ঢাকা, সোমবার, ৮ পৌষ ১৪৩১, ২৩ ডিসেম্বর ২০২৪, ২০ জমাদিউস সানি ১৪৪৬

ইসলাম

ধনীদের মধ্যে সর্বপ্রথম জান্নাতে যাবেন যিনি

ইসলাম ডেস্ক | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ০৭৪২ ঘণ্টা, সেপ্টেম্বর ১, ২০২৩
ধনীদের মধ্যে সর্বপ্রথম জান্নাতে যাবেন যিনি

ইসলামের প্রথম দিকেই সাহাবি আবদুর রহমান বিন আউফ (রা.) ইসলাম গ্রহণ করেন। আবুবকর সিদ্দিক (রা.) এর দাওয়াতে যারা মুসলমান হয়েছেন, তিনি তাদের অন্যতম।

তার জন্ম ৫৮১ খ্রিষ্টাব্দে কোরাইশের বনু জোহরা গোত্রে। তিনি বয়সে নবীজি  (সা.) থেকে ১০ বছরের ছোট। ইসলাম গ্রহণের আগে তার নাম ছিল আবদে আমর বা আবদুল কাবা। রাসুল (সা.) তার নাম পরিবর্তন করে রাখেন আবদুর রহমান।

কাফেরদের নির্যাতনে অতিষ্ঠ হয়ে তিনি হাবশায় (বর্তমান ইথিওপিয়া) প্রথমবার হিজরত করেন। পরবর্তী সময়ে মদিনায় স্থায়ীভাবে হিজরত করেন।

মদিনা হিজরতের পর নবীজি (সা.) তাকে সাদ ইবনে রবি আনসারির সঙ্গে ভ্রাতৃত্বের সম্পর্ক করে দেন। সাদ (রা.) তাকে ডেকে বললেন, ‘আনসারদের সবাই জানে, আমি একজন ধনী ব্যক্তি। আমি আমার সব সম্পদ সমান দুইভাগ করে আপনাকে একভাগ দিতে চাই। আর আমার দুইজন স্ত্রী আছে। তাদের যাকে আপনার পছন্দ হয় আমি তাকে তালাক দেব। তারপর আপনি তাকে বিবাহ করে নেবেন। ’ কিন্তু আবদুর রহমান (রা.) বললেন, ‘আল্লাহ আপনার পরিবার ও সম্পদে বরকত দান করুন। ভাই, আমার এসব কোনো কিছুর প্রয়োজন নেই। আমাকে শুধু মদিনার বাজারটি দেখিয়ে দিন। ’

সাদ ইবনে রবির এ অতুলনীয় ভ্রাতৃত্ব-উদারতা মানব জাতির ইতিহাসে বিরল। অন্যদিকে আবদুর রহমান বিন আউফের আত্মনির্ভরতা ও নিজ থেকে কিছু করার দৃঢ় মন-মানসিকতার বিষয়টিও অনুসরণীয়।  

মদিনার কাইনুকা বাজারে ক্ষুদ্র পরিসরে ব্যবসা শুরু করেন। কিছু দিন পর এক আনসারি নারীকে বিবাহ করেন। পরে রাসুল (সা.) তার কাপড়ে হলুদের দাগ দেখে জিজ্ঞেস করেন, তুমি কি বিবাহ করেছ? বললেন, হ্যাঁ। নবীজি (সা.)বললেন, ‘একটি ছাগল দিয়ে হলেও ওলিমা করে নাও। ’ তিনি ব্যবসা চালিয়ে যেতে থাকলেন। কিছুদিন পর আরও কিছু পয়সা জমা হলে নবীজির (সা.) নির্দেশ মতো ওলিমার কাজটি সেরে নেন। (বোখারি, হাদিস নং : ২০৪৯)

আল্লাহর পথে খরচ করা ও দান-বদান্যতায় তিনি অনন্য নজির তৈরি করেছিলেন। কিন্তু তিনি যখন মদিনায় এসেছিলেন, তখন ছিলেন সম্পূর্ণ রিক্ত হস্ত। অল্প কিছু ঘি ও পনির নিয়ে ব্যবসা শুরু করেন। পরবর্তীকালে তিনি অন্যতম সেরা ব্যবসায়ী ও ধনাঢ্য ব্যক্তিতে পরিণত হন। রাসুলুল্লাহ (সা.) তার সম্পদ বৃদ্ধির জন্য দোয়া করেছিলেন। আল্লাহ তা কবুলও করেছেন। কিন্তু সম্পদের প্রতি লোভ ও আকর্ষণ তার ছিল না। আল্লাহর রাস্তায় এবং মানবকল্যাণে অকৃপণ হাতে সম্পদ ব্যয় করতেই তিনি আনন্দ পেতেন। তার অত্যধিক দানের কারণে এ কথা বলা হতো যে, ‘আবদুর রহমানের সম্পদের মধ্যে মদিনাবাসীর অংশ রয়েছে। ’ একবার রাসুল (সা.) ঘোষণা দিলেন, ‘আমি একটি অভিযানে সৈন্য পাঠানোর ইচ্ছা করেছি, তোমরা সাহায্য করো। ’

আবদুর রহমান বিন আউফ দৌঁড়ে বাড়ি গেলেন। ফিরে এসে বললেন, হে আল্লাহর রাসুল! আমার কাছে এ চার হাজার আছে। দুই হাজার আমার রবকে করজে হাসানা দিলাম। আর বাকি দুই হাজার আমার পরিবারের জন্য রেখে দিলাম। রাসুল (সা.) বললেন, ‘তুমি যা দান করেছ এবং যা রেখে দিয়েছ তার সবকিছুতেই আল্লাহ বরকত দান করুন। ’ তাবুক যুদ্ধের সময় তিনি রেকর্ড পরিমাণ সম্পদ আল্লাহর রাস্তায় দান করেন। তা দেখে ওমর (রা.) বলে ফেললেন, আমার মনে হচ্ছে আবদুর রহমান পরিবারের জন্য কিছুই রাখেননি। রাসুল (সা.) জিজ্ঞেস করলেন, পরিবারের জন্য কিছু রেখেছ? তিনি বললেন, হ্যাঁ। রাসুল বললেন, কত? তিনি বললেন, আল্লাহ ও তার রাসুল যে রিজিক ও প্রতিদানের অঙ্গীকার করেছেন তাই। ’

একবার সিরিয়া থেকে বিপুল পরিমাণ খাদ্যশস্য নিয়ে তার একটি বাণিজ্য কাফেলা মদিনায় আসে। ৫০০ উটের পিঠে (মতান্তরে ৭০০) মালপত্র বোঝাই ছিল। এতে সারাটা মদিনায় রব পড়ে যায়। উম্মুল মুমিনিন আয়শা (রা.) বললেন, ‘আমি রাসুলুল্লাহ (সা.) কে বলতে শুনেছি, আবদুর রহমান জান্নাতে হামাগুড়ি দিয়ে প্রবেশ করবে। ’ উম্মুল মুমিনিনের এ কথা আবদুর রহমানের কানে গেল। তিনি বললেন, ‘হে জননী! আমি এ বিশাল বাণিজ্য সম্ভার আল্লাহর রাস্তায় দান করে দিলাম। ’ (উসদুল গাবাহ)
আনাস (রা.) বলেন, আমি রাসুল (সা.) কে বলতে শুনেছি, ‘আমার উম্মতের মধ্যে সর্বপ্রথম (ধনী হিসেবে) জান্নাতে প্রবেশ করবেন আবদুর রহমান বিন আউফ। তিনি হামাগুড়ি দিয়ে জান্নাতে প্রবেশ করবেন। ’ (মুসনাদে বাজ্জার : ৭০০৩)

ইবনে হাজার (রহ.) আল-ইসাবা গ্রন্থে উল্লেখ করেন, আবদুর রহমান বিন আউফ (রা.) মোট ৩০ হাজার দাস মুক্ত করেছেন। আল্লাহর রাস্তায় ৪০ হাজার দিনার, ৫০০ ঘোড়া এবং ৫০০ বাহন দান করেছেন। (উসদুল গাবাহ)

অঢেল সম্পত্তির মালিক হয়েও তিনি অত্যন্ত বিনয়ী ও দুনিয়াবিমুখ ছিলেন। সম্পদের ব্যাপারে সবসময় ভীত-সন্ত্রস্ত থাকতেন। সাদ ইবনে ইবরাহিম তার বাবা থেকে বর্ণনা করেন, একদিন আবদুর রহমান বিন আউফ সিয়াম পালন করছিলেন। ইফতারের সময় তার সামনে ভালো মানের খাবার পরিবেশ করা হলো। এ খাবারের দিকে তাকিয়ে বললেন, ‘মুসআব ইবনে উমায়ের ছিলেন আমার থেকে উত্তম মানুষ। তিনি শহীদ হলে তার জন্য মাত্র ছোট্ট একখানা কাফনের কাপড় পাওয়া গিয়েছিল। তা দিয়ে মাথা ঢাকলে পা এবং পা ঢাকলে মাথা বের হয়ে যেত। এখন আল্লাহ আমাদের জন্য দুনিয়ার প্রাচুর্য দান করেছেন। আমার ভয় হয়, না জানি আমাদের বদলা দুনিয়াতেই দিয়ে দেওয়া হচ্ছে। ’ অতঃপর তিনি হাউমাউ করে কাঁদতে কাঁদতে আর খাবার গ্রহণ করেননি। (উসদুল গাবাহ)। আরেকবার তার সামনে গোশত ও রুটি পেশ করা হলে তিনি কাঁদতে শুরু করেন। এরপর বলেন, ‘প্রিয়তম রাসুল (সা.) এমতাবস্থায় দুনিয়া থেকে বিদায় গ্রহণ করেছেন যে, তিনি এবং তার পরিবার যবের রুটি পেটপুরে খেতে পারেননি। জানি না, আমাদের উত্তম জিনিস থেকে বঞ্চিত করা হচ্ছে কিনা। ’ (ইতহাফ : ৭৩৪২)

আবদুর রহমান বিন আউফ (রা.) রাসুলুল্লাহ (সা.) এর অত্যন্ত প্রিয় সাহাবি। তিনি নবীজির (সা.)সঙ্গে সব যুদ্ধেই অংশগ্রহণ করেছেন এবং অত্যন্ত সাহস ও দৃঢ়তার পরিচয় দিয়েছেন। বদরের যুদ্ধে আবদুর রহমান (রা.) পায়ে আঘাত পান। ওহুদ যুদ্ধে তিনি অংশগ্রহণ করে অসীম সাহস ও বীরত্বের পরিচয় দেন। নবম হিজরিতে তিনি রাসুল (সা.) এর সঙ্গে তাবুক অভিযানে অংশগ্রহণ করেন। এ অভিযানকালে একদিন রাসুল (সা.) প্রকৃতির ডাকে সাড়া দিতে বাইরে যান। ফিরতে একটু দেরি হয়। এদিকে নামাজের সময়ও হয়ে যায়। সমবেত মুসল্লিদের অনুরোধে আবদুর রহমান (রা.) ইমাম হিসেবে নামাজে দাঁড়িয়ে যান। রাসুল (সা.) ফিরে এসে দেখেন এক রাকাত হয়ে গেছে। তিনি আবদুর রহমানের পেছনে ইকতেদা করেন। রাসুলুল্লাহ (সা.) এর উপস্থিতি অনুভব করে আবদুর রহমান (রা.) পেছনে সরে আসার চেষ্টা করেন। কিন্তু রাসুল (সা.) তাকে নিজের স্থানে থাকার জন্য ইশারা করেন। অতঃপর তিনি দ্বিতীয় রাকাতটিও শেষ করেন। নামাজ শেষে নবীজি (সা.)বললেন, ‘তোমরা সঠিক কাজ করেছ। ’ (বোখারি ও মুসলিম)
রাসুল (সা.) এর জীবদ্দশায় শুধু দুইজন সাহাবি তার ইমামতি করার সৌভাগ্য লাভ করেছেন। তারা হলেন আবুবকর সিদ্দিক ও আবদুর রহমান ইবনে আউফ (রা.)।

৩১ হিজরি কিংবা ৩২ হিজরিতে মদিনায় তিনি মৃত্যু বরণ করেন। মৃত্যুকালে তার বয়স ছিল ৭৫ বছর। তাকে মদিনার জান্নাতুল বাকিতে দাফন করা হয়। ওসমান বিন আফফান (রা.) তার জানাজায় ইমামতি করেন।

বাংলাদেশ সময়: ০৭৩৮ ঘণ্টা, সেপ্টেম্বর ১, ২০২৩
এসআই

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।