বিশ্ব ইজতেমা ময়দান থেকে: বিশ্ব ইজতেমায় আখেরি মোনাজাত চলাকালে পরিবেশ ছিল একেবারে শান্ত। গুরুগম্ভীর পরিবেশে দুই হাত তুলে আল্লাহর দরবারে মুসল্লিদের ফরিয়াদ।
তাদের অনেকেই কেঁদেছেন, কেউ কেউ ‘আল্লাহ, আল্লাহ’ ধ্বনিও উচ্চারণ করেছেন। সবাই নিজেদের সব গুনাহ'র জন্য সৃষ্টিকর্তার কাছে ক্ষমা চেয়েছেন।
রোববার (২২ জানুয়ারি) দুপুর ১২টা ১৬ মিনিটে শুরু হয় তাবলিগ জামাতের আন্তর্জাতিক সম্মেলন বিশ্ব ইজতেমার দ্বিতীয় ও শেষ পর্বের আখেরি মোনাজাত। এই মোনাজাত চলে টানা ২৯ মিনিট। আখেরি মোনাজাত পরিচালা করেন ভারতের মাওলানা মোহাম্মদ সাদ কান্ধলভীর বড় ছেলে মাওলানা ইউসুফ বিন সাদ কান্ধলভী।
আখেরি মোনাজাতের ২৯ মিনিট সড়কে ছিল না কোনো চলাফেরা। সড়কে মুসল্লিদের ভিড়। পাশে আশরাফ সেতু শপিংমলেও ছিল মুসল্লিদের ভিড়। সর্বোপরি আখেরি মোনাজাতে অংশ নিতে আগতরা সবাই যে, যার অবস্থানে থেকে আল্লাহর দরবারে ফরিয়াদে মশগুল ছিলেন। ময়দানের মাইকে তখন মাওলানা ইউসুফ বিন সাদ কান্ধলভীর ধ্বনি ভেসে আসছিল, আশপাশে আর কোনো শব্দ ছিল না। মুসুল্লিদের যারা বসে ছিলেন তারা ফরিয়াদে মশগুল, আর মোনাজাতের আগে যারা হাঁটাচলা করছিলেন তারাও দাঁড়িয়ে থেকেই দুই হাত তুলে ফরিয়াদে ব্যস্ত হয়ে পড়েন। সব মিলিয়ে বিশ্ব ইজতেমার ময়দান ও আশপাশের সড়ক একেবারেই নীরব ও শান্তিময় ছিল আখেরি মোনাজাতের এই ২৯ মিনিট।
এরপর দুপুর ১২ টা ৪৫ মিনিটে আমিন আমিন ধ্বনিতে শেষ হয় আখেরি মোনাজাত। আর এই আখেরি মোনাজাতের মধ্য দিয়ে শেষ হলো তাবলিগ জামাতের আন্তর্জাতিক সম্মেলন বিশ্ব ইজতেমার এবারের দ্বিতীয় ও শেষ পর্ব।
ধর্মের টানে, মহান আল্লাহর সন্তুষ্ট লাভের আশায়, আল্লাহর ইবাদত বন্দেগি ও আমলের টানে বিশ্ব ইজতেমায় দেশ-বিদেশ থেকে মুসল্লিদের আগমন ঘটে। আখেরি মোনাজাতের মাধ্যমে আল্লাহর দরবারে গোটা দুনিয়ায় পথভ্রষ্ট মুসলমানদের সঠিক পথে চলা এবং মহান আল্লাহর রহমত, মাগফিরাত, নাজাত এবং ইহলৌকিক ও পারলৌকিক কল্যাণ কামনা করেন দেশ-বিদেশ থেকে আগত লাখ লাখ মুসল্লি।
সরেজমিনে দেখা যায়, আখেরি মোনাজাত চলাকালে আমিন আমিন ধ্বনিতে কম্পিত হয় পুরো ইজতেমার ময়দান ও আশপাশ। এরপর ২৯ মিনিটের এই শান্তি পরিবেশ গমগম করে ওঠে, শুরু হয় মুসল্লিদের চলাচল। ময়দানের ভেতর থেকে মুসল্লিরা বের হতে শুরু করেন। কেউ কেউ নিজেদের ব্যাগ ও সামান পিঠে, হাতে, ঘাড়ে ও মাথায় নিয়ে বের হতে থাকেন। সড়ক নিমিষেই পূর্ণ হয়ে যায় মুসল্লিদের ভিড়ে। হেঁটেই পথ চলছেন মুসল্লিরা। ময়দানের ভেতর থেকে জিকির করতে করতেও হাঁটছিলেন অনেকে।
এদিকে ইজতেমা মায়দানের পাহারা জামাতের সাথীরা মুসল্লিদের উদ্দেশ্যে বলছিলেন, ‘জিকিরের সহিত চলুন, সবাই সবার ডান দিকে চলুন। নিজে চলুন, অন্য ভাইকে চলতে সুযোগ দিন। ’
ঢাকা ও এর আশপাশের এলাকা থেকে যারা আখেরি মোনাজাতে অংশ নিতে এসেছিলেন তারা হেঁটেই রওয়ান হন নিজেদের গন্তব্যের দিকে। ময়দান থেকে টঙ্গী সড়কের আব্দুল্লাহপুর, স্টেশন রোড, আব্দুল্লাহপুর স্লুইচগেট ও কামারপাড়াসহ ময়দানের চারপাশে সড়কে মুসল্লিদের ঢল নামে।
মিরপুর থেকে আসা মুসল্লি মুমিনুল বাংলানিউজকে বলেন, মিরপুরের পল্লবী থেকে মেট্রোরেলে করে দিয়াবাড়ি এসেছি। সেখান থেকে রিকশায় উত্তরা ৯ নম্বর সেক্টের নেমে বেড়বাঁধ পার হয়ে ময়দানে আখেরি মোনাজাতে অংশ নিতে এসেছিলাম। ময়দানের ভেতরে থেকেই মোনাজাত ধরেছি। তারপর ধীরে ধীরে হেঁটে হেঁটে ময়দানের বাইরে রেব হয়েছি। এখন দুপুর গড়িয়ে বিকেল তাই আবার দিয়াবাড়ির দিকে যাচ্ছি। যদি মেট্রোরেল পাই তবে ভালো, না হয় সেখান থেকে সিএনজি অটোরিকশা বা অন্য কোনো বাহনে বাড়ি যেতে হবে।
বাড়ি ফেরার পালা: বিশ্ব ইজতেমা শেষ করে মুসল্লিরা মোনাজাতের পরপরই বাড়ির উদ্দেশ্যে রওয়ানা করছেন। তবে ময়দানের ভেতরে থাকা মুসল্লিরা তখন ব্যস্ত হয়ে পড়েন ওজু করায়, যোহরের নামাজ/সালাত আদায়ের জন্য। কারণ, ততক্ষণে যোহরের ওয়াক্ত শুরু হয়ে গেছে।
ময়দানে আসা মুসল্লিদের অনেকে জামাতের সঙ্গে জোহরের নামাজ আদায় করেন। এরপর কেউ কেউ দুপুরের আহারে ব্যস্ত, কেউ কেউ নিজেদের কাফেলার সামান গোছানোতে ব্যস্ত হয়ে পড়েন। কেউ কেউ বাড়ির উদ্দেশ্যে ময়দান ছাড়ছেন।
মুসল্লিদের যারা ঢাকার বাইরে থেকে এসেছেন তাদের অনেকেই বাস বা পিকআপ রিজার্ভ করে নিয়ে এসেছেন। ময়দানের আশপাশের তাদের কাফেলার বাহন পার্কিংয়ে রাখা আছে। ওই বাহনে করে তারা ফিরবেন। অনেকেই ট্রেনে চেপে বিশ্ব ইজতেমায় অংশ নিতে এসেছিলেন। তাদের অনেকেই টঙ্গী রেলওয়ে স্টেশনের দিকে যাচ্ছেন। কেউ আবার ছুটেছেন বিমানবন্দর রেলওয়ে স্টেশনে। এরজন্য টঙ্গী থেকে বিমানবন্দর পর্যন্তও অনেকে হেঁটে রওয়ানা হন। অনেকেই আবার উত্তরা সেক্টরের ভেরত দিয়ে রিকশা ও অটোরিকশা যোগেও যাচ্ছেন।
বিশ্ব ইজতেমার ময়দানে আগত মুসল্লিরা এখন ব্যস্ত সময় পার করছেন নিজেদের বাড়ি ফেরার তাগিদে।
বিশ্ব ইজতেমা ও আখেরি মোনাজাত ঘিরে ছিল আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর পর্যাপ্ত নিরাপত্তা ব্যবস্থা। র্যাব, পুলিশ, আনসার ব্যাটালিয়ন, গোয়েন্দা পুলিশসহ (ডিবি) বিভিন্ন গোয়েন্দা সংস্থার সদস্যরা নিয়োজিত ছিল ইজতেমা মাঠ ও আশপাশে। নিরাপত্তার স্বার্থে ময়দান ও আশপাশেরেএলাকায় নজরদারি রাখতে মোড়ে মোড়ে সিসিটিভি ক্যামেরা বসানো হয়। এছাড়াও র্যাবের হেলিকপ্টার দিয়ে টহল দেওয়া হয় ইজতেমার ময়দানসহ আশপাশের এলাকায়।
উল্লেখ্য, গত ৫৬ বছর ধরে টঙ্গীর তুরাগ পাড়ে অনুষ্ঠিত হচ্ছে তাবলিগ জামাতের বার্ষক জমায়েত বিশ্ব ইজতেমা। ২০১১ সাল পর্যন্ত সেখানে এক পর্বে তিন দিনব্যাপী বিশ্ব ইজতেমা অনুষ্ঠিত হতো। তবে মুসল্লিদের ব্যাপক উপস্থিতি ও ফেরার সময় জনদুর্ভোগসহ নিরাপত্তার বিষয়টি বিবেচনা করে তাবলিগ জামাতের শুরা সদস্যদের পরামর্শের ভিত্তিতে তিন দিন করে দুই ধাপে ইজতেমা আয়োজনের সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়। এদিকে করোনা মহামারির কারণে স্বাস্থ্যবিধি বিবেচনায় গত দুই বছর বিশ্ব ইজতেমা অনুষ্ঠিত হয়নি। এ বছর (২০২৩ সাল) ১৩-১৫ জানুয়ারি পর্যন্ত বিশ্ব ইজতেমার প্রথম পর্ব অনুষ্ঠিত হয়। চারদিন বিরতি দিয়ে ২০-২২ জানুয়ারি পর্যন্ত দ্বিতীয় ও শেষ পর্ব অনুষ্ঠিত হয়। আজ বোরবার (২২ জানুয়ারি) দুপুর ১২ টা ৪৫ মিনিটে আখেরি মোনাজাতের মধ্য দিয়ে শেষ হলো এবারের বিশ্ব ইজতেমা।
বাংলাদেশ সময়:১৭০৬ ঘণ্টা, জানুয়ারি ২২, ২০২৩
এসজেএ/এমএমজেড