এই প্রশান্তি নিয়ে অ্যাপার্টমেন্টে ঘুমের প্রস্তুতি ট্রেভিসানের। হঠাৎ আগুন, ভয়াবহ আগুন ট্রেভিসানদের ২৭ তলা ভবনে।
ট্রেভিসান দৌড়ে বের হতে যান অ্যাপার্টমেন্ট থেকে। দেখেন দরোজা পেরিয়ে সিঁড়ি বেয়ে ধোঁয়ার কুণ্ডুলি আসছে। আসছে আগুনের তীব্র উত্তাপও।
মনে হলো এখন বের হওয়া যাবে না। সিঁড়িতেই ধোঁয়ার কুণ্ডুলিতে শ্বাস বন্ধ হয়ে প্রাণ হারাতে হবে। আতঙ্ক নিয়েই অ্যাপার্টমেন্টে ঢুকে পড়লেন ট্রেভিসান। ছুটে এলেন জানালার দ্বারে। খানিকক্ষণ নিচের ফায়ার সার্ভিসের কর্মীদের দৃষ্টি আকর্ষণের চেষ্টা করেন। ওপাশ থেকে কোনো সাড়া পাওয়ার নজির দেখা যায় না।
আবার ভেতরে ছুটে আসেন। নিরাপদ স্থান খুঁজতে থাকেন। আগুনের লেলিহান শিখা ট্রেভিসানের জানালা ছুঁয়ে ফেলে। কান্না-আহাজারি বাড়তে বাড়তে পরিবেশ ভারী হয়ে উঠতে থাকে। কিন্তু ২০০ দমকলকর্মী অসংখ্য ফায়ার গাড়ি নিয়েও আগুনের লাগাম পাচ্ছিলেন না।
সিঁড়ি দিয়ে বেরোনোর অবস্থাও শেষ হয়ে যায়। চিৎকার করতে করতে গলা ধরে আসে ট্রেভিসানের। কাঁদতে কাঁদতে ঝাপসা হয়ে আসে চোখ। এই মহাবিপদে মনে পড়ে মায়ের মুখ, বাবার মুখ। মায়া-মমতা-স্নেহ-আদর।
‘হ্যালো মা! মা আমাদের ভবনে আগুন লেগে গেছে। মা আমি বোধ হয় মারা যাচ্ছি। ’ ‘কী সব কথা বলছিস,... কী হয়েছে মা আমার?’ ‘মা আগুন আমাদের অ্যাপার্টমেন্টেও ধরে গেছে। ... আমি চলে যাচ্ছি মা! এখানে তোমাদের অভাব ঘোচাতে পারলাম না, ও পাশ থেকে তোমাদের সঙ্গে থাকবো। ’কাঁদেন ট্রেভিসান, কাঁদেন মা, কাঁদেন বাবা। একটা সময় সংযোগ বিচ্ছিন্ন হয়ে যায়। আর ট্রেভিসানের মোবাইলে সংযোগ যায় না। দূরের দেশ ইতালিতে বসে চিৎকার করে কাঁদতে থাকেন মা-বাবা। তাদের সংসারের অভাব ঘোচাতে লন্ডনে পাড়ি দেওয়া মেয়েকে কেড়ে নিয়েছে গ্রিনফেল টাওয়ারের ভয়াবহ অগ্নিকাণ্ড।
ট্রেভিসানের স্বজনদের বরাত দিয়ে অগ্নিকাণ্ডে তার মর্মান্তিক মৃত্যুর এমন বর্ণনাই দিলেন আইনজীবী মারিয়া ক্রিস্টিয়ানা। মারিয়া বলছিলেন, মায়ের সঙ্গে কথা বলতে বলতে মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়েছেন ট্রেভিসান। এই অ্যাপার্টমেন্টে ট্রেভিসান তার বন্ধু মার্কো গোত্তার্দির সঙ্গে থাকতেন। অগ্নিকাণ্ডের পর থেকে গোত্তার্দিও নিখোঁজ রয়েছেন।
গত বুধবারের (১৪ জুন) ভয়াবহ এই অগ্নিকাণ্ডে এখন পর্যন্ত ৩০ জনের মৃত্যুর বিষয়ে নিশ্চিত হয়েছে লন্ডন পুলিশ। এছাড়া দগ্ধ বা ভবন থেকে ঝাঁপ দিয়ে আহত হয়েছে ৭০ জনের মতো।
আইনজীবী মারিয়া জানান, অর্থনৈতিকভাবে টালমাটাল ইতালিতে ট্রেভিসানের পরিবার অভাবে দিন কাটাচ্ছে। ২৬ বছর বয়সী ট্রেভিসান ছিলেন স্থপতি। মাত্র তিন মাস আগেই ভালো একটা চাকরির খোঁজে লন্ডনে পাড়ি জমান তিনি। সেখানে বন্ধু গোত্তার্দির সঙ্গে থাকছিলেন। এরমধ্যে মা ম্যানুয়েলা ও বাবা লরিসের সঙ্গে কথা হলে সংসারে স্বচ্ছলতা ফেরানোর কথা বলতেন ট্রেভিসান।
মারিয়া আরও জানান, মারা যাওয়ার আগে মা-বাবা দু’জনের সঙ্গেই কথা বলেছিলেন ট্রেভিসান। কেবল ভাই সেসময় বাড়িতে ছিলেন না বলে তার সঙ্গে কথা বলা হয়নি। তবু বোনের শেষ স্বরটুকু ভাইকে শোনাতে তার খানিকটা আলাপ রেকর্ড করে নেন বাবা।
সংবাদমাধ্যম জানাচ্ছে, এই অগ্নিকাণ্ডের তদন্ত ও রায় ঘোষণার আগ পর্যন্ত সেই রেকর্ড ছাড়া হবে না। তবে ট্রেভিসানের সেই অ্যাপার্টমেন্টে তারা তোলা একটি ছবি ইনস্টাগ্রাম অ্যাকাউন্ট থেকে শেয়ার হচ্ছে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমগুলোতে।
বাংলাদেশ সময়: ১৮০৭ ঘণ্টা, জুন ১৭, ২০১৭
এইচএ/