ইসলামের দৃষ্টিতে শ্রমিকের অধিকার ও মর্যাদা অপরিসীম। শ্রমিকের অধিকার প্রতিষ্ঠায় কোরআনুল কারিম ও হাদিস শরিফে সুস্পষ্ট নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে।
এখন পর্যন্ত পৃথিবীতে যা কিছু গড়ে উঠেছে তা সবই শ্রমের ফল ও শ্রমিকের কৃতিত্ব। ইসলামের দৃষ্টিতে সম্পদের সার্বভৌমত্ব ও মালিকানা একমাত্র আল্লাহর, আর মানুষ তার তত্ত্বাবধায়ক মাত্র। সুতরাং এখানে মালিক-শ্রমিক সবাই ভাই ভাই। তাদের পারস্পরিক সম্পর্ক হবে শ্রদ্ধা, স্নেহ, সোহার্দ্য ও বিশ্বস্ততায় ভরপুর। শ্রমিক ও মালিকের অধিকার রয়েছে নিজ নিজ প্রাপ্য বুঝে পাওয়ার। বলা হয়েছে, নিজ নিজ কর্তব্য পালনে দায়িত্বশীল হতে। শুধু মালিক-শ্রমিক নয়, বরং উভয়কে সুসংহত ও সহিষ্ণু আচরণ করার নির্দেশ দিয়েছে ইসলাম।
ইসলামে শ্রমের শ্রেণিবিন্যাসকে স্বীকার করলেও মানবিক মূল্যবোধ ও মৌলিক মানবাধিকারের ক্ষেত্রে সবাই সমান। আল্লাহতায়ালা ইরশাদ করেন, অতঃপর নামাজ সমাপ্ত হলে জীবিকার্জনের জন্য তোমরা জমিনে ছড়িয়ে পড় এবং আল্লাহকে অধিক স্মরণ কর, যাতে তোমরা সফলকাম হতে পারো (সুরা জুমা-১০)। আল্লাহতায়ালা অন্যত্র বলেন, নিশ্চয়ই আমি মানুষকে শ্রমনির্ভর রূপে সৃষ্টি করেছি (সুরা বালাদ-৪)। তিনি আরও বলেন, সর্বোত্তম শ্রমিক সে, যে দৈহিক দিক দিয়ে শক্ত সামর্থ্য ও আমানতদার।
পৃথিবীর সর্বপ্রথম মানুষ ও প্রথম নবী হজরত আদম আলাইহিস সালাম থেকে শুরু করে বহু নবী-রসুল এমনকি সর্বশেষ ও সর্বশ্রেষ্ঠ নবী হজরত মুহাম্মাদুর রসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম পর্যন্ত সবাই শ্রমজীবী ছিলেন। প্রথম নবী হজরত আদম (আ.) নিজ হাতে চাষাবাদ করেছেন। হজরত লূত ও শিস (আ.) কৃষিকাজ করতেন। হজরত শোয়াইব ও হারুন (আ.) পশুপালন করতেন। হজরত নূহ (আ.) কাঠমিস্ত্রি ছিলেন। হজরত ইব্রাহিম ও ইসমাইল (আ.) ছিলেন রাজমিস্ত্রি। হজরত ইয়াকুব ও হজরত মুসা (আ.) ছিলেন মেষপালক।
প্রিয় নবী হজরত রসুলুল্লাহ (সা.) বলেন, আমিও মজুরির বিনিময়ে মক্কাবাসীদের ছাগল ভেড়া চরিয়েছি। রসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ব্যবসা, কৃষি ও দীনচর্চাকে উৎসাহিত করেছেন। আবার মর্যাদার ক্ষেত্রে সব শ্রমিক সাধারণভাবে সমান ঘোষণা দিয়েছেন। তিনি বলেন, শ্রমজীবী মানুষ আল্লাহর বন্ধু। ইসলাম শ্রমিককে বলেছে, দক্ষ বিশ্বস্ত ও দায়িত্ববান হতে।
পবিত্র কোরআনে আদর্শ শ্রমিক হিসেবে হজরত মুসা (আ.)-এর বৈশিষ্ট্য এভাবে বর্ণিত হয়েছে, হে পিতা! আপনি তাকে শ্রমিক হিসেবে নিয়োগ দিন। নিশ্চয়ই আপনার শ্রমিক হিসেবে সে-ই উত্তম, যে সামর্থ্যবান ও বিশ্বস্ত (সুরা কাসাস-২৬)। ইসলামী শ্রমনীতির শ্রেষ্ঠত্ব ও স্বাতন্ত্র্য এখানেই, যে ইসলাম মালিক ও শ্রমিকের জন্য অভিন্ন খাবারের নির্দেশ দিয়েছে।
নবীজি (সা.) এরশাদ করেন, তারা তোমাদের ভাই, আল্লাহ তাদের তোমাদের অধীন করেছেন। সুতরাং যার ভাইকে তার অধীন করেছেন সে যেন তাকে তাই খাওয়ায় যা সে খায়। সেই কাপড় পরিধান করায়, যা সে পরিধান করে, তাকে সামর্থ্যরে অধিক কোনো কাজের দায়িত্ব দেবে না, যদি এমনটা করতে হয় তাহলে সে যেন তাকে সাহায্য করে (বুখারি)। এমনকি গোলাম বান্দির সঙ্গেও ইসলাম সদাচরণ করার নির্দেশ দিয়েছে।
প্রিয় নবী হজরত রসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু সাল্লাম ইন্তেকালের সময় দুটি বিষয়ে বিশেষভাবে উম্মতকে সতর্ক করেছেন। তিনি বলেন, হে আমার উম্মত! নামাজের ব্যাপারে সতর্ক হও এবং তোমাদের অধীনস্থ গোলাম বান্দির প্রতি সদয় হও। সাবধান তাদের প্রতি অবিচার-অত্যাচার করবে না। আমাদের বাসাবাড়িতে কাজের বুয়া, কাজের ছেলে তারা কিন্তু গোলাম বান্দি নয়। এক্ষেত্রে এই হাদিসের প্রয়োগ এখানে আমাদের অত্যধিক সতর্ক থাকতে হবে, তাদের প্রতি যেন কোনো অবস্থাতেই কোনো ধরনের জুলুম-অবিচার, দুর্ব্যবহার ও মানসম্মান নষ্ট করা, তাদের প্রাপ্য বুঝে দিতে টালবাহানা করা, কোনোমতেই গ্রহণযোগ্য নয়। তাদের কষ্ট দেওয়া ও নিম্নমানের খাদ্য-বস্ত্র-বাসস্থান প্রদান করাও জুলুম। সর্বোপরি কোনো ধরনের ভুলত্রুটি পরিলক্ষিত হলে বা কোনো জিনিসের ক্ষতি হলে বা কোনো প্রকারের সময় ক্ষেপণ হলে তাদের প্রতি শারীরিক অত্যাচার, নিপীড়ন করা, গালমন্দ করা মানবতাবিরোধী ও স্পষ্ট হাদিসের লঙ্ঘন এবং রাষ্ট্রীয় আইনেও অপরাধী হিসেবে গণ্য হবে।
লেখক: মুফতি রুহুল আমিন কাসেমী, ইমাম ও খতিব, কাওলারবাজার জামে মসজিদ, দক্ষিণখান, ঢাকা।
বাংলাদেশ সময়: ১১৫৮ ঘণ্টা, নভেম্বর ১৪, ২০২৩
এফআর