সেপ্টেম্বরের শেষদিকে যখন লেবাননে বেপরোয়া বোমা বর্ষণ শুরু করে ইসরায়েল, তখন তিন সন্তানকে সান্ত্বনা দিতে বেশ বেগ পোহাতে হচ্ছিল শিফা নামের এক নারীর।
তার সবচেয়ে বড় সন্তান ১২ বছর বয়সী রানিম।
কালো রঙের আবায়ায় নিজেকে ঢেকে প্লাস্টিকের চেয়ারে বসে আল জাজিরার সাংবাদিকের সঙ্গে কথা বলছিলেন শিফা। পাশেই বসে ছিল রানিম। বাকি দুই সন্তান তাদের পেছনে খেলছিল।
সামনের দিকে কিছুটা ঝুঁকে ভয়াবহ অভিজ্ঞতার বর্ণনা দিচ্ছিলেন শিফা। তিনি বলছিলেন, ২৫ সেপ্টেম্বর লেবাননের বেকা উপত্যকার আলি এল-নাহরি গ্রামে তাদের বাড়ির বিপরীতে থাকা একটি ভবনে বোমা বর্ষণ করে ইসরায়েলি বাহিনী। গ্রামটি রাজধানী বৈরুত থেকে প্রায় ৩৫ কিলোমিটার (২৫ মাইল) দূরে অবস্থিত।
ইসরায়েলের ওই হামলায় বিস্ফোরণ এতই ভয়াবহ ছিল, শিফার অ্যাপার্টমেন্টের জানালার কাচ ভেঙে চূর্ণবিচূর্ণ হয়ে যায়। দরজাগুলো কবজা থেকে ছিটকে পড়ে। তার পরিবার বেঁচে যায়। কিন্তু তার প্রতিবেশী ও স্বজনরা এতটা ভাগ্যবান ছিলেন না।
৪০ বছর বয়সী শিফা আল জাজিরাকে বলেন, শহীদরা আমাদের পরিচিতই: আমার চাচা ও তার পরিবার, আমাদের প্রতিবেশী এবং আমার ভাইবোনের সন্তানদের হারিয়েছি।
উদারতার নজির
শিফা, তার স্বামী বিলাল ও তাদের তিন সন্তান কয়েকটি গ্রাম পেরিয়ে অনেকটা অপ্রত্যাশিতভাবেই গিয়ে পৌঁছান বার ইলিয়াস শহরে।
তার দেওয়া বর্ণনা অনুযায়ী, তারা আসলে শত শত বাস্তুচ্যুত লোকের সঙ্গে পালাচ্ছিলেন। ওই বাস্তুচ্যুতরা সবাই বেকা উপত্যকার সুন্নি মুসলিম প্রধান শহরটির দিকেই যাচ্ছিলেন।
সেখানে তারা দেখতে পান, আশ্রয়কেন্দ্রগুলো খুলে দেওয়া হচ্ছে এবং স্থানীয় বাসিন্দারা নবাগতদের ব্যক্তিগত সামগ্রী দান করছেন। বার ইলিয়াস শহরের বাসিন্দাদের উদারতায় আশ্চর্য হওয়ার কিছু নেই। শরণার্থীদের স্বাগত জানানোর নজির রয়েছে এই শহরের।
জাতিসংঘের শরণার্থীবিষয়ক সংস্থার (ইউএনএইচসিআর) দেওয়া তথ্য অনুযায়ী, ২০১১ সালে সিরিয়ার সরকার জনপ্রিয় বিদ্রোহ দমন করার পর শুরু হওয়া গৃহযুদ্ধ থেকে পালিয়ে ৩১ হাজার থেকে ৪৫ হাজার সিরীয় শরণার্থী বার ইলিয়াসে আশ্রয় নেন।
এর বিপরীতে ওই শহরে লেবানিজ জনসংখ্যা ৬০ হাজার থেকে ৭০ হাজার। এখন সশস্ত্র গোষ্ঠী হিজবুল্লাহর মূল সমর্থনকেন্দ্র লেবাননের শিয়া অধ্যুষিত অঞ্চলগুলো থেকে কয়েক হাজার মানুষ পালিয়ে বার ইলিয়াসে আশ্রয় নিয়েছেন। সেখানে তারা নিরাপত্তা ও সহায়তা খুঁজে পেয়েছেন।
হিজবুল্লাহর সঙ্গে যুদ্ধবিরতিতে সম্মত হয়েছে ইসরায়েল। বুধবার ভোর থেকে এ যুদ্ধবিরতি শুরু হয়। এরপরও হাজার হাজার বাসিন্দা তাদের নিজেদের বাড়িতে ফিরতে পারবেন না কারণ। কেননা তাদের গ্রাম, জীবনধারা পরিকল্পিত হামলায় ধ্বংস হয়ে গেছে।
এর অর্থ হলো, বার ইলিয়াস আগামী কয়েক মাস কিংবা কয়েক বছর পর্যন্ত সময়ের জন্য এই বাস্তুচ্যুতদের নতুন ঠিকানা হতে যাচ্ছে, যতদিন না তারা নিজ ভূমিতে ফিরে গিয়ে নিজেদের জীবন পুনর্গঠন করতে পারেন।
নৈতিক দায়িত্ব
শিফার পরিবার এখন বার ইলিয়াসের আল-আমিন বেসরকারি স্কুলে আশ্রয় নিয়েছেন। লেবাননে ইসরায়েলের যুদ্ধ শুরু হওয়ার পর স্কুলটিকে আশ্রয়কেন্দ্রে রূপ দেওয়া হয়।
নিজের অফিসে বসেই ওই স্কুলের প্রধান শিক্ষক বিলাল মোহাম্মদ আরাজি আল জাজিরাকে বলেন, মানুষকে সহায়তা করা আমাদের নৈতিক, মানবিক ও ধর্মীয় দায়িত্ব।
স্থানীয় পৌরসভার দেওয়া তথ্য অনুযায়ী, বার ইলিয়াস শহর নতুন পাঁচ হাজার ৮৫০ বাস্তুচ্যুতকে আশ্রয় দিয়েছে। এর মধ্যে প্রায় ১৯০ জন বিলালের স্কুলে আশ্রয় নিয়েছেন।
শিফা ও তার পরিবার বলছে, সেখানে তারা স্বাচ্ছন্দ্যবোধ করছেন। তাদের ভালোভাবেই দেখভাল করা হচ্ছে।
খাটো টাকমাথা ও ধূসর দাড়িওয়ালা আলিরও (এটি তার আসল নাম নয়) বর্তমান ঠিকানা আল-আমিন স্কুল। বার ইলিয়াসের মানুষ ও আল-আমিন স্কুলের অতিথিপরায়ণতার ভীষণ প্রশংসা করেন তিনি।
৬৫ বছর বয়সী এই ব্যক্তি তার স্ত্রীকে নিয়ে গত সেপ্টেম্বরে নাবাতিয়াহ শহর থেকে পালিয়ে আসেন। তিনি আল জাজিরাকে বলেন, একসময় তার একটি বড় বাড়ি ছিল এবং তিনি গাড়িবিক্রেতা হিসেবে স্থায়ী চাকরিতে ছিলেন। কিন্তু যুদ্ধ তীব্র হলে তিনি আশ্রয়ের জন্য পাশের গ্রামে থাকা তার খালার কাছে যান। তিন দিন পর তিনি, তার স্ত্রী এবং খালার পরিবারের সবাই আবার পালাতে বাধ্য হন।
আলি বলেন, পালানোর দুই-তিন দিন পর প্রতিবেশীদের কাছ থেকে আমি শুনেছিলাম, আমার খালার বাড়িতে বোমা হামলা হয়েছে।
আলি ও তার খালার পরিবারের সদস্যরা সহায়তা পাওয়ার আশায় প্রথমে বেকা উপত্যকার পরিবহনকেন্দ্র চতুরার দিকে রওনা দেন। সেখানে তিনি জানতে পারেন, বার ইলিয়াস বাস্তুচ্যুত পরিবারগুলোকে আশ্রয় দিচ্ছে। তা শুনেই ওই শহরে যান তিনি।
বাস্তুচ্যুতদের আশ্রয় দেওয়ার ক্ষেত্রে অন্য গ্রামগুলো কম আন্তরিক ছিল। তাদের ভয় ছিল, ‘হিজবুল্লাহ সদস্যকে আশ্রয় দেওয়া’র জন্য ইসরায়েল তাদের ওপর হামলা চালাতে পারে। লেবাননজুড়ে হামলা চালানোর ক্ষেত্রে ইসরায়েল এ যুক্তিকেই ব্যবহার করেছে।
প্রধান শিক্ষক আরাজি আতঙ্কটা বুঝতে পারছেন না। তিনি বলেন, শুধু বার ইলিয়াসে নয়, বিপদ তো সবখানে। (ইসরায়েল) আমাদের শত্রু। কে জানে তারা কোথায় আক্রমণ করবে বা পরবর্তী লক্ষ্য কী? কেউ জানে না।
এক সুতোয় উদ্বেগ ও আনন্দের অনুভূতি
বার ইলিয়াস বাস্তুচ্যুতদের আশ্রয় দিয়েছে ঠিকই, তবে অনেক সময় ধরে সহায়তা দিয়ে যাওয়ার মতো প্রয়োজনীয় পুঁজি বা সম্পদ এই শহরের নেই।
জয়নব দিরানি নামে নারীবাদী সংগঠন ‘ফিমেল’-এর স্থানীয় ত্রাণকর্মী জানান, সরকারি সহায়তার অভাব এবং ত্রাণ সংস্থাগুলোর সীমিত সহায়তার কারণে বাস্তুচ্যুত পরিবারের মধ্যে ছোটখাটো বিরোধ সৃষ্টি হচ্ছে।
তিনি জানান, কিছু বাস্তুচ্যুত পরিবার অন্যান্যদের তুলনায় সামাজিকভাবে আরও আলাদা, যা বিরোধ ও সংঘর্ষ সৃষ্টি করছে।
দিরানি ব্যাখ্যা করেন, বাস্তুচ্যুতদের যারা দক্ষিণে বাস করতেন, তারা উত্তরের চেয়ে আলাদা। তাদের পারিবারিক সমস্যা মোকাবিলার পদ্ধতিতে পার্থক্য রয়েছে... এবং কিছু পরিবার তাদের সন্তানদের নতুন মানুষের সঙ্গে দেখা করতে বা পরিচিত হতে দেয় না।
প্রধান শিক্ষক আরাজি বলেন, তার স্কুলে আশ্রয় নেওয়া বাস্তুচ্যুত পরিবারগুলো যুদ্ধবিরতি ও যুদ্ধের সম্ভাব্য সমাপ্তির সংবাদে উচ্ছ্বসিত।
তিনি আল জাজিরাকে বলেন, কিছু পরিবার তার স্কুল থেকে গ্রামে ফিরে গেছে। তিনি আশা করছেন, আসন্ন দিনগুলোতে আরও অনেকে গ্রামে ফিরতে পারবেন।
তিনি বলেন, সৃষ্টিকর্তাকে ধন্যবাদ। এখানকার লোকেরা এখন খুশি। সৃষ্টিকর্তার ইচ্ছায়, সবাই এখন বাড়ি ফিরতে পারবেন।
আল জাজিরা থেকে অনুবাদ করেছেন বাংলানিউজের সিনিয়র নিউজরুম এডিটর রকিবুল সুলভ
বাংলাদেশ সময়: ১৬৫৩ ঘণ্টা, নভেম্বর ২৮, ২০২৪
আরইচ