প্রযুক্তির এ যুগে আজ আমরা ঘরে বসেই কম্পিউটার কিংবা মোবাইলের মাধ্যমে একে অন্যের সঙ্গে যোগাযোগ রাখছি, তথ্য আদান-প্রদান করছি, এমনকি অর্থের লেনদেনও করতে পারছি। পড়াশোনা, বিনোদন এমনকি চাকরি করাও আজ অনলাইনে সম্ভব হয়েছে।
অনলাইনে ব্যবসা করতে অনেকেই আগ্রহী হলেও সঠিক নির্দেশনা না থাকায় কেউ শুরু করে বিপদে পড়ছেন, আবার কেউ কেউ শুরু করার সাহসই পাচ্ছেন না। এজন্য অনলাইনে ব্যবসা শুরুর আগে সবার উচিত এ বিষয়ে জেনে নেওয়া।
ই-কমার্স ব্যবসার সবচেয়ে সুবিধাজনক দিকগুলো হলো:
১. ব্যবসাটি অনলাইনভিত্তিক হওয়ায় শুরুতেই কোনো দোকান ভাড়া নেওয়া বা পজিশন কেনার প্রয়োজন নেই। এছাড়া পণ্য মজুদ করে রাখারও কোনো প্রয়োজন পড়ে না। আপনি অর্ডার পাওয়ার পর সেটি ১/২ দিনের মধ্যে আপনার পণ্যের উৎস থেকে জোগাড় করে ডেলিভেরি দিতে পারেন (যদিও সব ই-কমার্স প্রোডাক্টের ক্ষেত্রে এটি প্রযোজ্য হবে না)
২) যেহেতু ই-কমার্স ব্যবসা ওয়েবসাইটের মাধ্যমে হয়ে থাকে, তাই আপনার পণ্যগুলো ২৪ ঘণ্টা আপনার ক্রেতার দেখার সুযোগ থাকে। দোকানের মতো বন্ধ রাখার ব্যাপার নেই।
৩) আপনি সহজেই আপনার পণ্যগুলোকে ফেসবুক, টুইটার বা সার্চ ইঞ্জিনের মাধ্যমে সবার মধ্যে ছড়িয়ে দিতে পারেন, যা যেকোনো পত্রিকা-বিজ্ঞাপন বা পোস্টার-অ্যাডের চাইতে বেশি কার্যকর।
৪) ই-কমার্স ওয়েবসাইটের মাধ্যমে আপনি খুব সহজেই আপনার ক্রেতার জন্য প্রোমোশনাল অফার, ডিসকাউন্ট, কুপন কোড ইত্যাদি সুবিধা দিতে পারেন, যা আপনার ক্রেতাকে দোকান থেকে না কিনে বরং অনলাইনে আপনার ওয়েবসাইট থেকে কিনতে আগ্রহী করবে।
৫) অনলাইনে পণ্য অর্ডার দেওয়া ও পেমেন্ট করার নিরাপদ মাধ্যম থাকায় ক্রেতা যেমন সহজে যেকোনো জায়গা থেকে যেকোনো সময়ে পণ্য কিনতে পারেন, বিক্রেতাও তেমনি সহজেই ক্রেতার কাছ থেকে অর্থ বুঝে পেতে পারেন।
৬) ই-কমার্স ওয়েবসাইটের মাধ্যমে আপনি আপনার ক্রেতার প্রোফাইল, পণ্য ও পণ্যের মজুদ, কেনা-বেচার হিসাবমহ সব ধরনের তথ্যই জমা রাখতে পারেন। পাশাপাশি বিশ্লেষণ করার জন্য নানান গ্রাফ, চার্ট ও রিপোর্ট তৈরি করতে পারেন যা আপনার ব্যবসার জন্য ভবিষ্যৎ পরিকল্পনা করতে আপনাকে সাহায্য করবে।
এরকম আরও অনেক সুবিধা থাকার কারণে ই-কমার্স বর্তমানে অনেক জনপ্রিয় হয়ে পড়েছে। ই-কমার্স ব্যবসা শুরুর জন্য আপনাকে কিছু বিষয়ে খেয়ালে রাখতে হবে:
১) ওয়েবসাইট বানানোর সময় একদমই তাড়াহুড়ো করবেন না। আপনার পণ্য ও ব্যবসার গঠন অনুযায়ী যদি ওয়েবসাইট তৈরি না হয়, তখন পরবর্তীতে ওয়েবসাইট পরিবর্তন করা বা ব্যবসা চালানো খুব কঠিন হয়ে পড়বে। হয়তো দেখা যাবে, ওয়েবসাইটটি নতুনভাবে তৈরি করতে হচ্ছে। তাই যে কোম্পানি/ব্যক্তি আপনার ওয়েবসাইটটি তৈরি করছেন, তাকে আপনার ব্যবসার ধরন, বিক্রির কৌশল, ভবিষ্যৎ পরিকল্পনা এগুলো খুব ভাল করে বোঝাতে হবে। অল্পকিছু অর্থ বাঁচানোর জন্য কম টাকায় বা কাঁচা হাতে আপনার ব্যবসার ওয়েবসাইটটি তৈরি করতে দেওয়া একদমই ঠিক নয়।
২) আপনার ব্যবসার ওয়েবসাইটটি যতোটা সম্ভব সুন্দর ও সহজভাবে গোছাতে হবে। এটি মাথায় রাখবেন, সবাই যে ওয়েবসাইট সম্পর্কে সমান জানবে এমন নয়। তাই পণ্য নির্বাচন করা, পণ্যের বিস্তারিত দেখা, পণ্য অর্ডার দেওয়া, পেমেন্ট করা, সব ব্যাপারগুলো যেনো সুন্দর ও সহজভাবে ওয়েবসাইটে উপস্থাপন করা হয় সেটি খেয়াল রাখা জরুরি।
৩) যখন একজন ক্রেতা আপনার ওয়েবসাইটে অর্ডার করছেন বা পেমেন্ট করছেন তখন তার কিছু সংশয় থাকাটাই স্বাভাবিক কারণ, তিনি দৃশ্যমান কোনো দোকান/ব্যক্তির কাছে অর্ডারটি দিচ্ছেন না। তাই, নির্ধারিত সময়ের মধ্যে ক্রেতার সঙ্গে যোগাযোগ করা, পণ্য সম্পর্কে ক্রেতার প্রশ্নগুলোর উত্তর দেওয়া, ক্রেতাকে তার পণ্যের বিল দেওয়া, সময়মতো পণ্য পৌঁছে দেওয়া- ইত্যাদি নিশ্চিত করতে হবে।
৪) আপনার ওয়েবসাইট যেহেতু আপনাকেই দেখাশোনা করতে হবে তাই ওয়েবসাইট ম্যানেজমেন্টের জন্য যথাযথ ট্রেনিং নেওয়া বা উপযুক্ত ট্রেনিং রয়েছে এমন কাউকে ওয়েবসাইট দেখবার জন্য নিযুক্ত করা খুবই প্রয়োজন। বর্তমানে বাংলাদেশে অনেক প্রতিষ্ঠান রয়েছে যারা ই-কমার্স ওয়েবসাইট তৈরি বা ম্যানেজমেন্টের উপর নানা ধরনের ট্রেনিং দিয়ে থাকে (যেমন: www.piit.us)।
৫) আপনার ই-কমার্স ওয়েবসাইটকে কাস্টোমারের কাছে বিশ্বাসযোগ্য করার জন্য একটি উত্তম উপায় হলো, অর্ডার বা পেমেন্ট নেওয়া, কাস্টোমার রেজিস্ট্রেশন ইত্যাদির পর তাকে আপনার কোম্পানির নাম ব্যবহার করে একটি এসএমএস ও ইমেইল কনফার্মেশন পাঠানো। এতে আপনার ক্রেতা নিশ্চিত থাকেন, যে প্রতিষ্ঠানে তিন লেনদেন করছেন তা নির্ভরযোগ্য। পাশাপাশি আপনার ওয়েবসাইটটি যদি একটি নির্ভরযোগ্য পেমেন্ট গেটওয়ের (যেমন: www.sslcommerz.com) সঙ্গে সংযুক্ত থাকে তাহলে আপনার ক্রেতা আপনাকে পেমেন্ট করতেও অনেক নিরাপদবোধ করেন।
৬) বর্তমানে দেশে অনেক ই-কমার্স ওয়েবসাইট রয়েছে। তাই আপনার ওয়েবসাইটটি আসলে কী ব্যতিক্রমধর্মী সেবা দিতে পারে সেটি চিন্তা করতে হবে। বিভিন্ন রকম ডিসকাউন্ট অফার, কুপন কোডের ব্যবস্থা, ক্রয়ের উপর ক্রেতাদের পয়েন্ট দেওয়া ও পরে সেই পয়েন্টের উপর ভিত্তি করে উপহার দেওয়া- ইত্যাদির ব্যবস্থা নেওয়া যেতে পারে।
৭) আপনার ই-কমার্স ওয়েবসাইটটির প্রচার ও প্রসারের জন্য সবচেয়ে জনপ্রিয় ও লাভজনক মাধ্যম হলো ফেসবুক অ্যাড বা অ্যাফিলিয়েট মার্কেটিং। ফেসবুক অ্যাডের মাধ্যমে আপনি চাইলে অতি সহজেই আপনার ওয়েবসাইটকে মানুষের মধ্যে ছড়িয়ে দিতে পারেন। আর অ্যাফিলিয়েট মার্কেটিং চালু করার মাধ্যমে আপনি আপনার পণ্য বিক্রির জন্য কমিশনের ভিত্তিতে অনলাইন এজেন্ট নিযুক্ত করতে পারেন। এভাবে আপনার ই-কমার্স ব্যবসা দ্রুত ছড়িয়ে পড়বে।
যেকোনো কাজের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ দিক হলো, সেই কাজটি নিয়ে লেগে থাকা ও ধৈর্য সহকারে চেষ্টা করে যাওয়া। আপনি যদি প্রথমেই লাভ পেতে চান তাহলে ভুল হবে। জানতে, বুঝতে ও সে অনুযায়ী কাজ করতে সময় নিন এবং চেষ্টা করুন, অবশ্যই সফল হবেন।
(পরবর্তী লেখায় ই-কমার্স ব্যবসায় সফল হওয়ার কৌশলের উপর আরও বিস্তারিত আলোচনা করা হবে)
নির্ঝর আনজুম
ফ্যাকাল্টি প্রধান, পিপলএন্ডটেক ইনস্টিটিউট অব ইনফরমেশন টেকনোলোজি
স্পেশালিস্ট, সফটওয়্যার সপ লিমিটেড
বাংলাদেশ সময়: ১৩১৮ ঘণ্টা, ফেব্রুয়ারি ১১, ২০১৬
এসএস