ঢাকা: সময় ঘুরতে থাকে, ঘুরতেই থাকে, এই ঘূর্ণায়মান চক্রেই মহাকালে ঢুকে যায় এক একটি বছর। সেই চক্রে ঘুরেই মহাকালে শেষ হতে চলেছে ২০১৪ সাল।
তবে ২০১৪ সালটি বিশেষত দাগ কেটে রাখবে মার্কিন মুলুকের ইতিহাসে। কারণ, দীর্ঘসময় পর এই বছরই যুক্তরাষ্ট্রের ‘বর্ণবাদী’ আচরণের জঘন্য পুনরাবৃত্তি দেখলো বিশ্ববাসী।
খোদ দেশটির মানবাধিকারকর্মীরাই বলছেন, আগে এ ধরনের ঘটনা ঘটলেও এবছরই বেশ মাথা চাড়া দিয়ে উঠেছে বর্ণবাদী বৈষম্য! বর্ণ-সমতার কথা বলা হলেও সবচে শক্তিধর এই রাষ্ট্রে জাতিগত ও বর্ণবাদী বিদ্বেষে কয়েকজন কৃষ্ণাঙ্গ নিহত হয়েছেন।
সেসব ঘটনার জের ধরে কয়েকজন শ্বেতাঙ্গ পুলিশ কর্মকর্তাকে গুলি করে হত্যা করেছে দুর্বৃত্তরা। এসব ঘটনায় জুলাইয়ের পর প্রায় পুরো সময়টাই উত্তাল ছিল যুক্তরাষ্ট্র।
কৃষ্ণাঙ্গ নাগরিক হত্যা, সেসব ঘটনার জেরে পুলিশ কর্মকর্তাদের গুলি করে হত্যার ঘটনা -সবই বিশ্ববাসীর নজরে এসেছে।
জালিয়াতির অভিযোগ তুলে ১৭ জুলাই নিউইয়র্কের এরিক গার্নার নামে এক সিগারেট ব্যবসায়ীকে ধরতে যায় স্থানীয় পুলিশ। আটকের সময় এক শ্বেতাঙ্গ পুলিশ কর্মকর্তা তার গলা পেঁচিয়ে ধরলে শ্বাসরুদ্ধ হয়ে এরিকের মৃত্যু হয়।
মানবাধিকারকর্মীরা জানান, স্ট্যাটেন আইল্যান্ডের রাস্তায় পুলিশ আটক করতে গেলে এরিক বাধা দিলে তাকে জোর করে হাতকড়া পরানো হয়। এসময়ই তার গলায় শক্ত করে পেঁচিয়ে ধরা হয়। একজন প্রত্যক্ষদর্শী তার মোবাইল ফোনে ওই মর্মান্তিক দৃশ্যটি ধারণ করেন।
এই ঘটনার ময়নাতদন্ত প্রতিবেদন প্রকাশিত হওয়ার আগেই ৯ আগস্ট মিসৌরি অঙ্গরাজ্যের সেন্ট লুইসের ফার্গুসনে শ্বেতাঙ্গ পুলিশ কর্মকর্তা ড্যারেন উইলসনের গুলিতে নিহত হন নিরস্ত্র কৃষ্ণাঙ্গ তরুণ মাইকেল ব্রাউন (১৮)।
এ হত্যাকাণ্ডের ঘটনাকে কেন্দ্র করে সেন্ট লুইসে ব্যাপক প্রতিবাদ বিক্ষোভ শুরু হয়। কৃষ্ণাঙ্গদের সঙ্গে বেশ কয়েকবার সংঘর্ষের ঘটনাও ঘটে। এটাকে বর্ণবাদী হত্যাকাণ্ড হিসেবে উল্লেখ করে জড়িত পুলিশ কর্মকর্তার বিচার দাবি করেন কৃষ্ণাঙ্গরা। দাবির পরিপ্রেক্ষিতে জুরি বোর্ডও গঠন করা হয়।
কিন্তু গ্র্যান্ড জুরি বোর্ডের রায়ে পুলিশ সদস্যকে খালাস দেওয়া হয়। এতে বিক্ষোভে ফেটে পড়ে মিসৌরিসহ পুরো যুক্তরাষ্ট্র। বিক্ষোভ ছড়িয়ে পড়ে শিকাগো, ডেট্রয়েটসহ কৃষ্ণাঙ্গ অধ্যুষিত এলাকায়।
এই বিক্ষোভে যখন আগুন ঝরছে তখন নিউইয়র্কের এরিক গার্নার শ্বেতাঙ্গ পুলিশের হাতে শ্বাসরুদ্ধ হয়ে খুন হয়েছেন বলে ময়নাতদন্তের প্রতিবেদন প্রকাশ হয়।
কিন্তু ধারণকৃত ভিডিও ও প্রত্যক্ষদর্শীদের বক্তব্য পাওয়ার পরও সন্দেহভাজন শ্বেতাঙ্গ পুলিশ কর্মকর্তার বিরুদ্ধে কোনো অভিযোগ গঠনের সিদ্ধান্ত দেননি গ্র্যান্ড জুরি বোর্ড।
‘বিচারহীনতার’ দুই ঘটনা মিলিয়ে পুরো বেকায়দায় পড়ে যায় কৃষ্ণাঙ্গ প্রেসিডেন্ট বারাক ওবামার সরকার।
ফার্গুসনের কৃষ্ণাঙ্গ হত্যাকাণ্ডে অভিযুক্ত পুলিশ কর্মকর্তা ড্যারেন উইলসন স্বীকাররোক্তি দিয়ে সংবাদমাধ্যমকে বলেন, ব্রাউন নিহত হওয়ায় আমি দুঃখিত, কিন্তু এজন্য আমি বিবেকের কাছে দায়ী নই।
‘ব্রাউনের জায়গায় কোনো শ্বেতাঙ্গ থাকলে গুলি করার প্রশ্নই আসতো না’ বলেও দাম্ভিক মন্তব্য করেন তিনি।
উইলসনের বিচার না হওয়ায় এবং প্রকাশ্যে তার বর্ণবাদী দাম্ভিক বক্তব্যে আরও টালামাটাল হয়ে ওঠে ফার্গুসন, মিসৌরি মিলিয়ে পুরো যুক্তরাষ্ট্রে। একসময় বিক্ষোভকারীদের দাপটে উত্তপ্ত ফার্গুসনে প্রায় এক সপ্তাহ সামরিক বাহিনী মোতায়েন রাখা হয়।
এ দুই হত্যাকাণ্ডের ক্ষোভ যখন তলিয়ে যাচ্ছিল, তখনই বছর অন্তে ২৪ ডিসেম্বর সেই মিসৌরিরই বার্কলে শহরে অ্যান্টোনিও মার্টিন নামে ১৮ বছরের আরেক কৃষ্ণাঙ্গ কিশোরকে গুলি করে হত্যা করে পুলিশ।
পুলিশের পক্ষ থেকে দাবি করা হয়, আত্মরক্ষার জন্য পাল্টা গুলি ছোঁড়া হয়েছে। তবে নিহত কিশোরের পরিবার বলছ, ‘বিবাদের’ কারণেই এ হত্যাকাণ্ড চালায় শ্বেতাঙ্গ পুলিশ।
এছাড়া, মার্টিনকে ‘অপরাধী’ বলেও দাবি করা হচ্ছে নিউইয়র্ক পুলিশের পক্ষ থেকে। কিন্তু এ ঘটনার পুরো সত্যতা এখনও স্পষ্ট হয়নি।
কৃষ্ণাঙ্গ হত্যার এসব ঘটনার মধ্যেই নিউইয়র্ক ও নেভাদায় কয়েকজন পুলিশ কর্মকর্তা বন্দুকধারীর গুলিতে নিহত হন।
সংবাদমাধ্যমের খবরে বলা হয়, গত ২০ ডিসেম্বর বাল্টিমোরে সাবেক বান্ধবীকে গুলি করে নিউইয়র্কের ব্রুকলিনে গিয়ে দুই পুলিশ সদস্যকে হত্যা করে ২৮ বছর বয়সী এক যুবক। কিন্তু সেই আত্মঘাতী যুবক বিক্ষোভকারীদেরই অর্থাৎ কৃষ্ণাঙ্গ বলে কিছু সংবাদ মাধ্যমে দাবি করা হচ্ছে।
নিউইয়র্কের দুই পুলিশ কর্মকর্তাকে হত্যার আগে ৮ জুন নেভাদা অঙ্গরাজ্যের লাস ভেগাসে দুই পুলিশ সদস্যকে হত্যা করে দুই আত্মঘাতী বন্দুকধারী। রেস্টুরেন্টে ঢুকে দুপুরের খাবার গ্রহণরত পুলিশ সদস্যদের খুন করার সময় ‘এটা বিপ্লব’ বলেও স্লোগান দেয় তারা। এ ঘটনায় ‘কৃষ্ণাঙ্গ’দের অভিযুক্ত করে স্থানীয় পুলিশ।
আন্তর্জাতিক সংবাদ মাধ্যমগুলোর বিশ্লেষকরা বলছেন, একবিংশ শতাব্দীতে এসেও যুক্তরাষ্ট্রে কৃষ্ণাঙ্গ জনগোষ্ঠীকে সব সময় আতঙ্কে বসবাস করতে হচ্ছে। প্রতিনিয়তই শ্বেতাঙ্গ পুলিশের হয়রানির শিকার হতে হচ্ছে তাদের।
তাদের ওপর নির্যাতন করা হচ্ছে বুঝলেও কোনো বাতচিত করা যায় না। নির্যাতন সহ্য করার মানসিক প্রস্তুতি নিয়েই ঘর থেকে বের হতে হয়।
মার্কিন বিচার বিভাগের এক পরিসংখ্যানে বলা হয়, ২০০৩ থেকে ২০০৯ পর্যন্ত ২ হাজার ৩৯১টি গ্রেফতারের ঘটনা ঘটে যুক্তরাষ্ট্রে। এর মধ্যে ৩২ শতাংশই ঘটেছে কৃষ্ণাঙ্গদের ক্ষেত্রে, যারা মোট জনগোষ্ঠীর ১৩ শতাংশ।
এছাড়া, শ্বেতাঙ্গদের তুলনায় অন্তত তিনগুণ বেশি কৃষ্ণাঙ্গদের ট্রাফিক তল্লাশিতে জিজ্ঞাসাবাদ করা হয় বলে সমীক্ষায় জানায় লিবারেল সেন্টার ফর আমেরিকান প্রগ্রেস নামে একটি গবেষণা প্রতিষ্ঠান।
একইসঙ্গে আফ্রিকান বংশোদ্ভূত মার্কিনিদের প্রতি তিনজনে একজনকে কারাগারে থাকতে হয় বলেও সমীক্ষাটিতে উল্লেখ করা হয়।
প্রথম কৃষ্ণাঙ্গ প্রেসিডেন্ট হিসেবে বারাক ওবামা দায়িত্ব নেওয়ার পর কৃষ্ণাঙ্গদের মধ্যে আশার সঞ্চার হয়েছিল যে এবার বোধহয় সুগভীর বর্ণবিভেদ কাটবে! তবে বাস্তবে তা হয়নি।
খোদ ওবামাকেই ‘রাজনীতি’র খাতিরে চুপ থাকতে হয়েছে এসব বৈষম্যমূলক আচরণ দেখেও। তার ক্ষমতার প্রথম মেয়াদে ২০১২ সালের ফেব্রুয়ারিতে প্রতিবেশী জিমেরম্যান নামে এক শ্বেতাঙ্গের গুলিতে ট্রেভোন মার্টিন নামে এক কৃষ্ণাঙ্গ তরুণ নিহত হয়।
সে ঘটনায় ওবামা কৃষ্ণাঙ্গ হিসেবে তার নিজের স্মৃতির পাতা খুলে বলেন, ৩৫ বছর আগে আমিও ট্রেভোনের ভাগ্য বরণ করতে পারতাম।
রাজনীতি বিশ্লেষকরা বলেন, ওই মন্তব্য করে অপ্রকাশ্যে ব্যাপক বেকায়দায় পড়েছিলেন ওবামা। তাই এবছর একেবারেই মুখ খোলেননি। কেবল বিক্ষোভকারীদের উদ্দেশে লুটপাট-ভাঙচুর না করে ‘আইন’র প্রতি শ্রদ্ধাশীল থাকার আহ্বান জানিয়েছেন।
বাংলাদেশ সময়: ০৭৩৬ ঘণ্টা, ডিসেম্বর ২৮, ২০১৪