর্চার জন্য এ দুটিই আশার সংবাদ। আর ব্যাঙের ছাতার মতো গজিয়ে ওঠা অনলাইনগুলোর জন্য সতর্ক বার্তা বটে।
অনলাইনে যারা কনটেন্ট চুরি করেন তাদের দিনগুলো যত দ্রুত মধুর হয়ে উঠেছিলো তত দ্রুতই বুঝি এবার তেতো হয়ে যাবে।
সরকারি অফিসের কেরাণি, রাজনৈতিক দলের ছিঁচকে নেতা, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের অযোগ্য শিক্ষক, কম্পিউটার দোকানের অপারেটর, আর বিভিন্ন সংবাদমাধ্যমের ‘ধান্দাবাজ’ সংবাদকর্মীরা এরই মধ্যে তাদের নিজ নিজ অনলাইন খুলে সম্পাদক বনে গেছেন তাদের জন্যই তা প্রযোজ্য।
আর তাদের জন্যও, যারা প্রধানসারির সংবাদপত্র বটে, কিন্তু অনলাইন তাদের বাই প্রোডাক্ট, যাদের নিজেদের কর্মীবাহিনী রয়েছে কিন্তু তারা দিনশেষে কপি জমা দিতেই অভ্যস্ত। এই সংবাদমাধ্যমগুলোও তাদের অনলাইন ভার্সনে দিনভর মুলধারার অনলাইন থেকে কাট-কপি-পেস্ট মেরে নিজেদেরকে উপরের দলে ভিড়িয়েছে।
একটি মিডিয়া তার ভিত গড়ার পর্যায়ে কতটা ফালতুভাবে গড়ে উঠে পুরো জগতটিকে ক্ষতিগ্রস্ত করতে পারে তার অন্যতম উদাহরণ হতে পারে বাংলাদেশের অনলাইন সংবাদমাধ্যম।
একটি ঘটনা ঘটার পর তার খবর অনলাইনে প্রকাশ করার যে কর্মযজ্ঞ তা কাজটি যাদের হাতে হয় তারাই ভালো বলতে পারবেন। ঘটনার খবর আসার সঙ্গে সঙ্গে ঘটনাস্থলে ছুটে যাওয়া, প্রাথমিক তথ্যের ভিত্তিতে প্রথম রিপোর্ট দেওয়া। এরপর ঘটনা যতই সামনে এগুবে ততই বারবার তার আপডেট দেওয়া, পূর্ণাঙ্গ তথ্য নিয়ে সবশেষে একটি পূর্ণাঙ্গ রিপোর্ট লেখা অনলাইন সংবাদমাধ্যম কর্মীর কাজ।
এর সঙ্গে যুক্ত থাকে একটি সদাসচল বার্তাকক্ষ। অনলাইন মানে গোটা পৃথিবী তার পঠনস্থল, আর গোটা পৃথিবী যখন টার্গেট তখনতো তাকে ভৌগলিক অবস্থান, পৃথিবী-সূর্যের গতি-প্রকৃতি মেনে চব্বিশ ঘণ্টাই জেগে থাকতে হয়। কারণ পৃথিবীর এপীঠ যখন জেগে থাকে ওপীঠ তখন ঘুমায়। আর ওপীঠ জেগে উঠলে এপীঠ ঘুমিয়ে পড়ে।
মজার ব্যাপার হচ্ছে কাট-কপি-পেস্ট ওয়ালারা কিন্তু আবার চব্বিশ ঘণ্টায় বিশ্বাসী নন। তারা দিনভর কপি-পেস্ট করে রাতভর ঘুমান। তাতে হয়তো মূলধারার অনলাইনগুলো একবেলা অত্যাচার থেকে বাঁচে। কিন্তু এই দিনের কাজীদের এক বেলার কাজই গোটা মাধ্যমটিকে শক্ত ভিতের ওপর দাঁড় হতে দিচ্ছে না। যা কিন্তু প্রতিরোধ করতেই হবে।
একটি মূল ধারার অনলাইনে কোনও খবর প্রকাশিত হলে তা নিমেষে কপি হয়ে প্রকাশিত হয় শত শত অনলাইনে। গুগল সার্চ ইঞ্জিন এক দারুণ আবিষ্কার, এই বিষয়গুলো শনাক্ত করার জন্য। কিন্তু হলে কি হবে? তাদের তো আর পাকড়াও করা যাচ্ছে না!
মাঝে মধ্যে অনলাইনের নিচে নম্বর থেকে ফোন করে দেখা গেছে সম্পাদক বলছেন ভাই আমিতো এখন অফিসে, কথা বলতে পারবো না। অফিসে থাকলেতো ভালোই, আপনার অফিস কোথায়? সচিবালয়ে। কি করেন? .... মন্ত্রণালয়ের কম্পিউটার অপারেটর।
....২৪ডটকম কি আপনি চালান নাকি? জ্বী। আমিই চালাই।
কপি পেস্ট করেছেন নিউজ? অকপট স্বীকার করে নেন, জ্বী করেছি। ভাই আপনারা বড়। আপনাদের নিয়ে আমরা একটা অনলাইন চালাই। একটা দুইটা বিজ্ঞাপনে কিছু টাকা আসে। এত রাগ করেন ক্যান।
এমন অনেক ফোন কলে জানা যায়, অনলাইনের মালিক ছাত্রলীগের কোনও এক নেতা। একজনকে নিয়োগ দিয়েছেন তার কাজ হচ্ছে কপি-পেস্ট করা। আর নেতা বিজ্ঞাপন হান্টে আছেন!
সর্বোচ্চ ধমকে দেওয়া যায়, বারণ করা যায়। কিন্তু আছে কী কোনও আইনি ব্যবস্থা নেওয়ার সুযোগ? নেই। কারণ আমাদের যে আইসিটি আইন তা এ ব্যাপারে কোনও কথা বলেনি। কপিরাইট আইন রয়েছে। কিন্তু সে আইন প্রণয়নের সময় অনলাইন ছিলো না। ফলে ফাঁক রয়েছে। আর অনলাইন নীতিমালা বলতে যা তৈরি হচ্ছে তাতে এ ব্যাপারে নয়, বরং অনলাইন রেজিস্ট্রেশন করতে হলে সরকারকে কত টাকা দিতে হবে সে নিয়েই বেশি গুরুত্ব।
দেশে হয়তো সমাধান মিলবে না। কিন্তু একটি খবর অবশ্যই জানিয়ে রাখা যায়- Internet Corporation for Assigned Names and Numbers (আইক্যান) নামের একটি আন্তর্জাতিক প্রতিষ্ঠান রয়েছে সেখানে নালিশ ঠুকে দিলে, অপরাধ নিশ্চিত করে ডোমেইন নেম রেজিস্টেশন বাতিল করে দেওয়া হয়। অনলাইন বিষয়ক সালিশ-মিমাংসা এই আইক্যানের একটি অন্যতম কাজ।
আর চুরি ধরার জন্য তৈরি হয়েছে অনেক অনেক সফটওয়্যার। প্ল্যাগস্ক্যান.কম, ডুপ্লিচেকার.কম, সফটোনিক.কম এমন বেশ কিছু নাম রয়েছে। চোর যত বাড়বে, তাদের ধরার সফটওয়্যারও ততই উন্নত হবে।
নতুন নতুন অনলাইন সংবাদমাধ্যম নিয়ে দেশে অনলাইন সাংবাদিকতা চর্চার পথিকৃৎ বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম’র এডিটর ইন চিফ আলমগীর হোসেনের মত- ‘শত ফুল ফুটতে দাও’। কিন্তু শত ফুল কোথায়? এতো সব পরগাছা! যা বাড়তে দেওয়া হলে এক সময় মূল শক্তিকেই বিপাকে ফেলে। যা তারা এরই মধ্যে করছেও। দেশে অনলাইন সংবাদমাধ্যম তার যাত্রার একটি দশক পার করেছে মাত্র। এরই মধ্যে তা আগাছা-পরগাছায় ভরপুর।
বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম দেশের সবচেয়ে বড় অনলাইন সংবাদমাধ্যম। দিনে তিন শতাধিক ছোটবড় খবর ছাড়াও খেলা, বিনোদন, ফিচার, লাইফস্টাইল, স্বাস্থ্য, ভ্রমণ আরও প্রায় দু’শ বিভিন্ন ধরনের সংবাদ-বিনোদনের আইটেম প্রকাশিত হয় এই পোর্টালে। আর তা নিশ্চিত করতে কাজ করে প্রায় আড়াইশ’ কর্মী। সেন্ট্রাল অফিসে রয়েছে ৪৫ সদস্যের রিপোর্টিং টিম, ১৫ সদস্যের ফটোগ্রাফি টিম, দেশের গুরুত্বপূর্ণ জেলা শহরে স্টাফ করেসপন্ডেন্ট স্ট্যাটাসে কাজ করছেন আরও অন্তত ১৫ জন। চট্টগ্রামে রয়েছে ১৫ সদস্যের ব্যুরো অফিস, সবগুলো বিভাগীয় শহরেই দুই কিংবা ততোধিক নিজস্ব প্রতিবেদক, ফটো সাংবাদিক আর প্রতি জেলায় ও গুরুত্বপূর্ণ উপজেলায় নিজস্ব করেসপন্ডেন্ট। কেন্দ্রীয় অফিসে শতাধিক কর্মী দিয়ে বার্তাকক্ষ পরিচালিত হয়। এসব কিছু মিলিয়ে একটি বড় শক্তি নিয়ে কাজ করে এই সময়ে পাঠকের অব্যাহত চাহিদা পূরণ করে যাচ্ছে বাংলানিউজ।
আর নিতান্তই পরিতাপের বিষয় এইসব কনটেন্ট প্রকাশ হওয়া মাত্র চুরি হয়ে প্রকাশিত হচ্ছে মূল ধারার সংবাদপত্রের অনলাইন ভার্সনসহ দেশে ব্যাঙের ছাতার মতো গজিয়ে ওঠা অনলাইনগুলোতে।
তবে হ্যাঁ জাতিসংঘ যখন ‘নিজস্ব কনটেন্ট’ ক্রাইটেরিয়া নির্ধারণ করেছে, তখন আশার আলো দেখা যাচ্ছে। এক সময় দেশেও তৈরি হবে এই ক্রাইটেরিয়া। বলা হবে নিজের ৬০ শতাংশ কনটেন্ট না থাকলে, অফিস না থাকলে, নির্দিষ্ট সংখক নিযুক্ত সাংবাদিক না থাকলে, আর মানসম্মত সাংবাদিকতার চর্চা না করলে তাদের অনলাইন কোনও স্বীকৃতি পাবে না।
সেদিন হয়তো দূরে নয়। আবার হয়তো দূরেই। কারণ আমরা পাল্টাবো, এমন কোন আচরণ কী দেখাতে পারছি?
দেশের একসময়ের দৈনিক সংবাদপত্রে বেশ নাম করেছেন এমন একজন সম্পাদক একদিন জানতে চাইলেন, কিভাবে অনলাইনকে জনপ্রিয় করা যায়। তাকে বলেছিলাম, নিজস্ব কনটেন্ট দিয়ে চালাতে হবে। প্রয়োজনে পাঁচটি খবর দিয়ে শুরু করতে হবে, এরপর দশটি, বিশটি- ত্রিশটি। তবে সব হতে হবে সম্পূর্ণ নিজেদের তৈরি খবর। আন্তর্জাতিক খবর হলেও তা হতে হবে নিজেদের বার্তাকক্ষে অনুদিত। বললেন, সেটাই ঠিক। কিন্তু বাস্তবে কি হচ্ছে- ওই সম্পাদকের সম্পাদিত দৈনিকের পাশাপাশি একটি অনলাইন সচল রয়েছে। যা কাট-কপি-পেস্ট ভিত্তিতে আজও চলছে। জানা নেই কবে থামবে।
উদ্বেগটা অনলাইন কনটেন্ট নিয়েই!
বাংলাদেশ সময় ১২৪৫ ঘণ্টা, সেপ্টেম্বর ১০, ২০১৫
এমএমকে