অনলাইনে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমের সঙ্গে মূলধারার সংবাদমাধ্যমের সম্পর্কটি যেমন স্বাভাবিক, তেমনই জটিল। এ দুটি একে অপরের পরিপূরক।
পরিপূরক এই অর্থে ফেসবুকের দেয়ালে লক্ষ খবরের ছড়াছড়ি। হাজারো সংবাদমাধ্যমে প্রকাশিত খবরের পোস্ট দেখা যায় এই ক্যানভাসে। সে অর্থে ফেসবুকের মূল আধেয়ই হয়ে উঠেছে নিউজ ফিডগুলো। অন্যদিকে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম হিসেবে ফেসবুক হয়ে উঠেছে মূল ধারার সংবাদমাধ্যমের অনেক খবরের উৎস। ফেসবুকে প্রকাশিত অনেক তথ্য-ভিডিও, স্ট্যাটাস এখন সংবাদের প্রথম তথ্য। সামাজিক মাধ্যমকে যারা খবরের প্রাথমিক উৎস হিসেবে নিতে অনীহা দেখাবে তারা পিছিয়ে থাকবে নিঃসন্দেহে।
সম্প্রতি কাজটি আরও সহজ করে তোলার উদ্যোগ নিয়েছে ফেসবুক। মূলধারার সংবাদমাধ্যমের জন্য খবরের একটি সত্যিকারের গতিশীল প্রাথমিক সোর্স হয়ে উঠতে চালু করেছে নতুন একটি অ্যাপ। নাম সিগন্যাল। সাংবাদিকরা যারা খবর খুঁজছেন তাদের কাছেই তা পৌঁছে দেবে ফেসবুক। এতে মূলধারার সংবাদমাধ্যম উপকৃতই হবে, খবরের খোঁজে নিজেকে ঘুরে না বেড়িয়ে মাউস ধরে স্ক্রল ডাউন আর আপ করলেই মিলে যাবে কোনও না কোনও খবর। আর ফেসবুকের সিগন্যাল নিজেই সাংবাদিকের দেয়ালে ধরা দেবে খবরের উৎস হয়ে।
কিন্তু সেখানেই শেষ কথা নয়। আর তাতে বিমোহিত হওয়ারও কিছু নেই। একই সঙ্গে ফেসবুক চালু করছে ট্রেন্ডিং আর ইনস্ট্যান্ট আর্টিকেলস নামে দুটি নতুন সার্ভিস। এতে দেখা যাচ্ছে ফেসবুক আসলে তার দেয়াল ছেড়ে অনলাইন বিচরণকারীকে আর কোথাও যেতে দিতে নারাজ।
জটিল দিকটি সেখানেই। এই যে আটকে রাখা, তা কিন্তু মূল ধারার সংবাদ মাধ্যমের জন্য বড় হুমকির। পাঠক যখন ফেসবুকেই পেয়ে যাবে তার প্রয়োজনীয় নিউজ ফিড তখন সে আর অনলাইন সংবাদ মাধ্যমে ঢুকতে চাইবে না, কিংবা প্রয়োজন বোধ করবে না। ফেসবুকের নতুন নতুন ফিচারগুলো কিন্তু সেভাবেই তৈরি হচ্ছে। এতে একটি মূলধারার সংবাদমাধ্যম হয়তো তার তৈরি খবরের পাঠক পাবে কিন্তু তা যোগ হবে না নিজস্ব টিআরপিতে।
সঙ্কটটি নতুন নয়। দিন কয়েক আগেও একটি লেখায় উল্লেখ করেছি, একজন বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষার্থী বলছিলেন, আমিতো নিউজ পড়ি। কোথায় পড়েন? সে প্রশ্নের সরাসরি উত্তর- কেনো ফেসবুকে!!!
ফেসবুক ‘ট্রেন্ডিং’ কিংবা ‘ইনস্ট্যান্ট আর্টিকেলস’ এর মতো নতুন ফিচার চালু করে এমন পাঠক বাড়াবে বৈ কমাবে না।
তাহলে উপায়! এমনিতেই সামাজিক এই যোগাযোগ মাধ্যমটি মূল ধারার সংবাদমাধ্যমের জন্য আগে থেকেই হুমকি হয়েছিলো। এই অর্থে যে, এটি এমন একটি মাধ্যম যেখানে নেটিজেনরা একবার ঢুকে পড়লে হাজারো রকমফের কনটেন্টের ভীরে হারিয়ে যায়। সেই কনটেন্টের অনেক কিছুই স্রেফ মজার স্রেফ সময় কাটানোর। মন যা চায় তাই যেহেতু করা যায়, সেহেতু তার কনটেন্টও হয় তেমনই অন্যের মনের খোড়াক যোগানো। আর সে কারণে সামাজিক এই যোগাযোগ মাধ্যমের ব্যবহারকারীর সংখ্যা শনৈ শনৈ বাড়তে থাকে।
আর মূলধারার সংবাদমাধ্যমগুলো নিজেদের ফেসবুক পেজ তৈরি করে এই ক্রমবর্ধমান পাঠকদের মধ্য থেকে নিজেদের পাঠক টানার চেষ্টা করে। তাতে সুফল আসে না, তা নয়। মিলিয়ন মিলিয়ন ফেসবুক ফ্যান তৈরি হয় একেকটি সংবাদমাধ্যমের। তারা ফেসবুকে ঢুকলেই দেখতে পায় এসব সংবাদমাধ্যমের নিউজফিডগুলো।
বলা যায় এ একরকম তৈরি পাঠক। কেউ সংবাদমাধ্যমটি পড়তে নয়, বরং ফেসবুকের পাঠক হিসেবে অনলাইন ব্রাউজ করছে। আর সংবাদমাধ্যমটি সেখান থেকে পাঠক হান্ট করছে।
একটি মূলধারার অনলাইন সংবাদমাধ্যমের নিজস্ব পাঠক গড়ে উঠবে এটাই প্রত্যাশা। কিন্তু ফেসবুক বা টুইটারের ওপর নির্ভরতা এই নিজস্ব পাঠক গড়ে তোলার ক্ষেত্রে বাধা বৈকি।
এই যখন অবস্থা তখন ফেসবুক সম্প্রতি ঘোষণা দিয়েছে আরেকটি নতুন অ্যাপ্লিকেশনের। নাম দেওয়া হয়েছে মেনশনস অ্যাপ। যা আসলে ফেসবুকের নিজস্ব সাংবাদিক গোষ্ঠী তৈরিরই একটি প্রাথমিক যাত্রা। তাহলে কি ফেসবুক আর সামাজিক মাধ্যম থেকে সংবাদমাধ্যমে রূপ নিচ্ছে?
কীভাবে নয়? মেনশনস অ্যাপ চালু করে ফেসবুক টার্গেট করেছে পেশাদার কনটেন্ট তৈরিকারকদেরই। এরই মধ্যে তারা সাংবাদিক ও সেলিব্রেটিদের মধ্যে যাদের পেজ ভেরিফায়েড তাদের কাছে এই মেনশনস অ্যাপ পাঠিয়ে দিয়েছে। যাতে ওই সাংবাদিকরা তাদের নিজস্ব খবর, ভিডিও কনটেন্ট ফেসবুকে লাইভ পোস্ট করতে পারেন। যাতে তা চলে যাবে তাদের নিজেদের ফলোয়ারদের কাছে।
আবারও সেই শত্রু-মিত্রতা প্রসঙ্গ। সিগন্যাল অ্যাপ দিয়ে ফেসবুক সাংবাদিকদের নিউজফিডগুলো খুঁজে বের করতে সহযোগিতা করছে। ট্রেন্ডিং নাউ অ্যাপ দিয়ে সাংবাদিকরা মনিটর করতে পারছেন বা বুঝতে পারছেন কোন ধরনের খবরে বা কনটেন্টে পাঠকের বেশি আগ্রহ, বা তাদের বেশি সময় লটকে থাকা। একে নিঃসন্দেহে বড় সহযোগিতা বলা চলে। কিন্তু
মেনশনস অ্যাপটি মূলত ফেসবুককে নিজেকেই তৈরি করবে একটি বড় নিউজ হাবে। ইনস্ট্যান্ট অার্টিকেলস দিয়ে ফেসবুকেই প্রকাশিত হয়ে যাবে পূর্ণাঙ্গ খবর বা নিবন্ধ।
তাহলে প্রশ্ন- কে পড়বে খবরের মূল সাইটগুলো?
আরেকটি তথ্য দেওয়া যেতে পারে। গত কয়েকদিন ফেসবুক তার পাতায় নিউজফিডগুলো মোট কতজন ব্যবহারকারীর কাছে পৌঁছেছে, কতজন শেয়ার করেছে তার পাশাপাশি কতজন লিংকটি খুলে দেখেছে তারও তথ্য দিতে থাকে। এতে দেখা যায়, কোনও কোনও লিংকের পাঠকের সংখ্যা শেয়ারকারী পাঠকের চেয়েও কম। আর তা মোট রিচের চেয়ে অনেক গুন কম।
ফেসবুকে যাদের দেওয়ালে খবরটি পৌঁছে তারা সবাই এর পাঠক নন। এমনকি যিনি শেয়ার করছেন তিনিও পড়ছেন না। এর অন্যতম কারণ ফেসবুকের অন্য কনটেন্টেই তাদের আগ্রহ বেশি। এরই মধ্যে ফেসবুক যদি নিজেই নিউজ হাবের ভূমিকায় অবতীর্ণ হয়, তাতে মূলধারার অনলাইন সংবাদমাধ্যমগুলো হুমকিতেই পড়বে।
অতএব সংবাদমাধ্যমকে নিজের পাঠক তৈরি করতে হবে। ব্র্যান্ড নেম নিজেকে পরিচিত করতে হবে। পাঠক যাতে নিজেই ইউআরএল ব্রাউজ করে, কিংবা সার্চ ইঞ্জিনে খুঁজে বের করে সংবাদটি বা সংবাদমাধ্যমটি পড়েন, ফেসবুক কিংবা টুইটারে নয়।
এখানে উল্লেখ্য, বাংলানিউজের মোট পাঠকের প্রায় ১৫ শতাংশ আসেন ফেসবুক থেকে। গুগলের মাধ্যমে আসেন ১৫ শতাংশ। আর মোট পাঠকের ৭০ শতাংশই সরাসরি banglanews24.com ব্রাউজ করে দেশের সবচেয়ে অগ্রসরমান সংবাদ পোর্টালটি পাঠ করেন।
বাংলাদেশ সময় ১৫০০ ঘণ্টা, অক্টোবর ০১, ২০১৫
এমএমকে