ঢাকা: বৃহস্পতিবার (১৫ জানুয়ারি) রাত ১০টার কিছু পরে রাজধানীর মুন্নু গেট সংলগ্ন ফুটপাতে কিছু লোকের জটলা চোখে পড়ল। কাছে গিয়ে দেখা গেল, এক বৃদ্ধ তীব্র শ্বাস কষ্টে ভুগছেন।
জানা গেল, বৃদ্ধের সাথীরা ইজতেমায় এসেছেন ময়মনসিংহ থেকে ট্রাকে করে। খোলা ট্রাকে দীর্ঘ সময় থাকার কারণে বৃদ্ধের এই অবস্থা। এভাবে খোলা ট্রাকে আসা ঠিক হয়নি বলে অভিমত দিলেন কয়েকজন। এর প্রতিবাদে কয়েকজন বললেন, ‘আরে ভাই! তাও তো ট্রাক পাওয়া গেছে!’
শুধু ময়মনসিংহ থেকে আসা ওই ২৩-২৪ জন মুসল্লিই নন, এভাবে কষ্ট স্বীকার করে ইজতেমার দ্বিতীয় পর্বে অংশ নিচ্ছেন লাখো ধর্মপ্রাণ মুসল্লি। টানা অবরোধের কারণে এই ভোগান্তি পোহাতে হচ্ছে তাদের। রাজনৈতিক অস্থিতিশীলতায় অবরোধ ও হরতালে নানা রকম ঝুঁকি-ঝাক্কি পেরিয়ে, দুর্ভোগের গণ্ডি ভেদ করে, পথে পথে বিড়ম্বনার সীমাহীন বাধা ডিঙিয়ে মুসল্লিরা জমায়েত হয়েছেন তুরাগ তীরে।
পথের আতঙ্ক ও রাজনৈতিক অস্থিরতা ছাপিয়ে কোনো ঐশ্বরিক শক্তিবলে তারা ইজতেমায় আসার এমন মানসিক দৃঢ়তা পেয়েছেন তা আল্লাহই মালুম।
এতদিন বাংলাদেশের স্বাভাবিক রীতি ছিল, কোনো ধর্মীয় আচার-অনুষ্ঠান ও উৎসব-আয়োজনের সময় হরতাল-অবরোধের মতো রাজনৈতিক কর্মসূচি স্থগিত রাখার।
দীর্ঘদিনের সেই রীতি ভেঙে এবারই প্রথম বিএনপি নেতৃত্বাধীন ২০ দলীয় জোট লাগাতার অবরোধ কর্মসূচি অব্যাহত রেখেছে। ফলে পথে-ঘাটে নানাবিধ ভোগান্তি সহ্য করে আতঙ্ক মাথায় নিয়ে ইজতেমায় আসছেন মুসল্লিরা।
বাংলাদেশে ইজতেমা আরম্ভ হওয়ার পর থেকে এ পর্যন্ত ৫০বার বিশ্ব ইজতেমা সুন্দরভাবে সম্পন্ন হলেও এবারই প্রথম ইজতেমা কোনো রাজনৈতিক কর্মসূচির মাঝে পড়ল। সে হিসেবে বলা যায়, এবারই প্রথম বিশ্ব ইজতেমা রাজনৈতিক থাবায় রক্তাক্ত হলো। রাজনীতির কাছে পরাজিত হলো দুই পর্বে ইজতেমায় অংশ নেওয়া ৫০-৬০ লাখ মানুষের ধর্মীয় আবেগ। অথচ এরা সবাই ভোটার, এই দেশের নাগরিক।
তাদের ভোটে রাজনৈতিক নেতারা ক্ষমতায় বসার সুযোগ পান, ভোগ করেন ক্ষমতার স্বাদ। ইজতেমায় আগত অনেকের মন্তব্য-অবরোধের ভোগান্তি সহ্য করে যারা ইজতেমায় আসছেন, তারা রাজনীতির মারপ্যাঁচ নিয়ে খুব একটা ভাবেন না। তবে বিষয়টি তাদের মাথায় আছে।
৫ জানুয়ারির সমাবেশ করতে না পেরে নিজের কার্যালয়ে ‘অবরুদ্ধ’ বিএনপি চেয়ারপারসন খালেদা জিয়া ওই দিন থেকে সারাদেশে লাগাতার অবরোধের ডাক দেন। বিশ্ব ইজতেমায় মুসল্লিদের কথা ভেবে অবরোধ তুলে নেওয়ার আহ্বান জানানো হলেও তাতে সাড়া পাওয়া যায়নি।
ইতোমধ্যে এই কর্মসূচির কারণে রাজধানীসহ দেশের বিভিন্ন এলাকায় বেশ কয়েকজনের প্রাণহানি হয়েছে। আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্যসহ আহত হয়েছেন অনেকে। বাস-ট্রাকসহ বিভিন্ন যানবাহনে ভাঙচুর ও অগ্নিসংযোগ করা হয়েছে। অবরোধের মধ্যে রাজধানীসহ দেশের প্রধান প্রধান শহরগুলোতে গাড়ি চলাচল প্রায় স্বাভাবিক থাকলেও দূরপাল্লার যান চলাচল ব্যাহত হচ্ছে।
ফলে ইজতেমাগামী লোকদের পোহাতে হচ্ছে নানাবিধ ভোগান্তি। এক ধরনের অজানা শঙ্কা, উদ্বেগ ও আতঙ্ক মাথায় নিয়ে আসতে হচ্ছে ইজতেমায়।
ফলে সাধারণ মানুষ এই সময়ে অবরোধ কর্মসূচি বহাল রাখায় সঙ্গত কারণেই প্রশ্ন তুলছেন। অন্যদিকে, রাজনীতিকদের দায়িত্ববোধ নিয়েও প্রশ্ন দেখা দিচ্ছে। এটা তাদের স্বার্থবাদিতা, অদূরদর্শিতা, সংকীর্ণতা ও অপরিপক্বতার পরিচায়ক বৈ অন্য কিছু নয়।
বিশ্ব ইজতেমায় ৫ মহাদেশ থেকেই লোকজন এসেছেন, তারা দেখছেন আমাদের রাজনীতির কদর্য রূপ। এটা বিশ্ববাসীর সামনে কোন বাংলাদেশের পরিচয় দিচ্ছে? আসলে আমাদের দেশে রাজনীতি যে বিবর্ণরূপ ধারণ করেছে এবং সহিংসতা-সংঘাত রাজনীতিতে যেভাবে মুখ্য হয়ে দেখা দিয়েছে; তাতে প্রশ্ন জাগে আমাদের ভবিষ্যৎ কী?
এত কিছুর পরও আমরা আশা করবো রাজনীতিকদের শুভবুদ্ধির উদয় হবে। চলমান পরিস্থিতিতে তারা সঠিক সিদ্ধান্ত নিয়ে দায়িত্বশিলতার পরিচয় দিবেন। ভবিষ্যতে জনভোগান্তি-দুর্ভোগ ও দুর্দশার বিষয়গুলো কঠিনভাবে আমলে রেখে রাজনৈতিক কর্মসূচির ঘোষণা দিবেন এমনটাই প্রত্যাশা দেশের সাধারণ মানুষের।
বাংলাদেশ সময়: ২১৫৪ ঘণ্টা, জানুয়ারি ১৬, ২০১৫