সিরাজগঞ্জ: যমুনায় জেগে ওঠা চরে নতুন বাড়ি করেছেন ষাটোর্ধ্ব শাহাদত আলী শেখ। তার দুই ছেলে শহরে থাকেন।
শাহাদত আলী বলেন, বেটার বউ ইন্টারনেটে ভিডিও কল দিয়্যা দেয়, শহরে থাকা বেটার সাথে কতা কই। মুখখানও দেহ্যা হয়।
সাজিদুল ইসলাম মিল্টন বলেন, ছোট ভাই জাকারিয়া সিরাজগঞ্জ কলেজে অনার্সে পরে। আমরা চরে থাইক্যাও যহন খুশি কতা কই, ওরে দেহি। মনে অয়, সামনে থ্যাইক্যাই কতা কইত্যাচি। মালয়েশিয়ায় থাকা মামার সাথেও ভিডিও কলে খোঁজ-খবর নিব্যার পারি।
সিরাজগঞ্জ সদর উপজেলার দুর্গম চরাঞ্চল কাওয়াকোলা ইউনিয়নে নতুন করে জেগে ওঠা চরের চিত্র ছিল এটি। খানিকটা দূরে একজন মাঝবয়সী নারীকে অ্যান্ড্রয়েড মোবাইল ফোনে কথা বলতে দেখা যায়। মাজেদা খাতুন নামের এ নারী চরের মধ্যে ছেড়ে দেওয়া নিজের ছাগলগুলোর খোঁজ নিতে বের হয়েছেন। ফোনে তিনি কথা বলছিলেন শহরে থাকা মেয়ের সাথে।
জানতে চাইলে মাজেদা খাতুনও বলেন, অ্যাহন মেয়ে-নাতিকে দেখার ইচ্ছা অইলে ছওয়ালেক কইলে মোবাইলে ভিডিও কল দিয়্যা কথা দেয়। কতাও হয় ফটোকও দেহ্যা যায়।
আক্ষেপের সাথে তিনি বলেন, আহারে! আমাগোরে বাপ-মাওয়ের সাথে বছরে একবার ঈদের মধ্যে দেহা সাক্ষাৎ অইতো। বাপ-মাওকে দেহ্যার জন্য মন ছটফট কইরলেও সহজে দেখা করা যাইতো না। অ্যাহন দিনটা পাল্টাইয়া গেচে। যহন ইচ্ছা, তহনই ফোনের মধ্যে আত্মীয়গোরে মুখ দেহ্যা যায়। ইস্ তহন যদি এমন থাইকতো। বলে ছাগল নিয়ে চলে যান তিনি।
যমুনা নদী বেষ্টিত সদর উপজেলার কাওয়াকোলা, রতনকান্দি, কাজিপুরের নাটুয়ারপাড়া ও চৌহালীর খাস কাউলিয়া ইউনিয়নে ঘুরে প্রযুক্তির কল্যাণে বদলে যাওয়া চরে এমন অসংখ্য দৃশ্য দেখা যায়।
এক দশক আগেও যেখানে দেশের খবর জানতে চাষি-মজুর, কামার-কুমার দিন শেষে সন্ধ্যায় দলবেধে মাতব্বর বাড়িতে রেডিও শোনার জন্য ভিড় জমাতেন-সেই চরের মানুষের ঘরে ঘরে এখন টেলিভিশন, রয়েছে সৌর বিদ্যুতের আলো। হাতে হাতে অ্যান্ড্রয়েড ফোন, রয়েছে ইন্টারনেট সেবাও। সারাবিশ্ব এখন চরের মানুষের হাতের মুঠোয়।
বিশেষ করে ইউনিয়ন ডিজিটাল সেন্টারগুলো (ইউডিসি) সম্পূর্ণরূপে পাল্টে দিয়েছে প্রান্তিক অঞ্চলের মানুষের জীবনমান। এখান থেকেই তথ্য প্রযুক্তির সব সেবা পাচ্ছেন চরের মানুষ।
নদী ভাঙন কবলিত চৌহালীর খাস কাউলিয়া ইউনিয়নের বাসিন্দা জনাব ওসমান গণি। জমির পর্চা বা খতিয়ান সংগ্রহ করতে সিরাজগঞ্জ শহরে আসতে হয়েছিল তাকে। দালালকে টাকা দিয়ে দুদিন ঘুরেও সেটি পাননি। গত ফেব্রুয়ারি মাসে তিনি জানতে পারেন, খতিয়ানের জন্য আর জেলা শহরে যেতে হবে না, কোনো দালাল ধরার দরকার নেই, বাড়ির পাশে খাস কাউলিয়া ইউনিয়নে গিয়েই সংগ্রহ করতে পারবেন পরচা। পরে তিনি ইউনিয়ন পরিষদে গিয়ে সেখানে উদ্যোক্তার কাছে অনলাইনে আবেদন করেন এবং নির্ধারিত মূল্য দেন। তিনদিন পরেই তাকে ডেকে নিয়ে খতিয়ান দেওয়া হয়।
ইউনিয়ন ডিজিটাল কেন্দ্রের মাধ্যমে চাকরির আবেদন ফরম পূরণ করে পাঠিয়েছিলেন সদর উপজেলার কাওয়াকোলা ইউনিয়নের হাট বয়রা চরের শাহজামাল শেখের ছেলে মাসুদ রানা। চলতি বছর প্রাণিসম্পদ বিভাগে চাকরি হয়েছে তার।
বয়স্ক ভাতা নিতে এসেছিলেন একই ইউনিয়নের কাটেঙ্গার চরের মৃত আবুল হোসেনের স্ত্রী জয়গন বেগম (৮০) ও জামুয়া গ্রামের মৃত আজিজুল হকের স্ত্রী বুলবুলি বেওয়া (৭৪)। তারা বলেন, আগে বয়স্ক ভাতার জন্য ব্যাংকে যেতে হতো। এখন পরিষদে এলেই বয়স্ক ভাতার আবেদন পাওয়া যাচ্ছে।
রতনকান্দি ইউনিয়ন ডিজিটাল সেন্টারে ব্যাংকঋণের জন্য ছবি তুলতে এসেছিলেন, আসাদ আলী-নাছিমা খাতুন দম্পতি। আধা ঘণ্টার মধ্যেই ছবি তুলে প্রিন্ট করে দিলেন উদ্যোক্তা।
এছাড়া পাসপোর্ট-ভিসার আবেদন, ব্যাংকিং সেবা, কৃষিসেবা, নতুন জাতীয় পরিচয়পত্রের আবেদন কিংবা সংশোধন, পরীক্ষার ফলাফল, চকরির আবেদন, জন্ম-মৃত্যুসনদ, ভূমি পরিষেবাসহ সব কিছুই এখন তাদের হাতের নাগালে। এক সময় কুসংস্কার আর গুজবের খোলসে বন্দি থাকা চাষিরা প্রযুক্তির আলোয় আলোকিত হয়েছে।
নাটুয়ারপাড়া ইউনিয়ন ডিজিটাল কেন্দ্রে সেবা নিতে আসা বৃদ্ধ সোলায়মান ও আয়েশা বেগম বলেন, এক সময় ফটোক তোলার জন্য টাউনে যাওয়া লাইগতো-অ্যাহন এহেনেই পাওয়া যায়। ট্যাকাও কম লাগে।
কলেজ ছাত্র মাহমুদুল হাসান সুমন বলেন, আমরা স্কুল-কলেজে ভর্তির আবেদন এখান থেকেই পাই, পরীক্ষার ফলাফল দ্রুত এখান থেকেই দেওয়া হয়।
কথা হয়, নাটুয়ারপাড়ার ইউডিসির উদ্যোক্তা আকতার হোসেন, কাওয়াকোলার ইউসুফ হোসাইন রিপন ও রতনকান্দির রুনা খাতুনের সঙ্গে। তারা বলেন, আমরা ইউনিয়ন ডিজিটাল সেন্টারের মাধ্যমে প্রায় ৭০টির মতো সেবা দিচ্ছি। এর মধ্যে রয়েছে, অনলাইনে জন্ম-মৃত্যু সনদ, ভূমি পরিষেবা, পাসপোর্ট-ভিসার আবেদন ও হজ নিবন্ধন, দেশের বিভিন্ন শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে ভর্তি পরীক্ষার আবেদন, ইন্টারনেটে যাবতীয় পাবলিক পরীক্ষার ফলাফল সরবরাহ, চাকরির আবেদন ও নিয়োগ সংক্রান্ত পরিষেবা, মোবাইল ব্যাংকিং, ই-পর্চার আবেদন, অনলাইনে বিদ্যুৎ বিল প্রদান, সব রাষ্ট্রায়ত্ব ব্যাংক-বিমাসেবার যাবতীয় তথ্য, কৃষক ও জেলে নিবন্ধন, উপবৃত্তির আবেদন, কৃষি বিষয় তথ্য, ভোটার হালনাগাদ, জাতীয় পরিচয়পত্র উত্তোলন, ভোটার স্থানান্তরের আবেদন জন্ম, ওয়ারিশিয়ান সনদসহ সব ধরনের প্রত্যয়ন পত্র, বয়স্ক ভাতা, বিধবা ভাতা ও প্রতিবন্ধী ভাতার আবেদন। এছাড়া ছবি তোলা, ফটোকপি, কম্পিউটার কম্পোজ, প্রিন্ট, কম্পিউটার প্রশিক্ষণ, ই-মেইল, ফেসবুক একাউন্ট খুলে দেওয়া হয়।
উদ্যোক্তারা আরও বলেন, আমরা প্রতিটি মানুষকে সঠিকভাবে সেবা দেওয়ার চেষ্টা করছি। এতে করে মাসে গড়ে ১০/১২ হাজার টাকার মতো আয় হয়। কোথাও কোথাও একাধিক উদ্যোক্তাও রয়েছেন।
কাওয়াকোলা ইউনিয়ন পরিষদ চেয়ারম্যান আব্দুল আলীম ভুঁইয়া বলেন, ডিজিটাল সেন্টারের কারণে ইউনিয়ন পরিষদের কাজও অনেক সহজ হয়ে গেছে। আমাদেরও কাজগুলো এ তথ্যকেন্দ্র থেকেই করা হয়।
চৌহালীর বাগুটিয়া ইউনিয়ন পরিষদ চেয়ারম্যান আব্দুল কাহ্হার সিদ্দীকি বাংলানিউজকে বলেন, চৌহালী উপজেলা যমুনা নদীর বিচ্ছিন্ন একটি দ্বীপের মতো। এখান থেকে জেলা শহরে যেতে এখনও একদিন লাগে। সেই জায়গায় ইউনিয়ন তথ্যকেন্দ্রগুলোর মাধ্যমে সাধারণ মানুষ প্রায় সব সুবিধাই পাচ্ছে। যাতে করে তাকে আর শহরমুখী হতে হচ্ছে না।
সহকারী কমিশনার (আইসিটি) মাসুদুর রহমান বাংলানিউজকে বলেন, জেলায় মোট ছয়টি পৌর ডিজিটাল সেন্টার ও ৮৩টি ইউনিয়ন ডিজিটাল সেন্টার রয়েছে। এর মধ্যে চারটি উপজেলার ১৮টি ইউনিয়ন সম্পূর্ণ দুর্গম চরাঞ্চলে অবস্থিত। চরের মানুষগুলোও এখন ডিজিটাল পরিষেবার আওতায় এসেছেন।
সিরাজগঞ্জ অতিরিক্ত জেলা প্রশাসক (শিক্ষা ও আইসিটি) মো. মুনীর হোসেন বাংলানিউজকে বলেন, প্রধানমন্ত্রীর নির্দেশে বাংলাদেশের প্রত্যেকটা প্রান্তিক জনগোষ্ঠীর কাছে ডিজিটাল সেবা পৌঁছে দেওয়া হচ্ছে। চরের মানুষেরাও বাদ নেই। বিদ্যুৎবিহীন চরাঞ্চলে সৌর বিদ্যুতের মাধ্যমে ডিজিটাল সেন্টারগুলো পরিচালিত হচ্ছে। রয়েছে ব্রন্ডব্যান্ড ইন্টারনেট সেবাও। চরের প্রত্যেক নাগরিক জমির খতিয়ান, পাসপোর্ট, ভিসা, চাকরি-ভর্তির আবেদনসহ সব সেবাই পেয়ে যাচ্ছেন বাড়ির কাছে। ফলে তাদের জীবনমানও পাল্টে যাচ্ছে।
বাংলাদেশ সময়: ১১২১ ঘণ্টা, মে ১২, ২০২১
এসআই