ঢাকা, রবিবার, ৭ পৌষ ১৪৩১, ২২ ডিসেম্বর ২০২৪, ১৯ জমাদিউস সানি ১৪৪৬

তথ্যপ্রযুক্তি

ব্লাইন্ড কোয়ান্টাম কম্পিউটেশন

| বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ১৩১০ ঘণ্টা, অক্টোবর ২৫, ২০১৭
ব্লাইন্ড কোয়ান্টাম কম্পিউটেশন চিত্র-১

কম্পিউটেশন এক বিস্ময়কর যুগে প্রবেশ করতে চলেছে। পৃথিবীর প্রতিটি প্রান্তে প্রযুক্তির ছোঁয়া লাগছে, যার ফলে প্রযুক্তির চাহিদাও উত্তরোত্তর বৃদ্ধি পাচ্ছে। প্রযুক্তি এখন আর মানবসৃষ্ট বৈদ্যুতিক যন্ত্রের মাঝে সীমাবদ্ধ নয় বরং প্রাকৃতিক উপাদানের সাথেও মিশে যাচ্ছে ইন্টারনেট অব থিংসের মত অত্যাধুনিক প্রযুক্তি। তবে ভবিষ্যতের পৃথিবীর জন্য আমাদের বর্তমান প্রযুক্তি যথেষ্ট হবে না বলে আশঙ্কা করা হচ্ছে। খাদ্য চাহিদার কথাই দেখা যাক।

জাতিসংঘের পরিসংখ্যান অনুযায়ী, ২০৫০ সালের মধ্যে পৃথিবীর মোট জনসংখ্যা গিয়ে দাঁড়াবে প্রায় ৯.৫ বিলিয়নে। এই সময়ের মাঝে বাংলাদেশের জনসংখ্যা ২০ কোটি ছাড়িয়ে যেতে পারে।

এই বিপুল জনসমষ্টির খাদ্য চাহিদা পূরণ করতে হলে খাদ্য উৎপাদন বৃদ্ধির বিকল্প নেই। কিন্তু একইসাথে জলবায়ু পরিবর্তনের ফলে কোটি কোটি ডলারের খাদ্যশস্য ধ্বংসের মুখে পড়ছে। গত ১৫০ বছরেই পৃথিবীর অর্ধেক কর্ষণীয় জমি (Topsoil) বিলুপ্ত হয়ে গেছে।
আমাদের মনে প্রশ্ন জাগতে পারে যে, এসবের সাথে প্রযুক্তি আর কম্পিউটেশনের সম্পর্ক কি? আমাদের প্রযুক্তি এবং কম্পিউটেশন যদি সময়মত পরবর্তী ধাপে নিয়ে যাওয়া সম্ভব হয় তাহলে জলবায়ুসহ বৈশ্বিক বিভিন্ন সমস্যার সমাধান বের করা সম্ভব হবে। যার ফলে ক্ষয়ক্ষতির পরিমাণ উল্লেখযোগ্য হারে কমিয়ে আনা সম্ভব। কৃষি সংক্রান্ত একটি উদাহরণ দেখা যাক।

কৃষিকাজে অধিক ফলনের জন্য সার অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। বেশিরভাগ সারের মূল উপাদান অ্যামোনিয়া, যা নাইট্রোজেন এবং হাইড্রোজেনের সমন্বয়ে গঠিত। কিন্তু নাইট্রোজেন এবং হাইড্রোজেন একে অপরের সাথে সহজে বিক্রিয়া করতে চায় না। এই বিক্রিয়ার জন্য প্রয়োজন উচ্চ তাপমাত্রা এবং চাপ – এক বিশেষ প্রক্রিয়া যা “হেবার-বোস প্রক্রিয়া” নামে পরিচিত। ১৯১০ সালে আবিষ্কৃত এই প্রক্রিয়া আবিষ্কারের পর খুব সামান্য পরিবর্তিত হয়েছে, যার ফলে অ্যামোনিয়া উৎপাদন করা এখনো যথেষ্ট ব্যয়বহুল।

বহুযুগ ধরে বিজ্ঞানীরা আরো সহজ উপায়ে অ্যামোনিয়া উৎপাদনের উপায় খুঁজে যাচ্ছেন, কিন্তু সমস্যা হলো, এই বিক্রিয়ার জন্য সবচেয়ে ভাল ক্যাটালিস্ট বা প্রভাবক কি তা নির্ণয় করা যাচ্ছে না। প্রায় অসীম সংখ্যক সম্ভাবনা রয়েছে যাদের মাঝে যে কোনো একটি আমাদেরকে সর্বোত্তম উপায়ে অ্যামোনিয়া উৎপাদন করতে সাহায্য করবে। সেই সর্বোত্তম প্রক্রিয়াটি খুঁজে বের করার জন্য বর্তমান কম্পিউটারও যথেষ্ট নয়, প্রয়োজন আরো শক্তিশালী কম্পিউটার।
প্রায় অসীম সংখ্যক বিকল্পের মাঝে সর্বোত্তম একটি সমাধান বেছে বের করা আমাদের পরিচিত বা ক্লাসিক্যাল কম্পিউটারের পক্ষে কষ্টসাধ্য হলেও তা কোয়ান্টাম কম্পিউটারের পক্ষে মোটেও অসম্ভব নয়। এমন জটিল সব সমস্যার সমাধান দ্রুত বের করে ফেলতে পারবে উচ্চক্ষমতাসম্পন্ন এই কম্পিউটার। জটিল সমস্যা সমাধানে কোয়ান্টাম কম্পিউটার ভবিষ্যতের বিজ্ঞানীদের অন্যতম প্রধান হাতিয়ার হতে যাচ্ছে।

কোয়ান্টাম কম্পিউটার বলতে আপনি যদি ভাবেন যে সুপার কম্পিউটারের কথা বলা হচ্ছে তাহলে আপনার ধারণা সঠিক নয়। কোয়ান্টাম কম্পিউটার যে কোনো সুপার কম্পিউটার হতেও বহুগুণে বেশি শক্তিশালী। পৃথিবীর প্রথম কমার্শিয়াল কোয়ান্টাম কম্পিউটার হিসাবে দাবি করা ডি-ওয়েভ একটি সুপার কম্পিউটারের চেয়েও ৩৬০০ গুণ দ্রুততার সাথে কম্পিউটেশন করতে পারে!

কোয়ান্টাম কম্পিউটার কি তা বোঝার আগে কম্পিউটার সম্পর্কে কিছুটা জেনে নেই। কম্পিউটার মূলত বিভিন্ন ধরনের কম্পিউটার চিপ দ্বারা গঠিত। এই চিপগুলোকে বলা হয় ইন্টিগ্রেটেড সার্কিট (IC) যার মাঝে থাকে অসংখ্য ট্রানজিস্টর। ইনটেলের কো-ফাউন্ডার গর্ডন মুর ১৯৬৫ সালে তার প্রকাশিত পেপারে দেখান যে, প্রতি বছরে চিপের মাঝে থাকা ট্রানজিস্টরের সংখ্যা দ্বিগুণ হতে থাকে, যদিও চিপের আকার বৃদ্ধি পায় না। অর্থাৎ ট্রানজিস্টর আকারে ক্ষুদ্র থেকে ক্ষুদ্রতর হতে থাকে। ১৯৭৫ সালে তিনি লক্ষ্য করেন যে, ট্রানজিস্টরের সংখ্যা বৃদ্ধির হার কিছুটা হ্রাস পাচ্ছে, তাই তিনি নতুন করে প্রস্তাব করেন যে, প্রতি দুই বছরে চিপের মাঝে অবস্থিত ট্রানজিস্টরের সংখ্যা দ্বিগুণ হবে। এখন পর্যন্ত মুরের এই সূত্র নির্ভুল বলে প্রমাণিত হয়েছে।
কিন্তু ট্রানজিস্টরের পক্ষে আর কতো ক্ষুদ্র হওয়া সম্ভব? ইনটেলের সর্বশেষ তথ্য অনুযায়ী, ২০১৭ সালে ট্রানজিস্টরের আকার মাত্র ১০ ন্যানোমিটারে এসে দাঁড়িয়েছে। ভবিষ্যতে এটি কমে ৫ ন্যানোমিটারে নিয়ে আসার পরিকল্পনাও করা হয়েছে। তবে ২০২৫ সালে মুরের এই বিখ্যাত সূত্রের সমাপ্তি ঘটতে পারে বলে ধারণা করা হচ্ছে। অর্থাৎ সেই সময়ের মধ্যে ট্রানজিস্টর এতো ক্ষুদ্র হয়ে যাবে যে তা আর ক্লাসিক্যাল ফিজিক্সের নিয়ম মেনে চলবে না বরং পরমাণুর মত ক্ষুদ্র কণার জন্য প্রযোজ্য কোয়ান্টাম ফিজিক্সের নিয়ম অনুসরণ করবে। যার ফলে আমাদের কম্পিউটারও কোয়ান্টাম কম্পিউটার হিসাবে আচরণ করবে। চিত্র-২

আগেই বলা হয়েছে যে, কোয়ান্টাম কম্পিউটার যে কোনো সুপার কম্পিউটার থেকেও অধিক শক্তিশালী। কোয়ান্টাম কম্পিউটারের পক্ষে এমন সব জটিল সমস্যার সমাধান বের করাও সম্ভব হবে যা বর্তমান ক্লাসিক্যাল কম্পিউটারের পক্ষে সম্ভব নয়। তবে কোয়ান্টাম কম্পিউটার তৈরি করা এবং তা রক্ষণাবেক্ষণ করা বেশ জটিল এক ব্যাপার। যার ফলে সকলের ঘরে ঘরে কোয়ান্টাম কম্পিউটার পৌঁছে যাওয়ার সম্ভাবনা কম।

তাহলে সমস্যাটা থেকেই যাচ্ছে। জটিল সমস্যার সহজ সমাধানের জন্য বিজ্ঞানীদের প্রয়োজন কোয়ান্টাম কম্পিউটার, কিন্তু সকলের পক্ষে কোয়ান্টাম কম্পিউটার যোগাড় করাও সম্ভব নয়। এই সমস্যার সমাধান করা সম্ভব ব্লাইন্ড কোয়ান্টাম কম্পিউটিং এর মাধ্যমে।

“ব্লাইন্ড” কোয়ান্টাম কম্পিউটেশন দ্বারা এক বিশেষ প্রক্রিয়ার কোয়ান্টাম কম্পিউটেশন বোঝানো হয়। ধরুন, আপনার কাছে কাছে কোন কাজ (Task) রয়েছে যা আপনি কোয়ান্টাম কম্পিউটার দ্বারা সম্পন্ন করতে চান। আপনি সেই টাস্ক কোয়ান্টাম কম্পিউটারের মাধ্যমেও করতে পারেন, আবার সেটি কোন কোয়ান্টাম সার্ভারের মাধ্যমেও করতে পারবেন। কোয়ান্টাম সার্ভারের মাধ্যমে কাজ সম্পন্ন করার ক্ষেত্রে বিজ্ঞানীরা তাদের গোপন তথ্যের নিরাপত্তা নিয়ে দুশ্চিন্তায় পড়তে পারেন। তাই ব্লাইন্ড কোয়ান্টাম কম্পিউটিংয়ে এমন নিরাপত্তা ব্যবস্থা বা প্রটোকল ব্যবহার করা হয় যার ফলে কোয়ান্টাম সার্ভার সম্পূর্ণ কম্পিউটিং করে দেবে, কিন্তু কোন তথ্য সার্ভার পাবে না। আপত দৃষ্টিতে অসম্ভব ও যথেষ্ট চ্যালেঞ্জিং হলেও পরীক্ষার মাধ্যমে প্রমাণ করা সম্ভব হয়েছে যে, ব্লাইন্ড কোয়ান্টাম কম্পিউটিংয়ের সময় নির্দিষ্ট প্রটোকল মেনে চললে অপরিচিত সার্ভারের কাছে তথ্য চুরি যাওয়ার সম্ভাবনা নেই।

চিত্র-৩কিছুদিন আগ পর্যন্ত ব্লাইন্ড কোয়ান্টাম কম্পিউটিং করার জন্যেও আপনার কোয়ান্টাম ডিভাইসের প্রয়োজন ছিল। তবে ২০১৭ সালের আগস্টে ইউনিভার্সিটি অব সাইন্স অ্যান্ড টেকনোলজি অব চায়নার কিছু বিজ্ঞানী এমন এক প্রটোকল আবিষ্কার করতে সক্ষম হয়েছেন যার মাধ্যমে আমাদের পরিচিত ক্লাসিক্যাল কোয়ান্টাম কম্পিউটারের মাধ্যমেই ব্লাইন্ড কোয়ান্টাম কম্পিউটিং করা সম্ভব হবে। এই টিমের নেতৃত্বে ছিলেন কোয়ান্টাম ফিজিসিস্ট জিয়ান-ওয়েই প্যান এবং চাও-ইয়াং লু। তাদের প্রটোকল পরীক্ষা করে দেখা গেছে যে ক্লাসিক্যাল কম্পিউটারের মাধ্যমেও অপরিচিত কোয়ান্টাম সার্ভার দ্বারা ব্লাইন্ড কোয়ান্টাম কম্পিউটিং করা সম্ভব হচ্ছে। সেই সাথে ক্লায়েন্টের সম্পূর্ণ প্রাইভেসিও বজায় থাকছে অর্থাৎ ব্যবহারকারীর কোন তথ্য ফাঁস হচ্ছে না। গবেষকরা আশা করছেন যে, তাদের এই প্রটোকল কোয়ান্টাম ক্লাউড সার্ভারে ব্যবহার করা হবে, যার ফলে পৃথিবীর অসংখ্য মানুষের হাতের নাগালে কোয়ান্টাম কম্পিউটিংয়ের ক্ষমতা পৌঁছে যাবে এবং আমরা কোয়ান্টাম কম্পিউটিংয়ের অপার সম্ভাবনাকে মানব কল্যাণে কাজে লাগাতে পারবো।

প্প্রফেসর ড. সাজ্জাদ হোসেন রফেসর ড. সাজ্জাদ হোসেন: ডিপার্টমেন্ট অব কম্পিউটার সাইন্স এন্ড ইঞ্জিনিয়ারিং, ইউনিভার্সিটি অব লিবারেল আর্টস বাংলাদেশ। সহযোগিতায়: মোঃ শাকিফ ফেরদৌস এবং খায়রুন নাহার


বাংলাদেশ সময়: ১৯০০ ঘণ্টা, অক্টোবর ২৫, ২০১৭
জেডএম/

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।