ঢাকা: আর কয়েক দিন পরই বেসিসের (বাংলাদেশ অ্যাসোসিয়েশন অব সফটওয়্যার অ্যান্ড ইনফর্মেশন সার্ভিসেস) নির্বাচন। আসবে নতুন নেতৃত্ব।
বেসিসকে তথ্যপ্রযুক্তির প্রাণকেন্দ্রে রূপান্তরিত করার পাশাপাশি নতুন ও তরুণ উদ্যোক্তাদের সংগঠনের সাথে সম্পৃক্ত করতে তার প্রচেষ্টা ছিল প্রশংসনীয়।
বেসিস সভাপতি থাকাকালীন তার কর্মকাণ্ড আর এ সম্পর্কিত নানা বিষয় নিয়ে তিনি খোলামেলা কথা বলেছেন বাংলানিউজের সাথে।
বেসিস কার্যালয়ে শামীম আহসানের সাক্ষাতকারটি নিয়েছেন বাংলানিউজের সিনিয়র আইসিটি রিপোর্টার সিজারাজ জাহান মিমি।
বাংলানিউজ: প্রথমেই আপনার কাছে প্রশ্ন বেসিসের সভাপতির দায়িত্ব পালন করে আসছেন অনেকদিন, কিন্তু এবার নির্বাচনে দাঁড়াচ্ছেন না কেন?
শামীম আহসান: প্রথমত আসলে এই ট্রেড বডির পজিশনটার একটা টাইম লিমিট আছে, বেসিস ইসি’তে আমার মোট ৪ বছরের মধ্যে প্রথম এক বছর সিনিয়র ভাইস প্রেসিডেন্ট এবং পরের তিন বছর প্রেসিডেন্ট হিসেবে ছিলাম। চলমান একটা প্রক্রিয়ার মধ্যে দিয়ে নতুনদের হাতে দায়িত্ব দেওয়াটাই স্বাভাবিক।
আমি মনে করি সেই সময়টা এসেছে, এখন ব্যাটনটা আরেকটা টিম আরেকজন প্রেসিডেন্টের হাতে দেয়া উচিত। নেতৃত্বের এই চলমান প্রক্রিয়া থেকেই তৈরি হবে নতুন নেতৃত্ব। একজন যদি একটা জায়গায় লম্বা সময় থাকে তাহলে কিন্তু নতুন নেতৃত্ব সেখানে আসতে পারে না।
দ্বিতীয়ত ফ্যামিলি এবং ব্যবসায়ে সময় দেয়ার পাশাপাশি অন্যদের সহযোগিতা করা। কেননা আমি এফবিসিসিআই’র ডিরেক্টর। এছাড়া ভেঞ্চার ক্যাপিটাল এবং তরুণ উদ্যোক্তাদের নিয়ে কাজ করতে চাই।
বিশেষ করে তরুণ উদ্যোক্তারা যাতে সিলিকন ভ্যালি থেকে ফান্ড রেইজ করতে পারে সেজন্য তাদের মেন্টরিং করা এবং বিদেশের মার্কেটে তাদের ব্যবসা সম্প্রসারণের সুযোগ তৈরি করে দিতে চাই।
বাংলানিউজ: বাহ্যিকভাবে আমরা দেখি বেসিস দেশের তথ্যপ্রযুক্তির উন্নয়নে অনেক কাজ করেছে, গত কয়েক বছরে সরকারের আইসিটি ডিভিশনের সঙ্গে যৌথভাবেও কিছু বড় প্রোগ্রাম করেছে। তার মধ্যে এমন কোন কাজগুলোকে অর্জন অথবা সেরা অর্জন বলে মনে করছেন।
শামীম আহসান: আমাদের সেরা অর্জনগুলোকে মূলত ৫টি জায়গায় ভাগ করি। নীতিমালার দিক থেকে আমরা মনে করি ২০২৪ সাল পর্যন্ত সফটওয়্যার এবং আইটি সার্ভিসেসের জন্য কর্পোরেট ট্যাক্স মওকুফ, ই-কমার্সে ট্যাক্স প্রত্যাহার একটি বড় সাফল্য।
অ্যাক্সেস টু ফাইন্যান্সের দিক থেকে আইডিএলসি’কে সঙ্গে নিয়ে আমরা মেম্বারদের জন্য কোলেটেরাল ফ্রি লোনের ব্যবস্থা করেছি। যেখানে আমাদের ২৫টি সদস্য প্রতিষ্ঠান ৪০ কোটি টাকার মতো লোন পেয়েছে। আমরা ভেঞ্চার ক্যাপিটাল পলিসি করেছি সিলেকশন কমিটির সাথে এবং আইসিটি অ্যাডভাইজারের সহযোগিতায়। এর ফলে প্রায় ১০টার মতো ভেঞ্চার ক্যাপিটাল কোম্পানি দেশে এখন অ্যাকটিভ হয়েছে। হিউম্যান রিসোর্স ডেভেলপমেন্টের জন্য এশিয়ান ডেভলপমেন্ট ব্যাংক ও অর্থ মন্ত্রণালয়ের সহায়তায় আমাদের একটা ফান্ড আছে। এর মাধ্যমে ‘বেসিস ইন্সটিটিউট অব টেকনোলজি অ্যান্ড ম্যানেজমেন্ট’ (বিআইটিএম) প্রজেক্ট হাতে নেয়া হয়েছে, যেখানে ২৩ হাজার আইটি কর্মীকে ট্রেনিং দেয়া হচ্ছে।
অবকাঠামোর দিক থেকে যে ইন্টারনেটের দাম আগে ছিল ১ এমবিপিএস ৭০ হাজার টাকা, সেটা বেসিসের পলিসি অ্যাডভোকেসি এবং সরকারের সদিচ্ছার কারণে এখন ৫০০ টাকায় দাঁড়িয়েছে। সবচেয়ে বড় সাফল্য বলে মনে করি ডিজিটাল ওয়ার্ল্ড, ইন্টারনেট উইক এবং নেদারল্যান্ড ট্রাস্ট ফান্ড (এনটিএফ) প্রজেক্ট।
এছাড়া ইন্টারন্যাশনাল ট্রেড সেন্টার এবং সিবিআই এর সাথে মিলে গত কয়েক বছরে ৬০টা দেশি কোম্পানিকে প্রায় ২২৫০টি বিটুবি ম্যাচ মেকিং মিটিং করিয়ে দিয়েছে। যার ফলে কোম্পানিগুলো এখন বছরে প্রায় ১০০ মিলিয়ন ডলার এক্সপোর্ট করছে।
ডিজিটাল ওয়ার্ল্ড এ প্রায় ১০০টা দেশি কোম্পানি এবং মন্ত্রণালয়গুলো থেকে ৬০টির বেশি সংস্থা ও ৭৫০টার মতো প্রাইভেট সেক্টরের সিইও পার্টিসিপেট করেন। এর ফলে ব্যবসার প্রচুর সম্ভাবনা তৈরি হয়েছে।
সাধারণ মানুষকে ইন্টারনেট ব্যবহারে উৎসাহিত করতে আমরা ইন্টারনেট উইক করি। গত বছর প্রধানমন্ত্রী এটি উদ্বোধন করেছিলেন। এই আয়োজনটি আমরা দেশের তিনটি বড় শহরে এবং ৪৮৭টি উপজেলায় করেছি।
বাংলানিউজ: সাধারণ কার্যক্রমের বাইরে দেশের গ্রামীণ পর্যায়ের মানুষদের তথ্যপ্রযুক্তি সুবিধা ব্যবহারের সুযোগ করে দিতে বেসিস কি করেছে?
শামীম আহসান: বেসিসের প্রাইমারি কাজ যদিও ব্যবসায়ীদের নিয়ে তবে এর বাইরেও আমরা সরকারের ডিজিটাল বাংলাদেশ গড়ার স্বপ্ন বাস্তবায়নে সরকারের প্রতিটি কাজের সাথে থাকি। আইসিটি ডিভিশন আমাদের মেজর পার্টনার। গ্রামে, উপজেলায় আমরা যেকোনো প্রোগ্রাম একসাথে করি। যেমন ইউনিয়ন ইনফরমেশন সেন্টারগুলোতে বেসিস বিভিন্ন কনটেন্ট সাপোর্ট সহ নানা সুবিধা দিচ্ছে। এছাড়া এডুকেশন নিয়ে কাজ করেছি যাতে এডুকেশন কারিকুলামে তথ্যপ্রযুক্তি শিক্ষা অন্তর্ভুক্ত করা যায়। বেসিস স্টুডেন্ট ফোরাম করেছি যারা আইটি নিয়ে পড়াশোনা করছে যোগ্যতা অনুযায়ী তারা এখানে আসতে পারছে।
বাংলানিউজ: আপনাদের মেয়াদকালে যে কাজগুলো সম্পূর্ণ করতে পারেননি বা নতুন যারা বেসিস ইসি’তে নির্বাচিত হয়ে আসবে তাদের জন্য আপনার বার্তা কি থাকবে?
শামীম আহসান: একটা কাজ প্রায় শেষ পর্যায়ে নিয়ে আসলেও আমার টার্মে তা শেষ করতে পারিনি আফসোস। সেটা হচ্ছে সরকারি সকল কাজে কমপক্ষে ৫০ শতাংশ স্থানীয় আইটি কোম্পানির অংশগ্রহণ থাকতে হবে, অন্যান্য দেশেও এই নিয়মটা আছে।
এ বিষয়ে প্রধানমন্ত্রী, আইসিটি অ্যাডভাইজার, অর্থমন্ত্রী, আইসিটি মন্ত্রী সবারই সমর্থন আছে। পরিকল্পনা মন্ত্রণালয়ে আমাদের দেয়া প্রস্তাবনাটা এখন প্রক্রিয়াধীন। পাস হলে আশা করছি নতুন কমিটি ১ থেকে ২ মাসের মধ্যে তা বাস্তবায়ন করতে পারবে।
এর ফলে আমাদের সফটওয়্যার ইন্ড্রাস্ট্রির চেহারা পাল্টে যাবে। আর আমরা নতুন কমিটি থেকে আরেকটা জিনিস বাস্তবায়ন করতে চাই তা হচ্ছে বাজেটের (এডিপি) বার্ষিক উন্নয়ন কর্মসূচির যাতে অন্তত ১০% আইসিটিতে বরাদ্দ দেয়া হয়। এতে করে সরকারের অনেক কাজ সাকসেসফুল হবে, কস্ট কমে আসবে এবং ট্রান্সপারেন্সি বাড়বে।
বাংলানিউজ: আইসিটি সেক্টরে নারী উদ্যোক্তার সংখ্যা বাড়ছে, তাই নারী নেতৃত্বের জন্য বেসিস কার্যনির্বাহী কমিটিতে নারীদের জন্য সংরক্ষিত আসন থাকার প্রয়োজনীয়তা আছে বলে মনে করেন কি?
শামীম আহসান: আমার মনে হয় বেসিসের প্রত্যেকটা বোর্ডেই নারী নেতৃত্ব থাকছে। যদিও আমাদের রেশিও ওয়াইজ ৫ শতাংশও প্রফেশনাল নারী উদ্যোক্তা নেই। উদ্যোক্তার সংখ্যা মাত্র ১ শতাংশ হবে। তা সত্ত্বেও প্রতিবারই বেসিস বোর্ডে নারী থাকেন। এবারও থাকবে আশা করছি। এছাড়া বেসিস থেকে বেসিস উইমেন ফোরাম লঞ্চ করেছি মূলত নারীদের নিয়েই কাজ হবে সেখানে। আর নির্ধারিত আসন আসলে কোনো ট্রেড বডিতেই নেই। আমাদের যে নারীরা আছে তাদের জন্য সংরক্ষিত আসনের দরকার নেই, বেসিসে যারা নির্বাচন করেছে প্রতিবারই তারা জিতেছে।
বাংলানিউজ: বাংলাদেশের সফটওয়্যার শিল্পকে বিশ্বমানের পর্যায়ে নিয়ে যেতে সামনে কি ধরনের চ্যালেঞ্জ আছে বলে মনে করছেন?
শামীম আহসান: একটা বড় চ্যালেঞ্জ বিদেশি কোম্পানিদের আগ্রাসন। সেজন্য আমাদের খেয়াল রাখতে হবে যেন বিদেশিরা আর আগ্রাসন না চালাতে পারে। বিভিন্ন পলিসির মাধ্যমে আমাদের দেখতে হবে যেন লোকাল কোম্পানির অংশগ্রহণ বেশি থাকে। দ্বিতীয়ত চ্যালেঞ্জ কান্ট্রি ব্র্যান্ডিং। যদিও কান্ট্রি ব্র্যান্ডিং আগের থেকে অনেক বেটার হয়েছে। আমাদের প্রধানমন্ত্রী এখন পৃথিবীর বিভিন্ন জায়গায় মাথা উঁচু করে সম্মানের সাথে দেশকে এগিয়ে নিয়ে যাচ্ছেন । আমাদের কান্ট্রি ব্র্যান্ডিংয়ে অনেক ইনভেস্ট করতে হবে যেহেতু আমাদের সরকারি বাজেট অনেক কম। ৫ বিলিয়ন ডলার এক্সপোর্ট করতে হলে অন্তত এ খাতে আমাদের ১০ কোটি টাকা ইনভেস্ট করা উচিত।
বাংলানিউজ: এবার নির্বাচনে কয়েকজন তরুণ প্রার্থী রয়েছেন। তরুণদের জন্য বেসিসে অনুকূল পরিবেশ তৈরি না হওয়ায়, তরুণদের প্রতিনিধিত্ব করতে তারা নির্বাচন করছে। এছাড়াও তাদের দাবি বেসিস ইসি’তে কমপক্ষে দুটি আসন তরুণ সদস্যদের জন্য থাকা উচিত। এ ব্যাপারে কি বলবেন।
শামীম আহসান: ১০ বছর আগে বেসিসের ডিরেক্টর হয়েছিলাম তখন আমার বয়সের ৩০ এর চেয়ে কম ছিল। আমার তো সংরক্ষিত কোনো আসন দরকার হয়নি। নির্বাচনের মাধ্যমে জিতে এসেছি। ৩৬, ৩৭ বছর বয়সে প্রেসিডেন্ট হয়েছি। আজকে আমাদের আইসিটি প্রতিমন্ত্রী জুনাইদ আহমেদ পলকও ৩৩, ৩৪ বছর বয়সে মন্ত্রী হয়েছেন। আমার কাছে মনে হয় যোগ্যতা থাকলে কেউ আটকাতে পারে না।
আর বেসিসের শত শত তরুণ মেম্বার আছেন, যারা বলছে যে, গত কয়েক বছরে বেসিসে তরুণদের জন্য যে কাজগুলো করা হয়েছে সেটা আর কোনো ট্রেড বডির ইতিহাসে হয়নি।
বাংলানিউজ: এবার যারা নির্বাচনে দাঁড়িয়েছেন তাদের কেউ কেউ বেসিসের বর্তমান কমিটির কার্যকলাপ সম্পর্কে নেতিবাচক কথাবার্তা এবং অভিযোগ তুলছেন। তাদের দাবি কমিটির সাথে সংগঠনের সদস্যদের সম্পর্কে একটা দূরত্ব রয়েছে। এ ব্যাপারে আপনার বক্তব্য কি?
শামীম আহসান: দেখেন আমাদের প্রায় ১ হাজার মেম্বার কোম্পানি’জ আছে। পার্সোনালি প্রতিদিন কমপক্ষে ১০ থেকে ১৫ জনের সঙ্গে আমাকে ফেসবুকে, ফোনে কমিউনিকেশন করতে হয়। অনেক মেম্বার আছে যাদেরকে আমরা এনবিআর, বাংলাদেশ ব্যাংকে নিয়ে গেছি। প্রবলেমগুলো তাদের সাথে নিয়েই সমাধানের চেষ্টা করেছি। বেসিস কার্যনির্বাহী কমিটিতে আমাদের ডেডিকেটেড লোকজন আছে যারা শুধু মেম্বার সার্ভিসেস নিয়ে কাজ করে। আমার মনে হয় কেউ বলতে পারবে না তাদের সমস্যার কথা জানানোর পরও তা করিনি।
বাংলানিউজ: বেসিসের সঙ্গে কত সময় ধরে যুক্ত আছেন এবং বেসিসের বাইরে কি করছেন?
শামীম আহসান: বেসিসের মেম্বার আছি ১২ বছর ধরে। ১০ বছর আগে প্রথম ইসি ডিরেক্টর হই। বেসিস ছাড়া ফেনক্স ভেঞ্চার ক্যাপিটালের জেনারেল পার্টনার আমি, যেটা সিলিকন ভ্যালির ১.৫ বিলিয়ন ডলারের একটি ফান্ড। বাংলাদেশে ২০০ মিলিয়ন ডলার বিনিয়োগের ঘোষণা করেছি। এরই মধ্যে প্রিয় ডট কম, সহজ ডট কমে ইনভেস্ট করেছি। এছাড়া এফবিসিসিআই এর ডিরেক্টর পদে রয়েছি। পাশাপাশি ই-জেনারেশন ও বাগডুম আমার নিজের প্রতিষ্ঠান।
বাংলানিউজ: বিদেশি কোম্পানিগুলো বাংলাদেশিদের বিশ্বাস করে না যে কারণে তারা এদেশে ব্যবসা করতে চায় না। এর উপর আবার নিজেদের মধ্যে নেতিবাচক নানান কাথাবার্তা। এক্ষেত্রে নির্বাচনকে ঘিরে এ ধরনের কথাবার্তা কোনো নেগেটিভ প্রভাব ফেলবে কি ?
শামীম আহসান: নির্বাচনকে ঘিরে এ ধরনের নেগেটিভ কথাবার্তা খুবই ছোট একটা গ্রুপ করছে। যারা আসলে লম্বা সময় ধরে বেসিসের সঙ্গে রয়েছে তারা কখনও বেসিসের বিরুদ্ধে বলবেন না। গুটিকয়েক ভিন্নচিন্তার মানুষ বা হঠাৎ করে যারা বেসিসের নেতৃত্ব নেয়ার চেষ্টা করছে তারাই এরকম বলছে। আমি মনে করি সার্বিকভাবে বেসিসের সবকিছুই পজেটিভ।
আর বিদেশিরা এদেশে ব্যবসা করতে চায় না এটা ঠিক না। তারা আসলে এ ধরনের কথা বলে বাংলাদেশ ও সরকারে যতো বিদেশি দাতা সংস্থার কাজ হয় সবগুলোতে আগ্রাসনের চেষ্টা করে।
বাংলাদেশ সময়: ১৬১০ ঘণ্টা, জুন ২১, ২০১৬
আরআই