মঙ্গলবার (২৫ জুন) বিনা নোটিশে একসঙ্গে সবচেয়ে বড় কর্মী ছাঁটাই করে নিজেদের ইতিহাসে রেকর্ড গড়ে পাঠাও। বিভিন্ন সূত্রের তথ্য অনুযায়ী, পুরনো বিনিয়োগের ওপর মুনাফা না আসা ও নতুন বিনিয়োগ না পাওয়ায় অর্থ সংকটে পড়ে পাঠাও।
পড়ুন>>চাকরিচ্যুতির মুহূর্তের দুঃসহ বর্ণনা পাঠাও-কর্মীর
তবে শুধু অর্থের অভাব ছাড়াও প্রতিষ্ঠানটির শীর্ষ কর্মকর্তাদের গাফিলতি, দূরদর্শিতার অভাব ও প্রতিষ্ঠানে সঠিক নেতৃত্ব রাখতে না পারার জন্যই ‘বলির পাঠা’ হয়ে চাকরি হারাতে হয়েছে বলে ধারণা ছাঁটাই হওয়া কর্মকর্তাদের।
নাম ও পদবি গোপনের শর্তে, চাকরিচ্যুত এক কর্মকর্তা বাংলানিউজকে বলেন, গত ডিসেম্বর মাসেও বিশাল আয়োজন করে প্রায় অর্ধেক কর্মীকে পুরস্কৃত করে পাঠাও। ভালো কাজের স্বীকৃতিস্বরূপ দেওয়া এ পুরস্কার। আয়োজনে ব্যয় হয় প্রায় ২০ লাখ টাকা। এরপর অর্থাভাবে নয় বরং দায়িত্বে দক্ষতার অভাব থাকায়, চলতি বছরের মার্চ মাসে প্রায় দেড় শতাধিক কর্মীকে চাকরিচ্যুত করা হয়। অন্যদিকে ছাঁটাই না হওয়া কর্মীদের মধ্যে বেশিরভাগকেই পদোন্নতি অথবা ইনক্রিমেন্ট দেওয়া হয়। অর্থাৎ পাঠাও যে অর্থাভাবে পড়তে পারে সে বিষয়টি শীর্ষ কর্তারা হয় বুঝতে পারেননি, নয়তো বুঝেও আমাদের জানাননি এবং আগে থেকে সতর্ক করেননি।
এছাড়াও ব্র্যান্ডিং, স্পন্সরশিপ এবং বিজ্ঞাপনে পাঠাও অতিরিক্ত টাকা ব্যয় করেছে অভিযোগ এসব বিভাগে দীর্ঘদিন কাজের পর চাকরি হারানো আরেক কর্মকর্তার। তিনি বলেন, চলতি বছরের জানুয়ারিতে বিপিএলে ঢাকা ডায়নামাইটসকে এক কোটি টাকার স্পন্সর দেয় পাঠাও। সেই স্পন্সরের প্রচার-প্রচারণায় আবার ব্যয় হয় আরও প্রায় এক থেকে দেড় কোটি টাকা। গত রমজান মাসেও টিভি বিজ্ঞাপন (টিভিসি) নির্মাণে ৬০ লাখ থেকে প্রায় এক কোটি টাকা ব্যয় করা হয়। আর সেগুলো দেশের বিভিন্ন চ্যানেলে প্রকাশ করতে ব্যয় করা হয় আরও প্রায় দেড় কোটি টাকা। ২০১৮ সালে আসা বিনিয়োগ (প্রায় ১৭ কোটি টাকা) বলতে গেলে একরকম হিসাব ছাড়াই খরচ করে ফেলেছেন শীর্ষ পর্যায়ের কর্মকর্তারা।
পড়ুন>>বিক্রি হতে চলেছে পাঠাও!
অদূর ভবিষ্যতেই মূলধনের অভাবে পড়বে প্রতিষ্ঠান সেটি আপনারা কেন বুঝলেন না- এমন প্রশ্নের জবাবে পাঠাও-এর মধ্যম পর্যায়ের (মিড লেভেল) এই কর্মকর্তা বলেন, আমরা পলিসি মেকিং পর্যায়ের কর্মকর্তা না। কি ক্যাম্পেইন করা হবে, তার ধরন ও খরচ কেমন হবে সবকিছুই টপ ম্যানেজমেন্ট অর্থাৎ সিইও (প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা), সিএফও (চিফ ফিন্যান্সিয়াল অফিসার), চিফ মার্কেটিং অফিসার পর্যায়ের কর্মকর্তারা নির্ধারণ করতেন। সিএফও আমাদের ক্যাম্পেইন দিতেন, অর্থ দিতেন এবং খরচের খাত দিতেন। আমরা সেগুলো খরচ করতাম। কখনো আমাদের বলা হয়নি যে, আমরা অর্থ সংকটের দিকে যাচ্ছি।
তারা একটা আশায় ছিলেন যে, এবছর একটি বড় অংকের বিনিয়োগ আসবে। কিন্তু কোনো কারণে বিনিয়োগ না এলে কোম্পানি কীভাবে টিকে থাকবে সেই পরিকল্পনাই তারা করেনি। অন্তত ছয় মাস প্রতিষ্ঠানকে টিকিয়ে রাখার, কর্মীদের সঙ্গে রাখার কৌশল নিয়ে তারা ভাবেনি। এখন একটি সমস্যায় পড়ে হুট করে আমাদের ছাঁটাই করার সিদ্ধান্ত সবচেয়ে সহজ বলে মনে হয়েছে তাদের কাছে। তাদের দূরদর্শিতার অভাবে আমাদের চাকরি, ক্যারিয়ার ও ভবিষ্যৎ সবকিছু বলি দিতে হয়েছে।
পাঠাও-এর শীর্ষ পর্যায়ের কর্মকর্তাদের এই ব্যর্থতার দায় মেনে নিয়ে সবার আগে নিজেদের পদত্যাগ করা উচিত বলেও মনে করেন চাকরিচ্যুত কর্মকর্তারা।
প্রতিষ্ঠানটির শীর্ষ কর্মকর্তারা যদি আসন্ন অর্থাভাব সম্পর্কে আগে থেকে বুঝতে না পারেন তাহলে দূরদর্শিতার অভাব আছে বলে মনে করেন বাংলাদেশ অ্যাসোসিয়েশন অব সফটওয়্যার অ্যান্ড ইনফরমেশন সার্ভিসেস বেসিস-এর প্রেসিডেন্ট সৈয়দ আলমাস কবীর। তিনি বলেন, আমার যদি একটা দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনা থাকে আর আমি যদি সেটাকে কিছুদিন পরপর যাচাই-বাছাই না করি তাহলে তো সমস্যা হতেই পারে। ভুল হতেই পারে; সবার ভুল হয়। ধরেন আমি পাঁচ বছরের একটি পরিকল্পনা করলাম কিন্তু আমার পরিকল্পনা কাজে আসছে কিনা সেটি আর যাচাই-বাছাই করছি না। দু’তিন বছর পর গিয়ে দেখলাম যে, আমার পরিকল্পনা কাজ করছে না। তাহলে সেটা ঠিক না।
পাঠাও-এর চাকরি হারানো কর্মীদের প্রতি সহমর্মিতা প্রকাশ করে ব্যবসায়ীদের শীর্ষ সংগঠন এফবিসিসিআইয়ের এই পরিচালক বলেন, পাঠাও-কর্মীদের প্রতি আমি দুঃখিত। পাঠাও যদি আগে থেকে আজকের সময়ের অবস্থাটা অনুধাবন করতে পারতো তাহলে কর্মী ছাঁটাইয়ের বিষয়টি এতটা রূঢ় হতো না।
এসব বিষয়ে পাঠাও-এর সঙ্গে যোগাযোগের চেষ্টা করেও সম্ভব হয়নি। প্রতিষ্ঠানটির জনসংযোগ এজেন্সি মারফত লিখিত প্রশ্ন ই-মেইলে পাঠানো হলেও এই প্রতিবেদন সংশ্লিষ্ট কোনো মন্তব্য করেনি পাঠাও। কর্মী ছাঁটাই এরপর গত ২৬ জুন প্রতিষ্ঠানটির বিপণন ও জনসংযোগ বিভাগের প্রধান সৈয়দা নাবিলা মাহবুবের বিবৃতিরই পুনরাবৃত্তি করা হয়।
বাংলাদেশ সময়: ১০১৪ ঘণ্টা, জুন ২৮, ২০১৯
এসএইচএস/এএ