ঢাকা, রবিবার, ৯ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ২৪ নভেম্বর ২০২৪, ২২ জমাদিউল আউয়াল ১৪৪৬

আন্তর্জাতিক

বাস্তবায়নে তোড়জোড় মিয়ানমারে

যা আছে আনান কমিশনের সুপারিশে

আন্তর্জাতিক ডেস্ক | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ০৭৩৩ ঘণ্টা, সেপ্টেম্বর ১৪, ২০১৭
যা আছে আনান কমিশনের সুপারিশে অং সান সু চি’র হাতে সুপারিশমালা তুলে দিচ্ছেন কফি আনান

বিশ্ব সম্প্রদায়ের চাপের মুখে পড়ে খানিকটা দেরিতে হলেও টনক নড়েছে মিয়ানমার সরকারের। রাখাইন রাজ্যের রোহিঙ্গা সঙ্কট সমাধানে জাতিসংঘের সাবেক মহাসচিব কফি আনানের নেতৃত্বাধীন কমিশনের দেওয়া ৮৮ দফা সুপারিশমালা বাস্তবায়নের লক্ষ্যে একটি কমিটি গঠন করেছে তারা।

এই কমিটি গঠনের ব্যাপারে মিয়ানমারের প্রেসিডেন্টের দফতর থেকে বলা হয়েছে, রোহিঙ্গা অধ্যুষিত এলাকায় নিরাপত্তা, অর্থনৈতিক উন্নয়ন ও সামাজিক বিষয়াদির উন্নতি সাধনের লক্ষ্যে এই কমিটি গঠন করা হয়েছে। বুধবার (১৩ সেপ্টেম্বর) নিউইয়র্কে জাতিসংঘ নিরাপত্তা পষিদে রাখাইন নিয়ে জরুরি বৈঠকের আগে আকস্মিক এই কমিটি গঠনের কথা জানায় প্রেসিডেন্ট দফতর।

তার আগে জানানো হয়, দেশে শান্তি ও স্থিতিশীলতা ফেরানোর কাজে ব্যস্ত থাকা স্টেট কাউন্সেলর (কার্যত সরকারপ্রধান) অং সান সু চি এবারের জাতিসংঘ সাধারণ অধিবেশনে যোগ দিচ্ছেন না।

আনান কমিশন বাস্তবায়নে কমিটি গঠনের বিষয়ে মিয়ানমারের সংবাদমাধ্যমে বলা হয়েছে, ১৫ সদস্যের এ কমিটির নেতৃত্বে রয়েছেন সমাজকল্যাণ, ত্রাণ ও পুনর্বাসন মন্ত্রী উইন মিয়াত আয়, আর কো-চেয়ার হিসেবে থাকছেন রাখাইন রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রী নি পু। এই কমিটি আনান কমিশনের সুপারিশ বাস্তবায়নে কাজ করবে। পাশাপাশি তারা কাজ করবে রাখাইনে সহিংসতা ও হামলার অভিযোগ তদন্তে গঠিত দেশটির ভাইস প্রেসিডেন্ট ও বিতর্কিত জেনারেল মিন্ট সুয়ের নেতৃত্বে গঠিত কমিশনের সুপারিশগুলোও।

আনান কমিশনের সুপারিশমালা বাস্তবায়ন কমিটির কাজের বিষয়ে বলা হয়েছে, এটি রোহিঙ্গা অধ্যুষিত এলাকায় নিরাপত্তা, অর্থনৈতিক উন্নয়ন ও সামাজিক বিষয়াদির উন্নতি সাধনের লক্ষ্যে এবং জাতিগত গ্রামগুলোতে স্থিতিশীলতা ব্যবস্থাপনা ও উদ্বাস্তুদের জন্য শরণার্থী শিবির সরিয়ে ফেলতে কাজ করবে। রোহিঙ্গাদের নাগরিকত্ব নিশ্চিত করতে দেশের নাগরিকত্ব আইন অনুযায়ী যাচাই কার্যক্রমে গতি আনতেও কাজ করবে এ কমিটি।

অনিশ্চিত ভবিষ্যৎ নিয়ে শঙ্কায় এক রোহিঙ্গা শিশু।  ছবি: দীপু মালাকার
বাংলাদেশের সীমান্তবর্তী রাখাইনে বসবাসরত ১০ লাখ রোহিঙ্গাকে ‘বাঙালি’ আখ্যা দিয়ে তাদের নাগরিকত্ব অস্বীকার করে মিয়ানমার। এজন্য তাদের নাগরিক অধিকার-বঞ্চিত করা হচ্ছে বছরের পর বছর ধরে। এ নিয়ে বারবার সহিংসতা ছড়ালেও বিষয়টির কোনো সুরাহা হয়নি। এ নিয়ে সমালোচনার প্রেক্ষিতে গত বছরের সেপ্টেম্বরে কফি আনানের নেতৃত্বে মিয়ানমারের ৬ জন এবং লেবানন ও নেদারল্যান্ডের ২ নাগরিককে নিয়ে ৯ সদস্যের ওই কমিশন গঠিত হয়।  

‘অ্যাডভাইজরি কমিশন অন রাখাইন স্টেট’ শীর্ষক ওই কমিশন মিয়ানমার ও বাংলাদেশের বিভিন্ন স্থানে কমপক্ষে ১৫৫টি বৈঠক করে ১১০০ ব্যক্তির সঙ্গে আলোচনা করে গত ২৪ আগস্ট অং সান সু চি’র হাতে ৮৮ সুপারিশ সম্বলিত প্রতিবেদন তুলে দেয়। একই দিন তা প্রকাশ হয় কমিশনের ওয়েবসাইটেও। এতে মোটাদাগে রাখাইনদের অর্থনৈতিক উন্নয়ন, মানবিক সহায়তা, লোকজনের অবাধ চলাচল ও নাগরিকত্ব আইন অনুযায়ী রাখাইনের বাসিন্দাদের অধিকারের বিষয়টি সুরাহা করার বিষয়ে সুপারিশ করা হয়।

প্রতিবেদনে রাখাইনের জনগণকে ‘রোহিঙ্গা’ও বলা হয়নি, মিয়ানমার সরকারের ভাষ্য অনুযায়ী, ‘বাঙালি’ও বলা হয়নি। বলা হয়েছে ‘রাখাইনের মুসলমান সম্প্রদায়’ হিসেবে।

আনান কমিশনের ওই সুপারিশমালা বাস্তবায়নের জন্য বাংলাদেশসহ আন্তর্জাতিক সম্প্রদায় সেসময় থেকেই আহ্বান জানিয়ে আসছে। এখন হাজারো রোহিঙ্গাকে হত্যা এবং লাখো রোহিঙ্গাকে বিতাড়নের পর মিয়ানমারের এই সুপারিশমালা বাস্তবায়নের বিষয়ে পর্যবেক্ষকরা বলছেন, চাপে পড়েই মিয়ানমার এ ঘোষণা দিয়েছে বলে স্পষ্ট। তারপরও আনান কমিশনের সুপারিশগুলো দ্রুত ও পুরোপুরি বাস্তবায়ন হলে বাংলাদেশ থেকে রোহিঙ্গাদের মিয়ানমারে প্রত্যাবাসন এবং এ সমস্যার স্থায়ী সমাধান নিশ্চিত হতে পারে।

যদিও বিতর্কিত জেনারেল সুয়ের নেতৃত্বাধীন কমিশনের সুপারিশগুলোর বেশিরভাগই রোহিঙ্গাদের ওপর বৈষম্যমূলক বলে সেগুলোর সঙ্গে মিলিয়ে বাস্তবায়ন করতে গেলে পরিস্থিতি ঘোলাটে হতে পারে বলে আশঙ্কা করছেন কেউ কেউ।

যা আছে আনান কমিশনের সুপারিশমালায়
‘রাখাইনের জনগণের শান্তিপূর্ণ, সুষ্ঠু ও সমৃদ্ধ ভবিষ্যতের জন্য চূড়ান্ত প্রতিবেদনে’ রাখাইনের অর্থনৈতিক ও সামাজিক উন্নয়ন, নাগরিকত্ব, চলাফেরার স্বাধীনতা, অভ্যন্তরীণ বাস্তুচ্যুতি, মানবিক সহায়তায় প্রবেশাধিকার, গণমাধ্যমের প্রবেশাধিকার, শিক্ষা, স্বাস্থ্য, মাদক, সাম্প্রদায়িক অংশগ্রহণ ও প্রতিনিধিত্ব, আন্তঃসাম্প্রদায়িক পছন্দের অধিকার, আন্তঃ সাম্প্রদায়িক সংহতি, নিরাপত্তা খাত, ন্যায়বিচার, সাংস্কৃতিক উন্নয়ন, বাংলাদেশের সঙ্গে সীমান্ত ইস্যু এবং দ্বিপাক্ষিক সম্পর্ক, আঞ্চলিক সম্পর্ক পয়েন্টে সুপারিশ করা হয়েছে।
সুপারিশমালায় বলা হয়েছে—
** রোহিঙ্গাদের নাগরিকত্ব প্রদান এবং মিয়ানমার ও বাংলাদেশ মিলে যৌথ যাচাইপ্রক্রিয়ার মাধ্যমে তাদের নিরাপদে (বাংলাদেশ থেকে) প্রত্যাবাসন করতে হবে।
** ১৯৮২ সালের নাগরিকত্ব আইন অনুযায়ী নাগরিকত্ব যাচাইপ্রক্রিয়া ত্বরান্বিত করতে। এরই মধ্যে নাগরিক হিসেবে যাচাই হওয়া ব্যক্তিদের সব ধরনের অধিকার ও স্বাধীনতা দিতে হবে।
** মিয়ানমারের নাগরিকত্ব আইনটি আন্তর্জাতিক রীতিনীতি, নাগরিকত্ব ও জাতিগোষ্ঠীর সঙ্গে সম্পৃক্ত করতে হবে।
** যারা মিয়ানমারের নাগরিক হিসেবে স্বীকৃতি পায়নি তাদের ওই দেশটিতে অবস্থানের বিষয়টি হালনাগাদ করে ওই সমাজের অংশ করে নিতে হবে।
** জাতি-ধর্ম-বর্ণ-নির্বিশেষে সবার অবাধ চলাচলের সুযোগ দিতে হবে।  
** রাখাইনে উন্নয়ন ও বিনিয়োগের পদক্ষেপ নিতে হবে, যাতে স্থানীয় জনগোষ্ঠীগুলোও উপকৃত হতে পারে।
** মিয়ানমারের রাজনৈতিক প্রক্রিয়ায় সব গোষ্ঠী ও সম্প্রদায়ের সদস্যদের সম্পৃক্ত করতে হবে।
** অভ্যন্তরীণভাবে বাস্তুহারাদের শিবিরগুলো বন্ধ করে সমাজেই তাদের সম্পৃক্ত করার নীতি নিতে হবে।
** সম্প্রদায়ে সম্প্রদায়ে সুসম্পর্ক সৃষ্টি এবং সমাজের সব সম্প্রদায়ের নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে হবে।
** সীমান্ত ইস্যুসহ অভিন্ন চ্যালেঞ্জ মোকাবেলায় বাংলাদেশ-মিয়ানমার সুসম্পর্ক জোরদার করতে হবে
** সুপারিশ বাস্তবায়নে মিয়ানমারে কাঠামো সৃষ্টি এবং মন্ত্রী পর্যায়ের কাউকে দায়িত্ব দিতে হবে।

মিয়ানমারের সংবাদমাধ্যম জানিয়েছে, সুপারিশ বাস্তবায়নে গঠিত কমিটি বৃহস্পতিবার (১৪ সেপ্টেম্বর) বৈঠকে বসে দু’টি কমিশনের সুপারিশ পরীক্ষা-নিরীক্ষা করবে এবং যত দ্রুত সম্ভব সুপারিশগুলো বাস্তবায়নের কাজ শুরু করবে। ৪ মাস পর পর কমিটি এ সংক্রান্ত অগ্রগতি জনগণের সামনে তুলে ধরবে।

বাংলাদেশ সময়: ১৩২৮ ঘণ্টা, সেপ্টেম্বর ১৪, ২০১৭
এইচএ/

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।