পবিত্র রমজানুল মোবারকের অন্যতম দান হলো ইফতার। রসূল সা. বলেন, ‘কেউ যদি রমজান মাসে কোনো রোজাদারকে ইফতার করায় তাহলে ওই ইফতার করানোটা তার গুনাহ মাফের ও জাহান্নাম থেকে মুক্তির কারণ হবে এবং সে একটি রোজার সওয়াব পাবে অথচ রোজা পালনকারীর নেকী মোটেই কমানো হবে না।
ইফতারের গুরুত্ব ও ফজিলত সম্পর্কে স্বয়ং রসুল সা. বলেছেন,‘রোজাদারের জন্য দুটি আনন্দ রয়েছে ১. ইফতারের সময় ২. মহান আল্লাহর সঙ্গে মোলাকাত বা সাক্ষাতের সময়’। (বোখারি ও মুসলিম)।
ইফতার শব্দটি আরবি ফুতুর শব্দ থেকে এসেছে। ফুতুর- অর্থ নাস্তা। ইফতারের অর্থ খোলা, উন্মুক্ত করা, ছেড়ে দেওয়া ইত্যাদি। ইসলামি পরিভাষায় সূর্যাস্তের পর খেজুর, পানি বা কোনো খাদ্যদ্রব্য ভক্ষণের মাধ্যমে রোজা ছেড়ে দেওয়াকে ইফতার বলে।
দোয়া কবুলের অন্যতম সময়: পবিত্র রমজান মাসে ইফতারের সময়টি গুরুত্বপূর্ণ মুহূর্ত। অদৃশ্য শক্তির আদেশ পালনার্থে ভীষণ ক্ষুধা-তৃষ্ণা থাকা সত্ত্বেও বনি আদম প্রহর গুনতে থাকে সূর্যাস্তের। এ সময় মহান আল্লাহ আদম জাতির ওপর সন্তুষ্ট হয়ে তাদের আশা-আকাঙ্ক্ষা পূরণ করেন। রসূল সা. বলেছেন, ‘ইফতার করার সময় রোজাদারের দোয়া কবুল হয়ে থাকে। ’ (আবু দাউদ শরীফ)। আর এ জন্যই হজরত আবদুল্লাহ ইবনে ওমর (রহ.) ইফতারের সময় পরিবারের সবাইকে সমবেত করে দোয়া করতেন।
মহা পুণ্যের কাজ ইফতার করানো: মাহে রমজান ভ্রাতৃত্ববোধ ও সহানুভূতির শিক্ষা দিয়ে থাকে। এ মাসের কারণে মানুষ ক্ষুধা ও তৃষ্ণার জ্বালা বুঝতে পারে। এ জন্য এক মুমিনের হৃদয় ধাবিত হয় অন্য মুমিনের সুখ-দুঃখের খবর সন্ধানে। যার বাস্তব রূপ প্রকাশ পায় ইফতারের মাধ্যমে। রসূলে পাক সা. এরশাদ করেন, ‘রমজান মাসে যে ব্যক্তি কোনো রোজাদারকে ইফতার করাবে, তার গুনাহগুলো মাফ হয়ে যাবে। সে দোজখ থেকে মুক্তি পাবে আরসে রোজাদারের সমপরিমাণ সওয়াব পাবে, কিন্তু এতে রোজাদারের সওয়াব থেকে কিছুই ঘাটতি হবে না অর্থাৎ রোজাদারের সওয়াব কমবে না। ’
১. এরূপ সওয়াব আল্লাহতায়ালা এমন ব্যক্তিকে দেবেন, যে শুধু এক পেয়ালা দুধ অথবা একটি খেজুর বা সামান্য পরিমাণ পানি দ্বারাও কাউকে ইফতার করাবে। আর যে ব্যক্তি কোনো রোজাদারকে তৃপ্তি মিটিয়ে খাওয়াবে আল্লাহ তাকে হাউজে কাওসার থেকে এমন শরবত পান করাবেন যাতে সে কখনও তৃষিত হবে না। এভাবে সে জান্নাতে প্রবেশ করবে। (বায়হাকি) সাহাবীরা বলেন, হে আল্লাহর রসূল (সা.) আমাদের এমন সংস্থান নেই যা দিয়ে আমরা কাওকে ইফতার করাতে পারি? রসুল বলেন, ‘আল্লাহ তাকেও এই সওয়াব দেবেন, যে ব্যক্তি কোনো রোজা পালনকারীকে এক ঢোক দুধ অথবা একটা শুকনো খেজুর কিংবা এক চুমুক পানি দিয়েও ইফতার করাবে আর যে ব্যক্তি কোনো রোজাদারকে পরিতৃপ্তি সহকারে খাওয়াবে আল্লাহ তাকে হাউজে কাওছার থেকে এমন ভাবে পানি পান করাবেন যার ফলে, সে জান্নাতে না পৌঁছানো পর্যন্ত আর তৃষ্ণার্ত হবে না। ’ ( বায়হাকী ওয়াবুল ঈমান, মেশকাত ১৭৪ পৃষ্ঠা)।
২. আল্লাহর রসুল বলেন, ‘লোকেরা ততক্ষণ কল্যাণে থাকবে যতক্ষণ তারা ইফতার জলদি করবে। ’ (বুখারী, মুসলিম ১ খণ্ড-৩২১ পৃঃ মিশকাত ১৭৫ পৃঃ)
৩. আল্লাহ রাব্বুল আলামীন বলেন, ‘আমার নিকট সবচেয়ে প্রিয় সেই বান্দা যে ইফতার সঠিক সময়ে করে। ’ (তিরমিযী ১ম খণ্ড, ৮৮ পৃঃ, মেশকাত ১৭৫ পৃঃ) । এ হাদিসগুলো প্রমাণ করে যে, ইফতারের নির্দিষ্ট সময় থেকে দেরী করা মোটেই উচিত নয়।
যদি কেউ ইচ্ছা করে ইফতারে দেরি করে তাহলে সে রসুলুল্লাহর নির্দেশ অনুযায়ী কল্যাণ থেকে বঞ্চিত হবে এবং আল্লাহর নিকট অপ্রিয় হবে। সুতরাং এ ব্যাপারে আমাদের সচেতন হওয়া উচিত।
৪. আব্দুল্লাহ ইবনে আবী আওফ (রা.) বলেন, একবার আমরা (রমজানে) আল্লাহর রসূলের (সা.) সঙ্গে সফরে ছিলাম (তখন তিনি রোজা অবস্থায় ছিলেন) অতঃপর (সূর্য অস্তমিত হওয়ার পর) তিনি একজন সাহাবীকে বললেন, নামো এবং আমার জন্য ছাতু গুলে দাও। সাহাবী (সূর্য অস্তমিত হওয়ার পর) লালিমা দেখে বলল, হে আল্লাহর রসূল সা. ওই যে সূর্য (দেখা যায়) তিনি (তার কথায় কান না দিয়ে) আবার বললেন, তুমি নামো এবং আমার জন্য ছাতু গোলো। এভাবে তিন বার বললেন। অতঃপর বেলাল (রা.) নামলেন এবং রসুলুল্লাহ সা. এর জন্য ছাতু গুললেন। তিনি তা পান করলেন। তারপর তিনি পূর্ব দিকে ইশারা করে বললেন, ‘যখন তোমরা দেখবে যে, রাত ওই দিক থেকে আসছে তখন বুঝবে সিয়াম পালনকারীর ইফতারের সময় হয়ে গেছে। ’ (বুখারী ২৬০ পৃঃ মুসলিম ১ম খণ্ড ৩৫১ পৃঃ)
৫. হাদিসে আছে, হযরত সালমান ইবনে আমের রা. থেকে বর্ণিত, রসুলুল্লাহ সা. এরশাদ করেছেন, ‘যখন তোমাদের মধ্যে কেউ রোজায় ইফতার করে, সে যেন খেজুর কিংবা খোরমা দিয়ে ইফতার করে। কারণ, তা হচ্ছে বরকত। আর তা না হলে পানি দিয়ে করবে, তা পবিত্রকারী। ’ (জামে তিরমিজি, ২য় খণ্ড, হাদিস- ৬৯৫)।
কখন ইফতার করতে হবে সে প্রসঙ্গে হাদিসে রয়েছে, আমিরুল মুমেনিন হযরত উমর ইবনে খাত্তাব (রা.) থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, রসুলুল্লাহ (সা.) এরশাদ করেছেন, ‘যখন রাত্র সেদিক থেকে ঘনিয়ে আসে, দিনও এদিক থেকে চলে যায় এবং সূর্য ডুবে যায়, তখন সায়িম তথা রোজাদার ইফতার করবে। ’ (সহিহ বুখারী)। হাদিস মতে, যখন সূর্যাস্তের বিষয়টি নিশ্চিত হয়ে যায় তখন ইফতার করে নিতে হবে। তখন আর আপনাকে সাইরেন কিংবা আযানের জন্য অপেক্ষা করতে হবে না।
ইফতারির সময় হওয়ার আগ থেকে ইফতার নিয়ে বসে থাকা এবাদত। কিন্তু ইফতারির সময় হওয়া মাত্রই ইফতার করে নিতে হবে। আমাদের অনেকেই ইফতারির সময় হওয়ার পরও অহেতুক বিলম্ব করে থাকেন। মূলত: বিলম্বে ইফতার করা উচিত নয়। এতে মাকরূহ হবে বরং দ্রুত ইফতার করতে রসুলের এর নির্দেশনা রয়েছে।
৬. হযরত সাহল ইবন সাদ রা. থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, রসুলুল্লাহ সা. বলেছেন, ‘লোকেরা যতদিন যাবত ওয়াক্ত হওয়া মাত্রই ইফতার করবে, ততদিন তারা কল্যাণের উপর থাকবে। ’ (সহিহ বুখারী)
ইফতার তাড়াতাড়ি করা রসুলের কাছে প্রিয় এমনকি স্বয়ং আল্লাহর কাছেও প্রিয়।
হাদিসে আছে, হযরত আবু হুরাইরা (রা.) থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, রসুলুল্লাহ এরশাদ করেছেন, মহান আল্লাহ বলেন, ‘আমার বান্দাদের মধ্যে সেই বেশি প্রিয় যে ইফতার তাড়াতাড়ি করে। ’ (তিরমিজি, ২য় খণ্ড, হাদিস-৭০০)।
এই হাদিসে ইফতারে তাড়াতাড়ি মানে হচ্ছে, ইফতারের সময় হওয়ার পরপরই ইফতার দ্রুত করা। ইফতারের সময় হওয়ার আগেই তাড়াতাড়ি করে খেয়ে ফেলা নয়।
৭. রমজানের ইফতার রোজাদারদের জন্য মহান আল্লাহর পক্ষ থেকে বড় নেয়ামত। হাদিসে আছে, হযরত আবু হুরাইরা রা. থেকে বর্ণিত, রসূল সা. বলেছেন, ‘রোজাদারের জন্য দুটি বড় খুশি রয়েছে। একটি প্রভুর সাক্ষাত আরেকটি ইফতারের সময়। ’ (সহিহ বুখারি)
প্রকৃত অর্থে প্রকৃত রোজাদার ইফতারের সময় দিনের সব ক্লান্তি ভুলে সওয়াবের উদ্দেশ্যে খুশী মনেই ইফতার করেন। ইফতারের আরেকটি বড় ফজিলত হচ্ছে এ সময় রোজাদারের দোয়া আল্লাহর দরবারে কবুল হয়। তখন আপনি খালেছ নিয়তে যা চাইবেন তাই প্রভুর দরবারে কবুল হবে। রোজার ইফতার বান্দাকে সেই সুযোগ করে দিয়েছে।
৮. হযরত আবদুল্লাহ ইবনে আমর ইবনুল আস রা. থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, রসুলুল্লাহ সা. এরশাদ করেছেন, ‘নিশ্চয়ই রোজাদারের জন্য ইফতারের সময় এমন একটি দোয়া থাকে যা ফিরিয়ে দেওয়া হয় না। ’ (আত্তারগীব ওয়াত্তারহীব, ২য় খণ্ড, হাদিস- ২৯)।
আরেক হাদিসে আছে, হযরত আবু হুরাইরা রা. থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, হযরত মুহাম্মদ সা. এরশাদ করেছেন, ‘তিন ব্যক্তির দোয়া কখনও ফিরিয়ে দেওয়া হয় না। এক. রোজাদারের (ইফতারের সময়), দুই. ন্যায় বিচারক বাদশাহর এবং তিন. মজলুমের। এ তিনজনের দোয়া আল্লাহ পাক মেঘ থেকেও অনেক উঁচুতে তুলে নেন এবং আসমানের দরজা তাদের জন্য খুলে দেন। ’
৯. আল্লাহ পাক এরশাদ করেন, ‘আমি আমার সম্মানের শপথ করছি, আমি অবশ্যই তোমায় (দোয়াকারী) সাহায্য করবো, যদিও কিছু দেরিতে হয়। ’ (সুনানে ইবনে মাজাহ, ২য় খণ্ড, হাদিস- ১৭৫২)।
রোজাদারকে ইফতার করানোও সওয়াব। হাদিসে আছে, হযরত সালমান ফারসি রা. থেকে বর্ণিত, রসুলে পাক সা. এরশাদ করেছেন, ‘যে ব্যক্তি হালাল খাদ্য কিংবা পানি দ্বারা কোনো মুসলমানকে রোজার ইফতার করালো, ফেরেশতাগণ মাহে রমজানের এসময়ে তার জন্য ইস্তিগফার করেন। আর হযরত জিবরাইল আ. শবে কদরে তার জন্য আল্লাহর কাছে ক্ষমা প্রার্থনা করেন। ’ (তাবরানী আল মু’জামুল কবীর, ৬ষ্ঠ খণ্ড, হাদিস-৬১৬২)।
১০. আরেক হাদিসে আছে, রসুলুল্লাহ সা. বলেছেন, ‘যে ব্যক্তি রোজাদারকে পানি পান করাবে আল্লাহ তায়ালা তাকে পান করাবেন। সে জান্নাতে প্রবেশ করা পর্যন্ত কখনও পিপাসার্ত হবে না। ’ (কানযুল উম্মাল, ৮ম খণ্ড, হাদিস- ২৩৬৫৩)।
আরেক হাদিসে আছে, হযরত সালমান ফারসি রা. থেকে বর্ণিত, রসুলুল্লাহ সা. বলেন, ‘যে ব্যক্তি কোনো রোজাদারকে ইফতার করাবে তার গোনাহ মাফ হয়ে যাবে, সে জাহান্নাম থেকে মুক্তি লাভ করবে। ওই রোজাদারের সওয়াবের সমপরিমাণ সওয়াব সে লাভ করবে। তবে ওই রোজাদারের সওয়াবে কোনো কম করা হবে না। এভাবে ইফতার করানোর সওয়াব বর্ণনা করে শেষ করা যাবে না। ’
ইফতারের আগে কিংবা পরে দোয়া পড়া বাঞ্ছনীয়। দোয়াটি হলো- আল্লাহুম্মা ইন্নি লাকা ছুমতু ওয়া বেকা আ’মানতু ওয়া আলাইকা তাওয়াক্কালতু ওয়া আলা রিজকিকা আফতারতু। (ফতোয়ায়ে আলমগীরী)।
বাংলাদেশ সময়: ১৬০৪ ঘণ্টা, মার্চ ৭, ২০২৪
এমজে