বিশিষ্ট সাহাবী হজরত আবু হুরায়রা (রা.) থেকে বর্ণিত, তিনি নবী করিম (সা.) থেকে বর্ণনা করেন, হজরত রাসূলুল্লাহ (সা.) বলেছেন, ‘কিয়ামতের দিন আল্লাহতায়ালা সাত ধরনের ব্যক্তিকে তার আরশের ছায়া দ্বারা আচ্ছাদিত করবেন যেদিন ওই ছায়া ব্যতীত আর কোনো ছায়া থাকবে না। ১. ন্যায়পরায়ণ শাসক, ২. ওই যুবক যে আল্লাহতায়ালার ইবাদতে বেড়ে ওঠে, ৩. এমন ব্যক্তি যে নির্জনে আল্লাহতায়ালাকে স্মরণ করে এবং তার নয়নযুগল অশ্রুসিক্ত হয়, ৪. ওই ব্যক্তি যার অন্তর মসজিদের সাথে ঝুলন্ত থাকে, ৫. এমন দুই ব্যক্তি যারা একে অন্যকে শুধুমাত্র আল্লাহর সন্তুষ্টি লাভের আশায় ভালোবাসে, ৬. এমন ব্যক্তি যাকে কোনো প্রভাবশালী সুন্দরী নারী কুপ্রস্তাব দেয় আর সে উত্তরে বলে আমি আল্লাহকে ভয় করি, ৭. ওই ব্যক্তি যে নিজের দানকে এমনভাবে গোপন করে যে তার বাঁ হাত জানতে পারে না ডান হাত দ্বারা কী দান করল।
আলোচ্য হাদিসে কিয়ামতের দিনের ভয়াবহ সময়ে যখন মানুষ দিগ্বিদিক ছোটাছুটি করবে একটু ছায়ার সন্ধানে তখন উপরোক্ত বিশেষণে বিশেষিত ব্যক্তিবর্গ আল্লাহতায়ালার বিশেষ কৃপা লাভ করবেন এবং তার ছায়াতলে আশ্রয় পাবেন। এখানে আল্লাহর ছায়া দ্বারা কারো কারো মতে আল্লাহতায়ালার বিশেষ তত্ত্বাবধান ও সুরক্ষাদানকে বুঝানো হয়েছে। অধিকাংশ মুহাদ্দিসের (হাদিস বিশারদ) মতে আরশের ছায়াকে বুঝানো হয়েছে যা অন্য সূত্রে বর্ণিত হাদিস দ্বারা সমর্থিত। হাদিসে বর্ণিত সাত ব্যক্তির বর্ণনা নিম্নে সবিস্তারে উল্লেখ করা হলো—
১. ন্যায়পরায়ণ শাসক। প্রখ্যাত হাদিস বিশারদ হাফেজ ইবনে হাজার আসকালানি (রহ.)-এর মতে এখানে শাসক দ্বারা কোনো দেশ বা এলাকার নির্বাহী প্রধানকে বুঝানো হয়েছে। তবে মুসলমানদের স্বার্থসংশ্লিষ্ট বিষয়ে দায়িত্বপ্রাপ্ত যে সব লোক ন্যায়ানুগ সিদ্ধান্ত গ্রহণ করবে তাদের ক্ষেত্রেও উক্ত বিধান প্রযোজ্য হবে। ন্যায়পরায়ণতা বলতে প্রত্যেককে তার প্রাপ্য অধিকার প্রদানের ক্ষেত্রে আল্লাহতায়ালার বিধান অনুসরণ করাকে বুঝানো হয়েছে। ন্যায়ের বিপরীত হলো অত্যাচার, অনাচার। আল্লাহতায়ালা পবিত্র কোরআনে কারিমে এ বিষয়ে নির্দেশ দিয়ে বলেন, ‘আর যখন তোমরা মানুষের মাঝে বিচার করবে ন্যায়পরায়ণতার সাথে করবে। ’ -সূরা আন নিসা : ৫৮
২. যে যুবক আল্লাহতায়ালার ইবাদতের মধ্য দিয়ে বেড়ে উঠে। এখানে যুবককে বিশেষিত করা হয়েছে এ কারণে যে, যৌবনকালে মানুষ প্রবৃত্তি দ্বারা বেশি তাড়িত হয়ে থাকে। তাই প্রবৃত্তিকে দমন করে আল্লাহভীতিকে প্রাধান্য দিয়ে যে যুবক আল্লাহর ইবাদতে আত্মনিয়োগ করে তার জন্য এই মহা পুরস্কার ঘোষণা করা হয়েছে।
৩. যে ব্যক্তির অন্তর মসজিদের সাথে ঝুলন্ত থাকে। অর্থাৎ মসজিদের বাইরে অবস্থান করলেও মসজিদের সাথে মন লেগে থাকে এবং অপেক্ষায় থাকে আবার কখন মসজিদে প্রবেশ করবে। কেউ কেউ এর দ্বার নিয়মিত জামাতে নামাজ আদায়ের গুরুত্বের কথা বলেছেন।
৪. এমন দুই ব্যক্তি যারা একে অন্যকে আল্লাহতায়ালার সন্তুষ্টি লাভের আশায় ভালোবাসে। উল্লেখ্য যে, এই ভালোবাসা বাহ্যিকভাবে হলে হবে না বরং তা প্রকৃতপক্ষেই ভালোবাসা হতে হবে। দু’জনে একত্রে থাকুক বা আলাদা থাকুক এই ভালোবাসায় কোনো ঘাটতি হবে না। আমাদের পূর্ববর্তীদের মাঝে এমন ভালোবাসার বহু নজির রয়েছে। ৮ম হিজরিতে সংঘটিত মুতার যুদ্ধের সেই তিন যোদ্ধার কাহিনী তো এ বিষয়ে বেশ প্রসিদ্ধ। যারা পিপাসার্ত অবস্থায় হাতের নাগালে পানি পেয়েও অন্য ভাইয়ের জন্য উৎসর্গ করেছেন এবং শাহাদতের অমিয় সুধা পান করেছেন। বস্তুত এটাই মুসলমানদের ভ্রাতৃত্বের মূর্তপ্রতীক। অন্য এক হাদিসে আল্লাহর জন্য ভালোবাসা এবং আল্লাহর জন্য শত্রুতা পোষণ করাকে ঈমানের অংশ বলে অভিহিত করা হয়েছে। এই ভালোবাসায় দুনিয়াবি কোনো স্বার্থ থাকতে পারবে না।
৫. যে ব্যক্তি লৌকিকতা পরিহার করে নির্জনে আল্লাহতায়ালাকে স্মরণ করে। সেটা মুখে হোক বা অন্তরে হোক। সেই স্মরণে সাথে সাথে তার দু’নয়ন অশ্রুসিক্ত হয়, সে থাকে সর্বদা আল্লাহর ভয়ে ভীত। এছাড়া সকল মানুষ যখন নিদ্রায় মগ্ন থাকে তখন নির্জনে আল্লাহর ইবাদতে মশগুল থাকাকে জান্নাত লাভের অন্যতম পাথেয় হিসেবে উল্লেখ করা হয়েছে অন্য আরেক হাদিসে।
৬. এমন ব্যক্তি যাকে কোনো সুন্দরী, বংশীয় ও প্রভাবশালী নারী ব্যভিচারের দিকে আহবান করে তখন সে বলে আমি আল্লাহকে ভয় করি। অর্থাৎ আল্লাহতায়ালার ভয়ে ওই নারীর আহবানকে প্রত্যাখ্যান করে যদিও তাতে কোনো দুনিয়ার শাস্তির আশঙ্কা থাকে। আল্লাহর নবী হজরত ইউসুফ (আ.) মিসরের সম্রাট পত্নী জোলায়খার আহ্বানে সাড়া না দিয়ে জেলখানাকে উত্তম বাসস্থান হিসেবে গ্রহণ করেছেন যা পবিত্র কোরআনের সূরা ইউসুফে বর্ণনা করা হয়েছে।
৭. এমন ব্যক্তি যিনি তার দানকে এমনভাবে গোপন রাখেন যেন ডান হাত কী দান করল বাম হাত জানতে পারল না। এখানে বাহ্যিকভাবে সকল প্রকার দানকে বুঝানো হলেও আল্লামা নববী (রহ.) বলেছেন, ফরজ দান গোপনে করার চাইতে প্রকাশ্যে করাই উত্তম। ইবনে মালেক বলেন, এই গোপনীয়তা নফল দানের ক্ষেত্রে প্রযোজ্য হবে, কারণ জাকাত প্রকাশ্যে দেওয়া উত্তম।
উল্লেখ্য যে, উপরোক্ত হাদিসে কিয়ামত দিবসে আরশের নিচে ছায়া প্রাপ্য যে সাত শ্রেণির লোকের কথা উল্লেখ করা হয়েছে তাতেই সীমাবদ্ধ নয়। হাফেজ ইবনে হাজার আসকালানী (রহ.) গবেষণা করে আরো অনেক বৈশিষ্ট্যের সন্ধান পেয়েছেন যেগুলো আরশের নিচে ছায়াপ্রাপ্তির ক্ষেত্রে সহায়ক হবে এবং এ বিষয়ে তিনি স্বতন্ত্র গ্রন্থও রচনা করেছেন। এতে বুঝা গেল যে, উপরোক্ত হাদিসের সাত সংখ্যাটি মুখ্য নয়।
উপরোক্ত হাদিসের আলোকে নিম্ন বিষয়গুলো মানবজাতির জন্য শিক্ষণীয়-
ক. ব্যক্তি, পরিবার, সমাজ ও রাষ্ট্রসহ সকল পর্যায়ে ন্যায়নীতি প্রতিষ্ঠা করা। এর বিপরীতে অন্যায়, অনাচার, অত্যাচারের মতো বিষয় থেকে বেঁচে থাকা। কারণ এগুলো জঘন্য অপরাধ এবং পরকালে এ জন্য কঠিন শাস্তি ভোগ করতে হবে।
খ. ইবাদত জীবনের সকল স্তরে গুরুত্বপূর্ণ হলেও যৌবনকালের ইবাদতের মর্যাদা বেশি। কারণ এ সময়ে মানুষের কুরিপু এবং কুপ্রবৃত্তি দমন অন্য বয়সের তুলনায় কষ্টসাধ্য। তাই যৌবনকালে কষ্ট হলেও ইবাদত-বন্দেগিতে মশগুল থাকা।
গ. মুমিনের অবস্থান যেখানেই হোক, যে কাজেই সে লিপ্ত থাকুক তার অন্তর সর্বদা মসজিদের সাথে সম্পৃক্ত থাকবে এবং মসজিদই হবে তার আত্মার ঠিকানা। এর ফলে মসজিদভিত্তিক সুষম সমাজ গড়ে উঠবে।
ঘ. মুমিনদের পারস্পরিক ভালোবাসা, বিদ্বেষ, হাদিয়া প্রদান, হাদিয়া গ্রহণ, সুসম্পর্ক বজায় রাখা, পারস্পরিক সহযোগিতার হাত বাড়ানো ইত্যাদি সকল কাজ হবে আল্লাহতায়ালার সন্তুষ্টি লাভের উদ্দেশ্যে। এ সব বৈশিষ্ট্য ঈমানের পূর্ণতার লক্ষণ বিশেষ।
ঙ. আল্লাহতায়ালার নৈকট্য লাভের জন্য নির্জনতা সর্বোত্তম কৌশল এবং মুমিনের চোখের পানি আল্লাহতায়ালার কাছে অত্যন্ত মূল্যবান ও প্রিয়।
চ. প্রতিকূল পরিবেশে প্রবৃত্তির বিরুদ্ধে যুদ্ধ করে নিজের সম্ভ্রম বজায় রাখা ইবাদত বিশেষ।
ছ. নফল দান-খয়রাত করার সময় সর্বোচ্চ গোপনীয়তা রক্ষা ও আত্মপ্রচার থেকে নিজেকে দূরে রাখা মুমিন চরিত্রের ভূষণ।
বাংলাদেশ সময়: ১৭০০ ঘন্টা, ০৭ ফেব্রুয়ারি, ২০১৫