বুধবার (১৩ সেপ্টেম্বর) রাতে চীনসহ নিরাপত্তা পরিষদের সব সদস্যের সম্মতিক্রমে দেওয়া এক বিবৃতিতে এই উদ্বেগ-আহ্বান-সাধুবাদ জানানো হয়। এর আগে ৪ লাখ রোহিঙ্গাকে উদ্বাস্তু করা রাখাইন সঙ্কট নিয়ে রুদ্ধদ্বার বৈঠকে বসে নিরাপত্তা পরিষদ।
বৈঠক শেষে দেওয়া বিবৃতিতে জানানো হয়, নিরাপত্তা পরিষদ মিয়ানমারে সহিংসতার নিন্দা জানিয়েছে এবং সঙ্কটাপন্ন রাখাইন রাজ্যে ত্রাণের জন্য হাহাকার করা লোকদের কাছে সাহায্য পৌঁছে দিতে সংশ্লিষ্ট দাতা সংস্থাগুলোর কর্মীদের নিরাপদে প্রবেশ করতে দেওয়ার আহ্বান জানিয়েছে।
তবে, বিবৃতিতে ‘রোহিঙ্গা’ শব্দটি ব্যবহার না করে ‘বেসামরিক জনগণ’ ও ‘শরণার্থী’ শব্দ ব্যবহার করা হয়েছে।
নিরাপত্তা পরিষদের সভাপতি টিকিদা আলিমু বৈঠক শেষে সাংবাদিকদের বলেন, রাখাইন রাজ্যে নিরাপত্তা বাহিনীর অভিযানকালে অত্যধিক সহিংসতায় পরিষদের সদস্যরা গভীর উদ্বেগ প্রকাশ করেছে এবং এ সহিংসতা বন্ধে জরুরি পদক্ষেপ নেওয়ার আহ্বান জানিয়েছে।
নিরাপত্তা পরিষদের বৈঠকের আগে দেওয়া বিবৃতিতে জাতিসংঘের মহাসচিব অ্যান্তোনিও গুতেরেসও রোহিঙ্গাদের ওপর ‘অগ্রহণযোগ্য অন্যায়-অত্যাচার’ দ্রুতই বন্ধের তাগিদ দেন এবং আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়কে এ বিষয়ে যথাযথ সহযোগিতার আহ্বান জানান।
নিরাপত্তা পরিষদের বৈঠকে অংশ নেওয়া জাতিসংঘে নিযুক্ত ব্রিটিশ রাষ্ট্রদূত ম্যাথিউ রেক্রফ্ট বলেন, নয় বছরে এই প্রথম মিয়ানমারের বিষয়ে নিরাপত্তা পরিষদের সদস্যরা কোনো বিবৃতিতে মতৈক্য দেখালেন।
সুইডেনের রাষ্ট্রদূত কার্ল স্কু বলেন, মিয়ানমার বিষয়ে নিরাপত্তা পরিষদ এক সুরে কথা বলেছে। তারা গভীর উদ্বেগ জানানোর পাশাপাশি সহিংসতা বন্ধ, মানবিক সহায়তার সুযোগ নিশ্চিতকরণ এবং শরণার্থী সঙ্কট নিরসনের আহ্বান জানিয়েছে।
নিরাপত্তা পরিষদের সভাপতি টিকিদা আলিমু বলেন, গত ২৫ আগস্ট মিয়ানমারে সন্ত্রাসী হামলার প্রেক্ষিতে অন্তত তিন লাখ ৭০ হাজার লোকের বাস্তুচ্যুতির ঘটনার নিন্দা জানিয়েছে পরিষদ। পরিষদের সদস্যরা অনতিবিলম্বে সংঘাত-সহিংসতা বন্ধ, উত্তেজনা প্রশমন, আইন-শৃঙ্খলা পুনর্প্রতিষ্ঠা, বেসামরিক লোকজনের সুরক্ষা নিশ্চিত এবং আর্থ-সামাজিক উন্নয়ন ও শরণার্থী সমস্যা সমাধান করতে মিয়ানমারের প্রতি আহ্বান জানিয়েছে।
জাতিসংঘে বাংলাদেশের স্থায়ী মিশন জানায়, পরিষদের বৈঠকে শরণার্থী সঙ্কটকালে বাংলাদেশের ভূমিকার প্রশংসা করা হয়েছে। শরণার্থীদের সাহায্য করতে বাংলাদেশের অব্যাহত প্রচেষ্টাকে সাধুবাদ জানানোর পাশাপাশি এ সঙ্কটে ঢাকাকে জাতিসংঘসহ আন্তর্জাতিক সংস্থাগুলোর সহায়তারও প্রশংসা করা হয়।
মিয়ানমার ত্রাণকর্মীদের রাখাইনে ঢুকতে দেওয়ার অঙ্গীকার করেছে জানিয়ে নিরাপত্তা পরিষদের বিবৃতি বলা হয়েছে, মিয়ানমারকে সেই অঙ্গীকার রক্ষা ও ত্রাণকর্মীদের নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে হবে।
রাখাইন সঙ্কট সমাধানে জাতিসংঘ মহাসচিব অ্যান্তোনিও গুতেরেসের প্রচেষ্টাকে স্বাগত জানিয়ে পরিষদ এ সমস্যার স্থায়ী সমাধানে কফি আনান কমিশনের সুপারিশ বাস্তবায়নের গুরুত্বকে স্বীকার করেছে। একইসঙ্গে সুপারিশমালা বাস্তবায়নে মিয়ানমার সরকার বুধবার যে কমিটি গঠন করেছে তাকেও স্বাগত জানিয়েছে পরিষদ।
এর আগে, জাতিসংঘের নিরাপত্তা পরিষদের কাছে রাখাইনে মিয়ানমারের বাহিনীর সহিংস অভিযান বন্ধের জন্য আহ্বান জানায় ব্রিটেন ও সুইডেন। বিশ্ব মানবাধিকার সংস্থাগুলোও রোহিঙ্গাদের ওপর নির্যাতন বন্ধে মিয়ানমার কর্তৃপক্ষের ওপর চাপ প্রয়োগের জন্য নিরাপত্তা পরিষদকে ‘দৃশ্যমান’ প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ নেওয়ার আহ্বান জানায়। মানবাধিকার পর্যবেক্ষক সংস্থা এইচআরডব্লিউ’র এশিয়া ডিভিশনের ডেপুটি ডিরেক্টর ফিল রবার্টসন মিয়ানমারের সামরিক বাহিনীর ওপর ‘বৈশ্বিক অস্ত্র নিষেধাজ্ঞা’ পাস করার জন্য নিরাপত্তা পরিষদের প্রতি আহ্বান জানিয়ে বলেন, আমরা আশা করি, চীনও এ বিষয়ে প্রয়োজনীয় উদ্যোগ নেবে।
অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনালের নিউইয়র্কের ডিরেক্টর শেরাইন টেড্রস মিয়ানমারকে উদ্দেশ্য করে বলেন, আমরা সুস্পষ্ট করে বলতে চাই, এটা কোনো সভা নয় যে, শুরু হলো বা শেষ হলো। নিরাপত্তা পরিষদ এক হয়ে মিয়ানমার সরকারকে একেবারে সুস্পষ্ট বার্তা দিচ্ছে যে, চলমান সহিংসতা এখনই বন্ধ করতে হবে।
গত ২৫ আগস্ট রাখাইনে মিয়ানমারের সামরিক বাহিনীর অভিযান শুরুর পর থেকে এখন পর্যন্ত ৪ লাখের বেশি রোহিঙ্গা বাংলাদেশে পালিয়ে আশ্রয় নিয়েছে। সহিংস অভিযানে সেখানে প্রাণ গেছে ৩ হাজারেরও বেশি রোহিঙ্গার। ধর্ষিত হয়েছে শত শত নারী।
এই গণহত্যা বন্ধের আহ্বান জানিয়ে সম্প্রতি জাতিসংঘের পক্ষ থেকে দেওয়া বিবৃতিতে বলা হয়, রাখাইনে অভিযানের নামে জাতিগত নিধনযজ্ঞ চলছে। এবারের সহিসংতার আগে গত মার্চে মিয়ানমারে সংঘাত বাঁধলে তখন জাতিসংঘ বিবৃতি দিতে চেয়েও চীনের ভেটোর মুখে দিতে পারেনি। এবার সেই চীনসহ সবার সম্মতিক্রমেই বিবৃতি দিল নিরাপত্তা পরিষদ। যদিও আগের দিন দেওয়া বিবৃতিতে মিয়ানমারের পাশে থাকার ঘোষণা দেয় বেইজিং।
বাংলাদেশ সময়: ০৮১০ ঘণ্টা, সেপ্টেম্বর ১৪,২০১৭/আপডেট: ১১২৬ ঘণ্টা
জেডএস/এইচএ/