বাংলাদেশের আইসিটি খাতকে বিশ্ব পরিমন্ডলে সম্মানজনক স্থানে নিয়ে যেতে তথ্যপ্রযুক্তি শিল্পের শীর্ষ সংগঠন বাংলাদেশ অ্যাসোসিয়েশন অব সফটওয়্যার অ্যান্ড ইনফরমেশন সার্ভিসেস (বেসিস) এ যাবত নানা ধরনের পদক্ষেপ নিয়ে আসছে। বিদেশি বিনিয়োগের জন্যও সংগঠনটি সর্বোচ্চ চেষ্টা করছে।
কিন্তু এদেশের আইটি খাতে বিদেশি কোম্পানিগুলোর একক প্রভাব যা দেশিয় প্রতিষ্ঠানগুলোর অধিকার হনন করছে, আবার নিরাপত্তার দিকটিও হুমকির মধ্যে। সম্প্রতি দেশে ১০০ মিলিয়ন হ্যাকিংয়ের অঘটনটাও ঘটেছে এ কারণেই অর্থাৎ এটি বিদেশি কোম্পানিগুলোর প্রভাব বিস্তারের ফল। দেশের প্রচন্ড সম্ভাবনময়ী এ খাতটি সম্পর্কে এমন সব উদ্বেগজনক তথ্য তুলে ধরার পাশাপাশি কিভাবে রক্ষা করা যায় তার সমাধান-পরামর্শ দিয়েছেন বেসিস সভাপতি, এফবিসিআই পরিচালক, ফেনক্স ভেঞ্চার ক্যাপিটালের জেনারেল পার্টনার
শামীম আহসান।
তার মতামত কলামটি বাংলানিউজের পাঠকের জন্য উপস্থাপন করা হলো।
--লক্ষ্য যখন বড়, তখন বাস্তবায়নের কলাকৌশলটাও সবচেয়ে ভালোটা থাকা চাই। সত্যিকার অর্থে স্থানীয় বাজার উন্নয়নে দেশিয় কোম্পানির প্রাধান্য প্রয়োজন, সেখানে বর্তমানে বিদেশি কোম্পানিগুলো একচেটিয়া ব্যবসা করে যাচ্ছে। ফলে দেশিয় নিরাপত্তাসহ গুরুত্বপূর্ণ বিভিন্ন নথি বিদেশিদের কাছে চলে যাচ্ছে। ঘটছে প্রায় ১০০ মিলিয়ন ডলারের হ্যাকিংয়ের মতো অঘটন। এ অবস্থা থেকে পরিত্রাণ পেতে অবশ্যই স্থানীয় প্রতিষ্ঠানের হাতে তথ্যপ্রযুক্তি খাতের নেতৃত্ব প্রতিষ্ঠা করতে হবে।
আমরা দেশিয় প্রতিষ্ঠানগুলোর প্রসার চাই। কিন্তু আমরা এটা দেখতে পাই যে, বিদেশি অর্থায়নে সরকারি আইসিটি প্রকিউরমেন্টে বিদেশি দাতা সংস্থাগুলো এমন সব কঠিন শর্ত জুড়ে দেয়, যা শুধু বিদেশি প্রতিষ্ঠানগুলোর অংশগ্রহণে সহায়তা করে অন্যদিকে দেশের প্রতিষ্ঠানগুলো অংশগ্রহণে ব্যর্থ হয়। ফলে বেশিরভাগ ক্ষেত্রে এসব টাকা বিদেশে চলে যায়।
অথচ সিঙ্গাপুর, মালয়েশিয়া, ইন্দোনেশিয়া, ভিয়েতনাম, চীন, ভারতসহ বিশ্বের অনেক দেশের নীতিমালা ও আইনেই বলা আছে, পাবলিক প্রকিউরমেন্টের ন্যূনতম ৫০ শতাংশ দেশি কোম্পানি দিয়ে করাতে হবে। তাই দেশিয় আইটি কোম্পানিকে অগ্রাধিকার দিতে আইন ও নীতিমালা প্রণয়ন প্রয়োজন। এর ফলে আমরা প্রতি বছর কয়েকশ' মিলিয়ন ডলারের সফটওয়্যারসহ তথ্যপ্রযুক্তি সেবা আমদানি না করে স্থানীয় সফটওয়্যার ব্যবহার ও আরও শক্তিশালী আইসিটি ইন্ডাস্ট্রি তৈরি করতে পারব। স্থানীয় বাজার উন্নয়নে ইতিমধ্যেই বেসিসের পক্ষ থেকে পাবলিক প্রোকিউরমেন্ট পলিসি ও অ্যাক্টে বেশ কিছু পরিবর্তন আনার সুপারিশ করা হয়েছে, যা প্রধানমন্ত্রী, প্রধানমন্ত্রীর আইসিটি উপদেষ্ঠা, পরিকল্পনা মন্ত্রী, আইসিটি প্রতিমন্ত্রী সমর্থন করেছেন।
সম্প্রতি বাংলাদেশ ব্যাংকের হ্যাকিংয়ের ঘটনাটি শুধু বাংলাদেশ নয়, বিশ্বব্যাপী তোলপাড় হয়েছে। ধারণা করা হচ্ছে শুধু অর্থ নয়, বাংলাদেশ ব্যাংকের বিভিন্ন তথ্যও হাতিয়ে নিয়েছে হ্যাকাররা। এর কিছুদিন আগে কয়েকটি ব্যাংকের এটিএম বুথে হ্যাকিংয়ের মাধ্যমে অর্থ লোপাট করা হয়। এসব ব্যাংক দামি বিদেশি সফটওয়্যার বা প্রযুক্তি ব্যবহার করে। দেশে ভালোমানের তথ্যপ্রযুক্তি কোম্পানি থাকা স্বত্বেও আমরা উচ্চ ব্যয়ে বিদেশি কোম্পানি ও বিশেষজ্ঞ আনছি। তাদের তৈরি বা পছন্দের সফটওয়্যার ব্যবহার করছি। ফলে দেশের গুরুত্বপূর্ণ তথ্যগুলো তাদের কাছে চলে যাচ্ছে। এক কথায় আমাদের তথ্য বিদেশিদের কাছে বেহাত হয়ে যাচ্ছে।
কিন্তু আমাদের দেশি কোম্পানিগুলোই আন্তর্জাতিকমানের সফটওয়্যারসহ তথ্যপ্রযুক্তি সেবা তৈরি করছে। “মাইক্রোসফট, ডেল, নকিয়া, স্যামসাং, ওয়েলস ফার্গো ব্যাংক, সিটি ব্যাংক এনএ, স্টান্ডার্ড চার্টার্ড ব্যাংক লিমিটেড, স্টেট ব্যাংক অব ইন্ডিয়া, এইচএসবিসিসহ বিভিন্ন ব্যাংকে বাংলাদেশে তৈরি সফটওয়্যার ও সেবা ব্যবহার করা হচ্ছে।
বাংলাদেশি প্রতিষ্ঠানগুলোর নাম ও প্রসার এখন বিশ্বব্যাপী বিস্তৃত। এসব প্রতিষ্ঠান একদিকে যেভাবে দেশের অর্থনীতিকে সমৃদ্ধ করছে, অন্যদিকে বিশাল জনগোষ্ঠির কর্মসংস্থানের সৃষ্টি করছে। অথচ আন্তর্জাতিকমানের এসব কোম্পানি থেকে আমাদের দেশের প্রতিষ্ঠানগুলো সেবা নিচ্ছে না। ফলে তাদেরকে বিভিন্ন ভোগান্তি পোহাতে হচ্ছে।
এ বিষয়ে সরকার এগিয়ে আসলে ও বিদেশে থেকে আমদানি করা সফটওয়্যার ও তথ্যপ্রযুক্তি সেবা নিরুৎসাহিত করতে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নিলেই দেশি কোম্পানিগুলো নেতৃত্বে চলে আসবে।
তাছাড়া বিদেশি যে সফটওয়্যারগুলো আমদানি করা হয় সেগুলো তারা বিক্রি করেই চলে যায়। সফটওয়্যারের সোর্স কোর্ড থাকে না, ফলে কাস্টোমাইজ করা যায় না। এমনকি বিক্রয় পরবর্তী সেবাও ভালোভাবে পাওয়া যায় না।
পাসপোর্ট, ন্যাশনাল আইডি কার্ডসহ দেশের বড় বড় প্রকল্প বিদেশিদের হাতে থাকায় আমাদের দেশের জনগনের তথ্য বিদেশিদের কাছে চলে যাচ্ছে। যেটা আমাদের দেশের জন্য নিরাপত্তা হুমকি হয়ে দাড়িয়েছে। তাই দেশের জনগনের মূল্যবান তথ্য নিরাপদভাবে সংরক্ষণের জন্য দেশিয় কোম্পানিকে কাজ দেওয়া ও এ বিষয়ে সরকারের সচেষ্ট হওয়া প্রয়োজন।
আমরা জানি, ভারতে টেলিকম, হেভি ইন্ডাস্ট্রি ও রিনিউয়েবল এনার্জি মন্ত্রণালয় দেশিয় পণ্য রক্ষার্থে বিদেশি পণ্য আমদানিতে প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করে আইন করেছে। টেলিকমের একটি বড় অংশে দেশি পণ্য কেনার জন্য বাধ্য করা, দেশি সকল টেলিকম কোম্পানির অংশগ্রহণ ইত্যাদি নিশ্চিত করেছে।
এছাড়া মালয়েশিয়া, সিঙ্গাপুর, থাইল্যান্ড ও তাইওয়ানের অর্থনৈতিক উত্থানের পেছনে কাজ করেছে দেশিয় বিনিয়োগে সর্বোচ্চ প্রাধান্য দেওয়ার নীতি। দেশগুলো আমদানি বিকল্প খাতে স্থানীয় উদ্যোক্তাদের নানা সহায়তা দিয়ে বিনিয়োগে আকৃষ্ট করার মধ্য দিয়ে দেশের অর্থনীতিকে প্রায় উন্নত দেশগুলোর সমান কাতারে নিয়ে যায়, বৈশ্বিক অর্থনীতিবিদদের কাছে যা ‘এশিয়ান মিরাকল’ নামে পরিচিত।
কিন্তু বাংলাদেশে দেখা যায় তার উল্টো চিত্র। নানা ঝুঁকি নিয়ে বিনিয়োগ করা শিল্পপতিদের চেয়ে বাড়তি সুবিধা ভোগ করছেন একই পণ্যের আমদানিকারক। এতে দেশি শিল্প যেমন ধ্বংস হচ্ছে, তেমনি আমদানি প্রাচুর্যের কারণে খরচ হচ্ছে মূল্যবান বৈদেশিক মুদ্রা। আমরা বিদেশি বিনিয়োগ চাই, তবে দেশিয় কোম্পানির টিকে থাকার জন্য কোনো বিদেশি কোম্পানি বাংলাদেশে কার্যক্রম শুরু করতে চাইলে তাদেরকে দেশি কোম্পানির সাথে নূণ্যতম ৫০ শতাংশ অংশীদারিত্বে কাজ করতে উৎসাহিত করতে হবে। এছাড়া টেন্ডারে অংশগ্রহণ করতে চাইলে ঐ পরিমাণ অংশীদারিত্বে বাধ্য করতে হবে। এতে লেভেল প্লেয়িং ফিল্ড তৈরি হবে।
আমরা প্রত্যাশা করি এসব সুপারিশ বাস্তবায়ন হলে ২০১৮ সাল নাগাদ ১ বিলিয়ন ডলার আয়ের লক্ষ্যমাত্রা অর্জিত হবে ও বৈদেশিক মুদ্রা আয়ের মাধ্যমে একসময় গার্মেন্টস খাতের মতো তথ্যপ্রযুক্তি খাত জাতীয় অর্থনীতিতে ভূমিকা রাখবে। দেশীয় কোম্পানির হাতেই থাকবে তথ্যপ্রযুক্তি খাত।
বাংলাদেশ সময়: ১৬৩৪ ঘণ্টা, এপ্রিল ১৮, ২০১৬
এসজেডএম