ঢাকা, মঙ্গলবার, ৯ পৌষ ১৪৩১, ২৪ ডিসেম্বর ২০২৪, ২১ জমাদিউস সানি ১৪৪৬

ইসলাম

ইসলামের দাওয়াত দিতে বাগদাদ থেকে রাজশাহীতে আসেন শাহ মখদুম (রহঃ)

শরীফ সুমন, সিনিয়র করেসপন্ডেন্ট  | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ২১১০ ঘণ্টা, মার্চ ৩০, ২০২৩
ইসলামের দাওয়াত দিতে বাগদাদ থেকে রাজশাহীতে আসেন শাহ মখদুম (রহঃ) হযরত শাহ মখদুম রূপোশ (রহঃ) - এর মাজার

রাজশাহী: বহু পীর সাধকের পূণ্য ভূমি প্রাচীন শহর রাজশাহী। এক সময় উত্তরের এই জনপদের মানুষ কুসংস্কার আর অপসংস্কৃতি ও কুপ্রথার নিবিড় অন্ধকারের অতলে নিমজ্জ্বিত ছিল।

 

সে সময় এই নগরে দেব-দেবীর নামে দেওয়া হতো নরবলি। মানুষে-মানুষে ছিল ভেদাভেদ, জাতি বিদ্বেষ। তখন থেকে পীর সাধকের আগমন ঘটতে থাকে রাজশাহীতে। সুদূর মধ্য প্রাচ্যসহ বিভিন্ন দেশ থেকে এসব আধ্যাতিক মানুষের আগমন ঘটে। তারা অবোধ মানুষের মাঝে জ্ঞানের দ্বীপ্ত শিখা জ্বালানোর উদ্দেশে জীবনের সব সময়টুকু সময় ক্ষয় করে দেন। নানা প্রতিকূলতার দেয়াল ভেঙে রাজশাহীতে তারা ছড়িয়েছিলেন ইসলামের আলো। এজন যুদ্ধও করতে হয়েছে অনেককে। এমনকি প্রাণ বিসর্জনও দিয়েছেন কেউ কেউ।  

এদেরই একজন জ্ঞান তাপোশ হযরত শাহ মখদুম রূপোশ (রহঃ)।

ইসলাম ধর্মের দাওয়াত নিয়ে সুদূর বাগদাদ থেকে এসেছিলেন তিনি। সেই সুফী সাধকের নামে এখনও পরিচিত হয় বিভাগীয় এই রাজশাহী শহর।  

রাজশাহী নগরের পদ্মার তীর ঘেঁষে তার মাজার। তার মাজারকে ঘিরে ওই এলাকার নামই এখন দরগাপাড়া।  

দরগা মসজিদে প্রতিদিন ওয়াক্তিয়া নামাজে সহস্রাধিক লোকের সমাগম ঘটে। সপ্তাহের প্রতি বৃহস্পতিবার এখানে ওরশসহ নানা ইসলামি আচার-অনুষ্ঠান আয়োজিত হয়। এদিন দরগায় তিল ধারণের ঠাঁই থাকে না। আর পবিত্র রমজান মাস এলে যেন রোজাদারদের হাট বসে সেখানে।

আর পুরোনো বিশ্বাসের জায়গা থেকে বিভিন্ন মনোবাসনা পূরণ বা শাহ মখদুম রূপোশ (রহঃ) এর মাধ্যমে আল্লাহর কাছে অপার সন্তুষ্টি লাভের আশায় এখানে এসে ধর্মপ্রাণ নর-নারীরা নফল নামাজ আদায়সহ নানা ইবাদত বন্দিগী করে থাকেন।  

অনেকে আবার মাজার জিয়ারত করেই চলে যান। এছাড়া হিন্দু পরিবারের অনেক নারীদেরও প্রতি বৃহস্পতিবার মাজারে গিয়ে নিজ নিজ আস্থার জায়গা থেকে শিরনি বিতরণ করেন।      

বাংলাদেশের প্রত্নতাত্ত্বিক নির্দশন হিসেবে হযরত শাহ মখদুম (রহঃ) - এর মাজার নির্মাণের সময়কাল নিয়ে ঐতিহাসিকদের মধ্যে মতভেদ রয়েছে।  

শ্যামপুর শিলালিপি ও একটি ফারসি শিলালিপির বরাত দিয়ে অনেকেই বলে থাকেন, সম্রাট শাহজাহানের রাজত্বকালে এটি নির্মিত। পরে আলী কুলী বেগ মাজারের আমূল সংষ্কার করে বর্তমান গম্বুজটি নির্মাণ করেন।

যতদূর জানা যায়, জনৈক মুসলিম সওদাগর নদী পথে বিপদগ্রস্ত হয়ে হযরত শাহ মখদুম (রহঃ) কে স্মরণ করেন। তিনি সেই বিপদ থেকে মুক্ত হয়ে এই মসজিদ নির্মাণ করেন। এর দৈর্ঘ ৪০ ফুট, প্রস্থ ১৬ ফুট। ভেতরের পরিসরের দৈর্ঘ্য ৩৪ ফুট সাড়ে পাঁচ ইঞ্চি, প্রস্থ ১০ ফুট ১০ ইঞ্চি। তিনটি মেহরাবের মধ্যে মাঝেরটি অপেক্ষাকৃত বড়।  

উত্তর-দক্ষিণ দেয়ালে দুইটি করে চারটি তাক ও একটি করে দুইটি জানালা রয়েছে। পূর্ব দেয়ালে সমপরিমাপের তিনটি প্রবেশ পথ রয়েছে। এর কপাটগুলো পরবর্তীকালে নির্মাণ করা হয়। বিংশ শতাব্দীর গোঁড়ার দিকে পরপর দুইটি বারান্দা ও মিনার নির্মাণ করা হয় এখানে।  

বিভিন্ন গ্রন্থে জানা যায় হযরত শাহ মখদুম (রহঃ) ছিলেন, বড় পীর আবদুল কাদের জ্বিলানী (রহ:) এর পৌত্র এবং আজাল্লাহ শাহ’র দ্বিতীয় পুত্র। হযরত শাহ মখদুমের প্রকৃত নাম ছিল আব্দুল কুদ্দুছ জালালুদ্দীন। তিনি ৬১৫ হিজরী ২ রজব বাগদাদে জন্মগ্রহণ করেন।  

হযরত শাহ মখদুম রূপশ (রহঃ) চৌদ্দ শতকের একজন মুসলিম দরবেশ, যিনি বরেন্দ্র অঞ্চলে ইসলাম প্রচার করেছিলেন। ৬৮৫ হিজরিতে (১২৮৬ খ্রিস্টাব্দে) তিনি তাঁর বড় ভাই সৈয়দ আহমদ ওরফে মীরন শাহকে নিয়ে বাগদাদ হতে এখানে আসেন। রূপোশ তার উপাধি। আর শব্দটি ফারসি। ‘মখদুম’ অর্থ ধর্মীয় নেতা। আর রূপোশ অর্থ মুখ আবরণকারী।

প্রচলিত তথ্যানুসারে অনুসারে, চিশতিয়া তরিকার একটি উপদলের দরবেশদের মতো তিনি তার মুখমণ্ডল একটুকরা কাপড় দিয়ে ঢেকে রাখতেন এবং এজন্য তাকে রূপোশ বলা হতো। ৬৮৭ হিজরিতে (১২৮৮ খ্রিস্টাব্দে) শাহ মখদুম রূপশ বাঘা হতে রামপুর বোয়ালিয়ায় চলে আসেন। তিনি ওই এলাকার অত্যাচারী তান্ত্রিক রাজাকে পরাজিত ও হত্যা করে জনগণকে অত্যাচার হতে রক্ষা করেন।  

প্রতি বছর ১০ মহররম হযরত শাহ মখদুমের দরগায় ওরশ অনুষ্ঠিত হয়। ওই দিন তাজিয়া বের করা হয় এবং লাঠি খেলা ও নকল তলোয়ার দিয়ে যুদ্ধের মহড়া হয়। রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের একটি হলের নাম এ দরবেশের নামে রাখা হয়েছে। এছাড়া তার নামেই রয়েছে রাজশাহীর ‘হযরত শাহ মখদুম বিমান বন্দর’ ও ‘শাহ মখদুম থানা’।

তার রূপোশ উপাধি থেকে এই কথা বোঝা যায় যে, সাধারণ মানব বৈশিষ্ট ছাড়াও তার মধ্যে অসাধারণ ক্ষমতা লুকায়িত ছিল। আর হযরত শাহ মখদুম রূপোশ (রহঃ) এর রাজশাহী আগমনের অন্তরালে পাওয়া বিস্তৃত ইতিহাস থেকে জানা যায়, ১২৫৯ খ্রিস্টাব্দে মোঘল বীর হালাকু খান বাগদাদ আক্রোমণ করলে বড় পীর আবদুল কাদের জ্বিলানী (রহ:) এর বংশধররা বাগদাদ থেকে কাবুল, কান্দাহার, পারস্য ও পাক ভারতের বিভিন্ন স্থানে আশ্রয় গ্রহণ করেন। হযরত শাহ মখদুম রূপোশ (রহঃ) এর পিতা আজাল্লা শাহসহ দিল্লিতে আশ্রয় গ্রহণ করেন।  

উন্নত চরিত্র ও গুণাবলীর প্রতি মুগ্ধ হয়ে দিল্লির সম্রাট ফিরোজ শাহতার কাছে বায়েত হন। পিতার সহচার্যে তিন ছেলে সৈয়দ মুনির উদ্দীন আহমেদ (রহঃ), হযরত শাহ মখদুম রূপোশ (রহঃ) ও সৈয়দ আহমদ তম্বরী (রহঃ) আধ্যাত্মিক সাধনায় সমৃদ্ধ লাভ করেন।  
হালাকু খানের মৃত্যুর পর শাহ আজাল্লা বাগদাদে ফিরে যান। তার ছেলেরা ইসলামের বাণী প্রচারের মাধ্যমে মানুষকে হেদায়েতের উদ্দেশ্যে অনুচরবর্গসহ বাংলায় আগমন করেন।  

তখন রাজশাহী নগরের নাম ছিল মহাকাল গড়। এখানে নরবলি দেওয়া হতো। তার স্মৃতি এখনও হজরত শাহ মখদুম রূপোশ (রহঃ) দরগা শরীফে রক্ষিত আছে। মহাকাল গড়ে সেময় বহু রকমের দেব দেবতার প্রতিমূর্তি ও মঠ-মন্দিরে পূর্ণ ছিল।  

হযরত শাহ মখদুম (রহঃ) রূপোশের সমাধি সৌধের প্রবেশ দ্বারে উপরিভাগে জনৈক আলীকুলী বেগ কর্তৃক রচিত ১০/৩৬ ইঞ্চি চার লাইন বিশিষ্ট একটি ফারসি ভাষায় লিখিত শিলা লিপি আছে।  

এই লিপিতে শাহ দরবেশের মাজারের ওপর গম্বুজ নির্মাণের কথা উল্লেখ আছে। (১০৪৫ হিজরী বা ১৬৩৫ খ্রি:) শিলা লিপির সারমর্ম অনুযায়ী আলীকুলী বেগ দ্বাদশ মতাবলম্বী গোঁড়া শিয়া মুসলমান এবং পারস্যের শাহ আব্বাসের একজন ভক্ত ছিলেন।  

তিনি এ দেশের নবাগত হিসেবে স্থায়ী মুসলমানদের সহানুভূতি লাভের আশায় হজরত শাহ মখদুম (রহঃ) এর সমাধি নির্মাণ করে ছিলেন। আলীকুলী বেগ হযত শাহ মখদুম (রহ:) এর সঠিক পরিচয় জানতেন না। তাই তিনি লিপিতে শাহ দরবেশ’ হিসেবে হযরত শাহ মখদুম (রহঃ) সম্বোধন করেছেন।  

অথচ ফারসি তায়েদাদে হযরত শাহ মখদুম রূপোশ নামের কথা উল্লেখ আছে। তাই আজও তিনি শাহ মখদুম ও তার মাজার শরীফ মখদুমের দরগা এবং হিন্দুদের কাছে মখদুম বাবা নামে পরিচিত।

রাজশাহীর কেন্দ্রীয় জামেয়া ইসলামিয়া শাহ্ মখদুম মাদরাসা অধ্যক্ষ মুফতি মাওলানা শাহাদত আলী জানান, ধর্মীয় কুসংস্কারের জায়গা থেকে এখনও মাজারকে ঘিরে নানা কাজকর্ম হয়ে থাকে যা শরিয়ত সম্মত নয় এবং শিরিকের মধ্যে পড়ে। এরপরও শিরক থেকে দূরে থাকার জন্য বিভিন্ন সময় মানুষকে সচেতন করা হয়। সেখানে থাকা মসজিদে জুমার বিশাল জামায়াতেও মসজিদের ইমাম তার বয়ানে মানুষকে সচেতন করছেন। এর পরও এক শ্রেণির মানুষ জায়েজ নয় এমন কাজ করে থাকেন। দরগা স্টেট সেখানে থাকা মসজিদ ও মাজার পরিচালনা করেন। মসজিদে পাঁচ হাজার মুসল্লির ধারণ ক্ষমতা রয়েছে। তবে বর্তমানে এর সংস্কার কাজ চলছে। কাজটি শেষ হলে পরিধি আরও বাড়বে।

বাংলাদেশ সময়: ২০৫৫ ঘণ্টা, মার্চ ৩০, ২০২৩
এসএস/এসএএইচ

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।