ঢাকা, শনিবার, ৭ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ২৩ নভেম্বর ২০২৪, ২১ জমাদিউল আউয়াল ১৪৪৬

আন্তর্জাতিক

ফুকুশিমা পরমাণু বিদ্যুৎকেন্দ্রের বর্জ্য পানি সাগরে ফেলা নিয়ে কেন উদ্বেগ?

আন্তর্জাতিক ডেস্ক | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ২০২৫ ঘণ্টা, আগস্ট ২৭, ২০২৩
ফুকুশিমা পরমাণু বিদ্যুৎকেন্দ্রের বর্জ্য পানি সাগরে ফেলা নিয়ে কেন উদ্বেগ?

ফুকুশিমা পরমাণু বিদ্যুৎকেন্দ্র থেকে তেজস্ক্রিয় দূষণ-যুক্ত পানি প্রশান্ত মহাসাগরে ছাড়া শুরু করেছে জাপান।  এই কেন্দ্রটি ১২ বছর আগে সুনামিতে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছিল।

বিতর্কিত এই পদক্ষেপের বিরুদ্ধে জাপানের সচেতন নাগরিকরাই প্রতিবাদে সোচ্চার।  দক্ষিণ কোরিয়াও এর প্রতিবাদ জানিয়েছে। অন্যদিকে চীন শুধু প্রতিবাদ জানিয়েই ক্ষান্ত হয়নি, জাপান থেকে সব ধরনের সামুদ্রিক খাবার আমদানি বন্ধ করে দিয়েছে।

তবে জাতিসংঘের পরমাণু নিয়ন্ত্রক সংস্থা বলছে, এই পানিতে তেজস্ক্রিয় দূষণের মাত্রা এত কম যে, তা মানুষ ও পরিবেশের ওপর খুব সামান্যই প্রভাব ফেলবে।

জাপানে ২০১১ সালে এক ভূমিকম্পের পর যে সুনামি সৃষ্টি হয়, তা ফুকুশিমা পরমাণু কেন্দ্রটি প্রায় ধ্বংস করে ফেলে। কেন্দ্রটির শীতলীকরণ ব্যবস্থা বিকল হয়ে গিয়েছিল। এর ফলে পরমাণু চুল্লির কেন্দ্রটি সাংঘাতিক উত্তপ্ত হয়ে ওঠে। এই কেন্দ্রের পানি তখন তেজস্ক্রিয় পদার্থের সঙ্গে মিশে দূষিত হয়ে পড়ে।

জানা গেছে, আন্তর্জাতিক পরমাণু শক্তি সংস্থার অনুমতি নিয়েই জাপান ওই তেজস্ক্রিয় পানি সাগরে ছাড়ছে। তবে এর গতি এতটাই ধীর যে, সব ট্যাংকের পানি ছাড়ার প্রক্রিয়া শেষ হতে সময় লাগবে ৩০ থেকে ৪০ বছর।

জাপান যদি এই বর্জ্য পানি সাগরে ছাড়ার আগে তা থেকে সব তেজস্ক্রিয় পদার্থ তুলে নিতে পারতো, তাহলে হয়তো তাদের এই পদক্ষেপটি এত বিতর্কিত হতো না।

এই সমস্যার মূলে রয়েছে হাইড্রোজেনের একটি তেজস্ক্রিয় উপাদান, যেটির নাম ট্রাইটিয়াম। পানি থেকে এটি আলাদা করা যায় না, কারণ এটি করার মতো কোনো প্রযুক্তি এখনো পর্যন্ত নেই। এর পরিবর্তে এই দূষিত পানিতে আরও পানি মিশিয়ে এটিকে হালকা করে দেওয়া হচ্ছে।

ফুকুশিমা কেন্দ্রের দূষিত পানি বিশাল বিশাল ট্যাংকে অনেক বছর ধরে সংরক্ষণ করা হচ্ছে। বিশেষজ্ঞদের বেশিরভাগের মত হলো, এই দূষিত পানি এখন সাগরে ছেড়ে দেওয়া নিরাপদ। কিন্তু এর কী প্রভাব আসলে পড়বে, তা নিয়ে সব বিজ্ঞানী একমত নন।

বিশ্বের সব জায়গার পানিতেই ট্রাইটিয়াম পাওয়া যায়। অনেক বিজ্ঞানী যুক্তি দেন যে, ট্রাইটিয়ামের মাত্রা যদি খুব কম হয়, এর প্রভাব একেবারেই সামান্য।

তবে সমালোচকদের মত হলো, সাগরের তলদেশে, সামুদ্রিক প্রাণী ও মানুষের ওপর কী প্রভাব পড়ে, তা নিয়ে আরও গবেষণা দরকার।

আইএইএ বলছে, ফুকুশিমায় পরমাণু কেন্দ্রের কাছে ‘স্বাধীনভাবে করা বিশ্লেষণে’ দেখা যাচ্ছে, সেখানে সাগরে ছাড়া বর্জ্য পানিতে ট্রাইটিয়ামের মাত্রা নিরাপদ সীমার অনেক নীচে আছে। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা খাবার পানিতে ট্রাইটিয়ামের যে নিরাপদ সীমা নির্ধারণ করে দিয়েছে, ফুকুশিমার বর্জ্য পানিতে ট্রাইটিয়ামের পরিমাণ তার চেয়েও ছয়গুণ কম।

শুক্রবার টেপকো বলেছে, বৃহস্পতিবার বিকেলে সাগরের পানির যে নমুনা তারা সংগ্রহ করেছে, তাতে দেখা যায়, পানিতে তেজস্ক্রিয়তার মাত্রা নিরাপদ সীমার মধ্যেই আছে। সেখানে ট্রাইটিয়ামের মাত্রা প্রতি লিটারে ১,৫০০ বিকিউর নিচে।

জাপানের পরিবেশ মন্ত্রণালয় বলছে, তারাও শুক্রবার ১১টি ভিন্ন ভিন্ন জায়গায় সাগরের পানির নমুনা সংগ্রহ করেছে এবং এই পানি পরীক্ষার ফল রোববার প্রকাশ করার কথা রয়েছে।

পোর্টসমাউথ বিশ্ববিদ্যালয়ের এনভায়রনমেন্ট অ্যান্ড জিওলজিক্যাল সায়েন্সের অধ্যাপক জেমস স্মিথ বলেন, তাত্ত্বিকভাবে দেখলে, আপনি এই পানি পান করতে পারবেন। কারণ এই বর্জ্য পানি এরই মধ্যে দূষণ-মুক্ত করা হয়েছে, এরপর এটির সঙ্গে আরও পানি মিশিয়ে দূষণের ঘনত্ব আরও কমিয়ে দেওয়া হয়েছে।

একটি ফরাসী গবেষণাগারের একজন পদার্থবিদ ডেভিড বেইলি একথার সঙ্গে একমত। তিনি বলেন, মূল প্রশ্ন হলো সেখানে কী পরিমাণ ট্রাইটিয়াম আছে।

যে মাত্রায় ট্রাইটিয়াম এই পানিতে আছে, তাতে সামুদ্রিক প্রাণীর কোনো সমস্যা হওয়ার কথা নয়। যদি না সেখানে হঠাৎ করে সামুদ্রিক জীবের সংখ্যা মারাত্মকভাবে কমে যায়।

তবে কিছু বিজ্ঞানীর অভিমত, সাগরে বর্জ্য পানি ছাড়ার ফল কী হবে, তা আগে থেকে অনুমান করা যায় না।

যুক্তরাষ্ট্রের জর্জ ওয়াশিংটন ইউনিভার্সিটির জ্বালানি এবং পরিবেশ আইনবিষয়ক বিশেষজ্ঞ প্রফেসর এমিলি হ্যামন্ড বলেন, ট্রাইটিয়ামের মতো রেডিওনিউক্লাইডস নিয়ে চ্যালেঞ্জটা হলো এটি এমন এক প্রশ্ন ছুড়ে দিচ্ছে যার উত্তর এখনো বিজ্ঞান পুরোপুরি দিতে পারছে না। অর্থাৎ খুবই কম মাত্রায় যখন তেজস্ক্রিয় দূষণ হচ্ছে, তখন সেখানে নিরাপদ মাত্রাটি আসলে কী?

পরিবেশকর্মীরা ফুকুশিমা পরমাণু কেন্দ্রের বর্জ্য পানি সাগরে ছাড়ার বিরুদ্ধে প্রতিবাদ জানাচ্ছেন।  

যুক্তরাষ্ট্রের ন্যাশনাল এসোসিয়েশন অব মেরিন ল্যাবরেটরিজ ২০২২ সালের ডিসেম্বরে একটি বিবৃতি দিয়ে বলেছে, তারা জাপানের প্রকাশ করা তথ্যে সন্তুষ্ট নয়।

ইউনিভার্সিটি অব হাওয়াইয়ের মেরিন বায়োলজিস্ট রবার্ট রিচমন্ড বিবিসিকে বলেন, রেডিওলজিক্যাল ও পরিবেশগত প্রভাবের বিষয়ে যে মূল্যায়ন করা হয়েছে, তা যথেষ্ট নয়। আমরা এ নিয়ে উদ্বিগ্ন।

গ্রিনপিসের মতো পরিবেশবাদী গোষ্ঠী ইউনিভার্সিটি অব সাউথ ক্যারোলাইনার বিজ্ঞানীদের এপ্রিলে প্রকাশিত এক গবেষণার কথা উল্লেখ করে এক্ষেত্রে আরও কঠোর অবস্থান নিয়েছে।

জাপান সাগরে বর্জ্য পানি ছাড়ার পর জাপানি সামুদ্রিক খাবার আমদানি নিষিদ্ধ করেছে চীন। কোনো কোনো বিশ্লেষক মনে করেন, এটি হয়তো একটি রাজনৈতিক চাল। কারণ বিশেষজ্ঞরা বলছেন, তেজস্ক্রিয়তার মাত্রা এত কম যে, সামুদ্রিক খাবার নিয়ে উদ্বিগ্ন হওয়ার মতো কোনো বৈজ্ঞানিক তথ্য প্রমাণ তারা দেখছেন না।

কিন্তু প্রশান্ত মহাসাগর এলাকায় যাদের নিত্যদিন যেতে হয়, তাদের অনেকে উদ্বিগ্ন।

দক্ষিণ কোরিয়ায় যে ঐতিহ্যবাহী সামুদ্রিক ডুবুরিরা ‘হাইনিও’ নামে পরিচিত, তারা বিবিসিকে বলেছেন, তারা দুশ্চিন্তায় আছেন।

জাপানি কর্তৃপক্ষ বলছে, বর্জ্য পানি যে ক্ষতিকর নয়, তা নিশ্চিত করার জন্য সামুদ্রিক জীবের ওপর অনেক পরীক্ষা চালানো হয়েছে।  

বিশেষজ্ঞরা বলছেন, বর্জ্য পানি সাগরের স্রোতে ভেসে যাবে, বিশেষ করে প্রশান্ত মহাসাগরের কুরুশিও স্রোতে।

অন্যদিকে জাপানের জেলেরা বিবিসিকে বলেছেন, তারা তাদের জীবিকা নিয়ে চিন্তিত।

প্যাসিফিক আইল্যান্ডস ফোরামের সভাপতি এবং কুক আইল্যান্ডসের প্রধানমন্ত্রী মার্ক ব্রাউন বলছেন, আইএইএর মতো তিনিও মনে করেন, এখানে নিরাপত্তার মানদণ্ড মেনে চলা হচ্ছে।  

সূত্র: বিবিসি

বাংলাদেশ সময়: ২০১৭ ঘণ্টা, আগস্ট ২৭, ২০২৩
আরএইচ

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।