প্রবীণদের প্রতি সম্মান দেখানো সব সমাজেরই রীতি। প্রবীণদের প্রতি শ্রদ্ধাবোধ, দায়দায়িত্ব এবং তাদের অধিকার আদায়ে সচেষ্ট থাকতে ইসলাম সবসময় গুরুত্ব দিয়েছে।
প্রবীণদের প্রতি যথাযথ শ্রদ্ধা ও সম্মান প্রদর্শন করা মুসলমানদের রীতি-ঐতিহ্য। প্রবীণদের প্রতি সম্মানসূচক ব্যবহার সমাজে শৃঙ্খলা ও আদর, মায়া-শান্তির পরিবেশ বজিয়ে রাখে।
প্রবীণদের শ্রদ্ধা এবং নবীনদের স্নেহ করা রাসুল (সা.)-এর সুন্নত। হাদিসে রাসুল (সা.) এ সম্পর্কে বলেন, ‘যারা ছোটদের স্নেহ করে না এবং বড়দের সম্মান করে না তারা আমার দলের অন্তর্ভুক্ত নয়। ’ (আবু দাউদ, হাদিস: ৪৮৪২)
মর্যাদাবান ব্যক্তিকে তার প্রাপ্য মর্যাদা দেওয়া উচিত। এটা মহানবীর শিক্ষা। এক হাদিসে রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেন, ‘মানুষের সঙ্গে তাদের পদমর্যাদা অনুযায়ী আচরণ করো। ’ (আবু দাউদ, হাদিস: ৪৮৪২)
প্রবীণদের কল্যাণ-সুরক্ষা নিশ্চিত করা আবশ্যক
বাস্তবিকভাবে পারিবারিক, সামাজিক ও জাতীয় জীবনের প্রতিটি ক্ষেত্রে প্রবীণদের অবদান অনস্বীকার্য। পরিবারের গঠন, উন্নয়ন ও সমাজের কল্যাণে কর্মময় জীবন ব্যয় করে—একসময়ে তারা বার্ধক্যে উপনীত হন। তখন প্রবীণদের সার্বিক কল্যাণ ও সুরক্ষা করা সমাজের আবশ্যিক কর্তব্য। কিন্তু বাস্তবে তাদের প্রতি সেবাযত্ন ও সুযোগ-সুবিধার গুরুত্ব নেহাত কম।
বাংলাদেশ ইনস্টিটিউট অব ডেভেলপমেন্ট স্টাডিজের এক তথ্য মতে, বাংলাদেশে প্রায় ১ কোটি ৩০ লাখের মতো প্রবীণ রয়েছেন। তাদের মধ্যে শতকরা ৮৮ ভাগ প্রবীণের কোনো না কোনো সন্তান পরিবারের বাইরে থাকেন। শতকরা ২০ জন হয় একাকী পরিবার-পরিজনহীন অথবা কেবল স্বামী-স্ত্রী মিলে বসবাস করেন। শতকরা ৫৯ জন প্রবীণ নারী বিধবা এবং ছেলে-সন্তানের মা। তারা ছেলে-সন্তানের সঙ্গে থাকেন না। নানা দুরবস্থার মধ্য দিয়ে তাদের জীবন কাটে। (তথ্যসূত্র: বাংলাদেশ প্রতিদিন, ১৬ আগস্ট, ২০১৪)
পিতা-মাতাকে প্রাপ্য মর্যাদা না দিলে বিশৃঙ্খলা
অন্যদিকে সন্তানরা বৃদ্ধ পিতা-মাতাকে প্রাপ্য মর্যাদা না দেওয়ার ফলে পারিবারিক শান্তি বিঘ্নিত হচ্ছে ও পরিবারপ্রথা হুমকির মুখে পড়ছে। বিভিন্ন ধরনের সামাজিক বিশৃঙ্খলা সৃষ্টি হচ্ছে।
অথচ পবিত্র কোরআনে (সন্তানদের শিক্ষামূলক) বলা হয়েছে, ‘হে আমার প্রতিপালক! তুমি আমাকে সামর্থ্য দাও, যাতে আমি তোমার প্রতি কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করতে পারি। আমার প্রতি ও আমার পিতা-মাতার প্রতি তুমি যে অনুগ্রহ করেছ, তার জন্য এবং যাতে আমি সৎকাজ করতে পারি, যা তুমি পছন্দ করো। ’ (সুরা আহকাফ, আয়াত: ১৫)
মা-বাবার জন্য বৃদ্ধাশ্রম নয়
প্রসঙ্গত, আমাদের সমাজে একটি বিষয় ইদানিং মাথাচাড়া দিয়ে ওঠেছে। সেটা হলো, বয়স্ক পিতা-মাতাকে বৃদ্ধাশ্রমে রেখে আসা। অথচ সন্তানেরা বেশ সামর্থ্যবান ও বিত্তশালী। প্রবীণেরা বৃদ্ধাশ্রমে যদিও খাওয়া-পরা সবকিছুই সঠিকভাবে পেয়ে থাকেন, কিন্তু নিজের আপনজনদের ছেড়ে একাকিত্ব জীবন যে কত কষ্ট ও বিষাদের তা বলাইবাহুল্য। অথচ ইসলামের বিধানে প্রবীণেরা ভালোবাসা, সেবাযত্ন ও শ্রদ্ধা পাওয়ার অত্যাধিক যোগ্য ও অধিকারী।
পবিত্র কোরআনে বর্ণিত হয়েছে, ‘আমি মানুষকে পিতা-মাতার প্রতি সদাচারণের নির্দেশ দিয়েছি। ’ (সুরা লোকমান, আয়াত: ১৪)
আবু উমামা (রা.) থেকে বর্ণিত হয়েছে, এক ব্যক্তি রাসুলুল্লাহ (সা.)-কে জিজ্ঞেস করলেন, সন্তানের ওপর পিতা-মাতার দায়িত্ব কী? রাসুলুল্লাহ (সা.) বললেন, তারা উভয়েই তোমার জান্নাত অথবা জাহান্নাম। (ইবনে মাজাহ, পৃষ্ঠা নং: ২৬০)
হাদিসের সারমর্ম হচ্ছে, তাদের আনুগত্য ও সেবাযত্ন জান্নাতে নিয়ে যায় এবং তাদের সঙ্গে অসৎ আচরণ ও তাদের অসন্তুষ্টি জাহান্নামে পৌঁছে দেয়।
আবদুল্লাহ ইবনে ওমর (রা.) থেকে বর্ণিত এক হাদিসে রাসুলুল্লাহ (সা.) ইরশাদ করেন, পিতা-মাতার সন্তুষ্টির মধ্যেই আল্লাহর সন্তুষ্টি এবং পিতা-মাতার অসন্তুষ্টির মধ্যেই আল্লাহর অসন্তুষ্টি নিহিত। (তিরমিজি, হাদিস: ২/১২)
অন্য হাদিস বর্ণিত হয়েছে, এক ব্যক্তি রাসুলুল্লাহ (সা.)-কে প্রশ্ন করেন, আল্লাহর কাছে সর্বাধিক প্রিয় কাজ কোনটি? রাসুলুল্লাহ (সা.) বললেন, ‘সময় মতো নামাজ পড়া। ’ তিনি আবার প্রশ্ন করলেন, এরপর কোনো কাজটি সর্বাধিক প্রিয়? রাসুলুল্লাহ (সা.) বললেন, ‘পিতা-মাতার সঙ্গে সদ্ব্যবহার করা। ’ (বুখারি, হাদিস: ১/৭৬)
এ হাদিস দ্বারা প্রতীয়মান হয়, দ্বীনের অন্যতম স্তম্ভ নামাজের পরে আল্লাহর কাছে সর্বাধিক প্রিয় কাজ হলো পিতা-মাতার সঙ্গে সদ্ব্যবহার করা।
পিতা-মাতা অমুসলিম হলেও সদ্ব্যবহার করতে হবে
অনেকে ধারণা করে থাকেন, পিতা-মাতার আনুগত্য ও সদ্ব্যবহারের জন্য তাদের অত্যন্ত নেককার ও সৎ ব্যক্তি হতে হবে, এমন ধারণা আদৌ ঠিক নয়। এমনকি যদি কারো পিতা-মাতা অমুসলিম হয়, তাহলে তাদের সঙ্গেও সদ্ব্যবহার করার জন্য ইসলাম জোর নির্দেশ দিয়েছে।
এ ব্যাপারে ইমাম বুখারি (রহ.) একটি হাদিস বর্ণনা করেছেন। আসমা বিনতে আবু বকর (রা.) থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, আমার মা অমুসলিম অবস্থায় আমার নিকট আসলেন, আমি রাসুল (সা.)-কে জিজ্ঞেস করলাম, হে আল্লাহর রাসুল! আমার মা আমার নিকট দেখা করতে আসেন, আমি কি তার সঙ্গে সদাচরণ করতে পারবো? রাসুল (সা.) বললেন, ‘হ্যাঁ! তার সঙ্গে তুমি অবশ্যই সদ্ব্যবহার করো। ’ (বুখারি হাদিস: ২/৮৮৪)
মা-বাবার সেবা ও সংগ্রাম-জিহাদের অবস্থান
ইসলামে পিতা-মাতার খেদমত-সেবা ও তাদের সঙ্গে সদ্ব্যবহারের গুরুত্ব এতো বেশি যে, জিহাদ বা সংগ্রাম ফরজে কেফায়ার স্তরে থাকা পর্যন্ত পিতা-মাতার অনুমতি ছাড়া সন্তানের জন্য জিহাদে অংশ গ্রহণ করা জায়েজ নয়।
বুখারি শরিফে আবদুল্লাহ ইবনে ওমর (রা.) থেকে বর্ণিত হাদিসে আছে, একজন ব্যক্তি রাসুলুল্লাহ (সা.)-কে বলেন, আমি জিহাদে অংশ নিতে চাই, রাসুলুল্লাহ (সা.) তাকে জিজ্ঞেস করলেন, তোমার পিতা-মাতা জীবিত কী আছেন? সে বললো, হ্যাঁ! রাসুল (সা.) বললেন, তাহলে তুমি পিতা-মাতার সেবাযত্নে আত্মনিয়োগ করো। (বুখারি, হাদিস: ৮৮৩)
তাদের প্রতি কখনো অবজ্ঞা-অযত্ন ও অবহেলা নয়
পুরো জীবন-যৌবন ব্যয় করে যারা সন্তানের ভবিষ্যত গড়েন, তাদের অনেকেই এক কালে ভীষণ একা ও অপাঙক্তেয় হয়ে পড়েন। সন্তানের অবহেলা, অবজ্ঞা ও অযত্ন তাদের চরম কষ্টে ফেলে দেয়। বিষাদক্লিষ্টতা ও দুঃখভরা মনে দিনমান অতিবাহিত করতে হয়।
অথচ ইসলামের শিক্ষা হলো, সন্তানের অসহায়ত্বের সময় যেভাবে পিতা-মাতা তাকে স্নেহভরে সযত্নে প্রতিপালন করেছেন, পিতা-মাতার অসহায়ত্ব বা বৃদ্ধাবস্থায় তাদের সেভাবে লালন-পালন করা সন্তানের অবশ্য কর্তব্য।
এ মহৎ দায়িত্ব পালনে অবহেলা করা অমানবিক, ইসলাম ও সভ্যতাবিবর্জিত কাজ। যারা এমন কাজ করে তাদের কোথাও ক্ষমা নেই। এমন কাজের কারণে পরকালে কঠিন শাস্তি পেতে হবে, আর দুনিয়াতেও নিজের বার্ধক্যাবস্থায় আরো চরম পরিণতি ভোগ করতে হবে।
ইসলাম পিতা-মাতা, আত্মীয়-স্বজন ও সর্বস্তরের প্রবীণদের প্রতি সম্মান প্রদর্শন ও তাদের অসহায়ত্বের সময় সেবাযত্ন করার তাগিদ দিয়েছে। একজন সুস্থ বিবেক ও মানবিক গুণাবলীসম্পন্ন মানুষ তার বৃদ্ধ পিতা-মাতা এবং তার আত্মীয়-পরিজন ও অন্যান্য প্রবীণদের কখনো অবহেলা বা উপেক্ষা করতে পারে না। তাই আসুন, সব প্রবীণদের প্রতি শ্রদ্ধাশীল ও যত্নবান হই।
বাংলাদেশ সময়: ০৭৪০ ঘণ্টা, এপ্রিল ২৮, ২০২৩
এসআই