স্মরণকালের ভয়াবহ ভূমিকম্পে তুরস্কের বেশ কয়েকটি শহর এখন ধ্বংস্তুপের নিচে। উদ্ধারকর্মীরা তাদের কার্যক্রম চালিয়ে যাচ্ছেন।
তুরস্কে ভারী মাত্রার দুটি ভূমিকম্পের (একটি ৭ দশমিক ৮; অপরটি ৭ দশমিক ৬) আঘাতে সোমবার (২৩ ফেব্রুয়ারি) পর্যন্ত ৩০ হাজার মরদেহ উদ্ধার হয়েছে। আহতের সংখ্যা লাখে পৌঁছেছে। প্রচণ্ড শীতের কারণে ব্যাহত হচ্ছে উদ্ধার অভিযান। খাবার-পানি নিয়েও কষ্টে আছেন ভূমিকম্পের শিকার ভুক্তভোগীরা। খোলা আকাশের নিচে রাত কাটাতে গিয়েও অসুস্থ হয়ে পড়ছেন অনেকেই। সবচেয়ে বেশি অসুবিধা শিশুদের।
যারা পরিবার হারিয়েছেন, তাদের পরিস্থিতি শোচনীয়। যারা নিখোঁজ আছেন এখনও, তাদের ফিরে পাওয়ার আশাও ম্লান হয়ে গেছে। কিন্তু নাড়ি ছেড়া ধন কিংবা পরমাত্মীয়- তুরস্কের লোকেরা এখনও তাদের পাওয়ার আশা করছেন।
ঘটনার পর থেকে এমন বহু ঘটনা সামনে এসেছে। তুরস্কের আন্তাকা জেলায় বহু মানুষ এখনও তাদের প্রিয়দের খুঁজে পাওয়ার চেষ্টা করছেন। গত সোমবার (৬ ফেব্রুয়ারি) ভূমিকম্প আঘাত হানার পর আন্তাকার বাসিন্দা এরদেম আভসারোগ্লু হারিয়েছেন তার বোন, ভগ্নীপতি ও দুই ভাগনেকে। তিনি জানান, নিজেদের অ্যাপার্টমেন্ট ধসে আটকা পড়েছিলেন তার বোনের পরিবার। কিন্তু তারা জীবিত ছিলেন। উদ্ধারকারীদের সঙ্গে তারা যোগাযোগ করছিলেন।
কিন্তু পরিস্থিতি বদলে যায় মঙ্গলবার (৭ ফেব্রুয়ারি)। সে রাতে ওই অ্যাপার্টমেন্টের ধ্বংসস্তূপে একটি জেনারেটর বিস্ফোরিত হয়ে আগুন লেগে যায়। ঘণ্টার পর ঘণ্টা আগুন জ্বলছিল। আভসারোগ্লু, একজন পেশাদার অগ্নিনির্বাপক ও কয়েকজন উদ্ধারকর্মীর চেয়ে চেয়ে তা দেখা ছাড়া আর কোনো উপায় ছিল না। তারপর ওই অ্যাপার্টমেন্ট থেকে আর কোনো শব্দ পাওয়া যায়নি।
গতকাল রোববার (১২ ফেব্রুয়ারি) পর্যন্ত ওই ধ্বংসাবশেষের অবশিষ্টাংশ থেকে তাপ নির্গত হচ্ছিল। তারপরও উদ্ধারকর্মীররা ধ্বংসস্তূপটি সরিয়ে ফেলতে পরিশ্রম করছিলেন। কিন্তু সেখানে মানুষের কোনো অস্তিত্ব পাওয়া যায়নি।
আভসারোগ্লু বলেন, ভূমিকম্প ঘটে গেছে আটদিন। আমি শুধু তাদের লাশের একটি টুকরো খুঁজে পেতে চাই। কিন্তু আমরা কিছুই খুঁজে পাচ্ছি না। হয়ত তারা সবাই পুড়ে ছাই হয়ে গেছে।
ভূমিকম্পে ধসে পড়া অ্যাপার্টমেন্টে বাস ছিল ৮০ জনের। জেনারেটরে আগুন লাগার আগে ২১ জনকে উদ্ধার করা হয়েছিল। মৃতদেহ পাওয়া যায় ১২ জনের। ৪৭ জন এখনও নিখোঁজ। তাদের মধ্যেই রয়েছেন আভসারোগ্লু বোনের পরিবার। তিনি বলেন, আমাদের বুকের ব্যথা বেড়েই যাচ্ছে। যখন দেখছি শুধু হাড়গোড় পড়ে আছে। অনেকেই সেগুলো কুড়িয়ে নিয়ে যাচ্ছিলেন। কিন্তু আমার পরিবারের কাউকে অক্ষত পাওয়া যাচ্ছে না।
ধসে যাওয়া ভবনটির বয়স ছিল ১০ বছর। ভূমিকম্পে সেটি আক্রান্ত হওয়ায় উদ্ধারকারী ও ভুক্তভোগী পরিবারের সদস্যদের মধ্যে ব্যাপক ক্ষোভ দেখা যায়। ভবনের নির্মাণ নিয়েও তারা প্রশ্ন তোলেন। অনেক পুরনো স্থাপনার পাশেই ছিল নতুন ভবনটি। সেটির নিচতলায় ছিল সুপারমার্কেট। উদ্ধারকারীদের ভাষ্য, সুপারমার্কেটটির কাঠামো থেকে কলামগুলো (পিলার) সরিয়ে ফেলা হয়েছিল। তার প্রমাণ পাওয়া গেছে।
সেরহাত দেদে নামে এক উদ্ধারকারী একটি ধ্বংসাবশেষ থেকে তার নিজের পরিবারের লোকদের উদ্ধার করেছিলেন। কিন্তু তিনি তার বাবাকে বাঁচাতে পারেননি, পেরেছিলেন কেবল তার দাঁত শনাক্ত করতে। তিনি বলেন, রাষ্ট্র আমাদের সঠিকভাবে সমর্থন দিতে পারেনি। গত এক সপ্তাহ ধরে আমরা সরকারের কাছ থেকে কোনো সাহায্য পাইনি। যদি আমাদের সঠিক যন্ত্রপাতি থাকত তাহলে অন্তত ৫০ জনতে বাঁচাতে পারতাম।
ভূমিকম্পে আন্তাকা জেলার প্রায় সবখানেই ভবন ধসে পড়েছে। সংশ্লিষ্টরা বলছেন, ভবনগুলোর ধ্বংসের মাত্রা বোঝা কঠিন। যেগুলো দাঁড়িয়ে আছে, প্রতিটিতেই ফাঁটল রয়েছে। কিছু ভবন ভয়ঙ্করভাবে বিকৃত, আবার কিছু ঝুঁকিপূর্ণভাবে হেলে রয়েছে। শহরের বেশিরভাগ মানুষ পালিয়ে গেছে। যারা আছেন, তাদের মধ্যে কেউ গাড়িতে, কেউ অস্থায়ী আশ্রয়কেন্দ্রে বা উদ্ধারকারী পরিষেবার দেওয়া তাঁবুতে ঘুমাচ্ছে।
শহরে ডাকাতি-লুটপাটের মতো ঘটনাও ঘটছে। আভসারোগ্লু, দেদে অন্যান্যদের সহায়তায় তাদের এলাকায় লুটপাট প্রতিহত করতে চেষ্টা করছিলেন। রোববার থেকে শহরে সামরিক বাহিনী টহল শুরু করে। আপাতত শহর লুটপাটের হাত থেকে নিরাপদ বলা যায়।
শহরের বেশ কয়েকটি স্থানে অ্যাম্বুলেন্স দেখা গেছে। ক্রমাগত গাড়িগুলোয় সাইরেন বাজানো হচ্ছে। উদ্ধারকারীরা জীবিত মানুষ উদ্ধারের চেষ্টা করছেন। কয়েকজনকে জীবিত উদ্ধারও করা হয়েছে গত কয়েকদিনে। যদিও তার আশা কমে যাচ্ছে।
আন্তাকার ধ্বংসাবশেষগুলোয় অনুসন্ধানকারী ভারতীয় একটি দলের কর্মী জানিয়েছেন, তারা চারদিন আগে এসে এ জেলায় কাজ শুরু করেছেন। এখন পর্যন্ত কেবল মৃত মানুষ উদ্ধার করেছেন তারা। কাউকেই জীবিত পাননি। তারা চেষ্টা করছেন এবং জীবিত কাউকে খুঁজে পাওয়ার আশা করছেন।
শহরের একটি রাস্তার পাশে এক নারীকে তার স্বজনের মৃতদেহের পাশে বসে থাকতে দেখা যায়। শোক তাকে আঁকড়ে ধরলেও নিজেকে ফিরে পেতে চান তিনি। বলেন, আর তো উপায় নেই। আমাদের নিজেদেরই নিজেদের ঠিক করতে হবে।
আন্তাকা থেকে উপকূলের ঠিক ওপরে ইস্কেন্দারুন শহর। সেখানে ব্যবসা করতেন সেরিজান আগবাস। তার একটি ছোট টেক্সটাইল দোকান ছিল। ৩০ বছরের বেশি সময় ধরে ইস্কেন্দারুরে ব্যবসা করছেন তিনি। যে ভবনে তার দোকান ছিল, সেটি মাটিতে মিশে গেছে। পাঁচ তলা ওই ভবনের অন্তত ১০০ বাসিন্দা মারা গেছেন।
আগবাস বলেন, তিনি যে অ্যাপার্টমেন্টে বাস করতেন, সেটি এখনও দাঁড়িয়ে আছে। কিন্তু বহু ফাটল আছে ভবনে, সেটি অনিরাপদ। আমরা আমাদের প্রতিবেশীদের জন্য তাঁবু ও অন্যান্য সহায়তা চেয়েছি। সরকার থেকে এখনও পাইনি। আমাদের সবার জন্য মানসিক সমর্থন দরকার। সরকারের কাছ থেকে কেউ কিছু আশা করে না, আমাদের নিজেদেরকে ঠিক করতে হবে।
রোববার শহরের বিভিন্ন শিবিরে সরকার ও বিভিন্ন সংস্থা থেকে সহায়তা দেওয়া হয়েছে। তুরস্কের দুর্যোগ ও জরুরি সংস্থা এএফএডি বাস্তুচ্যুতদের থাকার জন্য শহরে তাঁবু তৈরি করে দিয়েছে। শহরের ফুটবল স্টেডিয়ামে সিরিয়ান শরণার্থীদের থাকার নির্দেশ দেওয়া হয়েছে। শহরের বাইরে একটি প্রদর্শনী কেন্দ্র তুরস্ক ও বিভিন্ন দেশের ২৬টি সুশীল সমাজ সংস্থার মাধ্যমে ক্ষতি লাঘবের চেষ্টা করে যাচ্ছে। স্বেচ্ছাসেবকরাও সমতলে-পাহাড়ে ভুক্তভোগীদের সেবা দিয়ে যাচ্ছেন।
ভূমিকম্পে ভুক্তভোগীর সরকার নিয়ে ক্ষোভ জন্মালেও এরদোয়ান সরকার জোর দিয়ে বলছে, দুর্যোগের মাত্রা বিবেচনা করে সবকিছুই করা হচ্ছে, করা হবে। আগামী এক বছরের মধ্যে ভূমিকম্পে ক্ষতিগ্রস্ত সব এলাকা পুনর্নির্মাণের প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন প্রেসিডেন্ট রিসেপ তাইয়েপ এরদোয়ান।
তার প্রতিশ্রুতি হিসেবে আন্তাকা শহরকে নতুন করে নির্মাণ করতে হবে। সংশ্লিষ্টরা বলছেন, শহরের বেশিরভাগ অংশ মাটিতে পড়ে আছে।
বাংলাদেশ সময়: ১৬৩০ ঘণ্টা, ১৩ ফেব্রুয়ারি ২০২৩
এমজে