কিছুদিন আগে এক পারিবারিক অনুষ্ঠানে অংশগ্রহণের জন্য গ্রামের বাড়িতে যেতে হয়। নানাবিধ কারণে জুমার নামাজ আদায়ের জন্য মসজিদে যেতে যেতে একটু দেরি হয়ে যায়, ফলে আমার জায়গা মেলে অনেক পেছনে।
জায়গা যেহেতু নেই তাই বড়রা এসে ছোটদের পেছনের দিকে সরে যেতে বলছেন; ছোটরাও বিনাবাক্যে তা মেনে নিচ্ছে। যে দৃশ্য আমরা প্রায়ই বিভিন্ন মসজিদে দেখি; তেমনি একটি স্বাভাবিক বিষয় ও দৃশ্য। তাই বিষয়টিকে আমি স্বাভাবিকই ভাবছিলাম। কিন্তু না, হঠাৎ একটি নয়-দশ বছরের বাচ্চা প্রতিবাদ করে বলে উঠল, ‘আমি আগে এসেছি। সুতরাং আমি এই জায়গা ছাড়ব না। ’ গোলটা বাধে তখনই। সত্যিই তো। এই বাচ্চা আমাদের অনেক আগে মসজিদে এসেছে। তার নামাজ পড়ার জায়গা পেছনে হবে কেন? তাহলে কি ছোটদের মসজিদে আসা নিষেধ?
আমরা প্রায়ই দেখি অনেকে তাদের ছোট বাচ্চাদের সঙ্গে নিয়ে মসজিদে নামাজ পড়তে আসেন। শিশু-কিশোররা তাদের বাবা, চাচা, মামা বা বড় ভাইদের সঙ্গে নামাজ আদায় করতে আসে। আর এভাবেই সে ধীরে ধীরে মসজিদে আসতে অভ্যস্ত হয়ে ওঠে। ছোট বাচ্চাদের এভাবে মসজিদে আসা একটি দীর্ঘ পারিবারিক ও ধর্মীয় ঐতিহ্যরূপে বিবেচিত হয় আমাদের সমাজে। শিশু-কিশোররা এভাবে দীনের বিভিন্ন বিষয় শিখতে পারে; নামাজ তো আছেই। কিন্তু অনেকের একটি নেতিবাচক ধারণা এই ঐতিহ্যধর্মী ধর্মীয় শিক্ষাকে ম্লান করে দিচ্ছে। বাধাগ্রস্ত করছে ইসলামের চেতনাকে। ছোটদের বঞ্চিত করছে ইসলামের আলো থেকে।
আমাদের সমাজে ‘শিশু-কিশোরদের পাশে নামাজ পড়লে নামাজ মাকরুহ হয়ে যাবে’ বলে একটি কথা চালু আছে। সুতরাং আর বাধা কোথায়? অনেক মুসল্লি তাদের নামাজকে মাকরুহমুক্ত রাখতে ছোট শিশু দেখলেই তাকে ধুর-ধুর করে তাড়িয়ে দেন, তার না আবার নামাজ মাকরুহ হয়ে যায়! বাংলাদেশের অধিকাংশ মসজিদের চিত্রই এ রকম। বাচ্চারা এ ধরনের ধমক খেয়ে মসজিদবিমুখ হচ্ছে। অনেক বাচ্চাকে দেখেছি, নামাজ পড়ার কথা বললে ওরা আঁতকে ওঠে। ওদের কচি মনে মসজিদ এবং মসজিদের মুসল্লিদের ব্যবহার সম্পর্কে একটি বিশাল নেতিবাচক ধারণার সৃষ্টি হচ্ছে, যা আমরা কেউই খেয়াল করছি না। এভাবে চলতে থাকলে এই শিশু-কিশোররা হয়তো আর ভবিষ্যতে মসজিদমুখী হতে চাইবে না।
প্রশ্ন হলো, তাহলে কি শিশু-কিশোররা মসজিদে যেতে পারবে না? আসুন দেখি হজরত রাসূলুল্লাহ (সা.)-এর জীবনাচার। আবু দাউদ শরিফের এক হাদিসে এসেছে, এক সাহাবি ইরশাদ করেন, ‘আমরা একদা জোহর কিংবা আসর নামাজের জন্য অপেক্ষা করছিলাম। হজরত বেলাল (রা.) হজরত রাসূলুল্লাহ (সা.)কে নামাজের জন্য ডাকলেন। হজরত রাসূলুল্লাহ (সা.) তার নাতনি হজরত উমামাকে কাঁধে নিয়ে আমাদের কাছে এলেন। হজরত রাসূলুল্লাহ (সা.) ইমামতির জন্য নামাজের স্থানে দাঁড়ালেন। আমরা তার পেছনে দাঁড়িয়ে গেলাম। অথচ সে (উমামা) তার স্থানে তথা হজরত রাসূলুল্লাহ (সা.)-এর কাঁধেই আছে। হজরত রাসূলুল্লাহ (সা.) নামাজের তাকবির দিলেন, আমরাও তাকবির দিলাম। হজরত রাসূলল্লাহ (সা.) রুকু করার সময় তাকে পাশে নামিয়ে রেখে রুকু ও সিজদা করলেন। সিজদা শেষে আবার দাঁড়ানোর সময় তাকে আগের স্থানে উঠিয়ে নিতেন। এভাবে নামাজের শেষ পর্যন্ত প্রত্যেক রাকাতেই তিনি এমনটি করে গেলেন। ’
নাসায়ি শরিফে বর্ণিত এক হাদিসে আছে, ‘হজরত রাসূলুল্লাহ (সা.) খুতবা দেওয়ার সময় তার নাতি হাসান ও হোসাইন (রা.) এলে তিনি খুতবা দেওয়া বন্ধ রেখে তাদের জড়িয়ে ধরে আদর করতেন, কোলে তুলে নিতেন, চুম্বন করতেন আর বলতেন, খুতবা শেষ করা পর্যন্ত আমি ধৈর্যধারণ করতে পারব না। তাই আমি খুতবা দেওয়া বন্ধ করেই এদের কাছে চলে এসেছি। ’
এখন প্রশ্ন হলো, হজরত রাসূলুল্লাহ (সা.) যদি তার নাতনিকে কাঁধে নিয়ে ইমামতি করতে পারেন, তাহলে আমাদের ছেলেমেয়েদের মসজিদে নিয়ে আসতে দোষ কী? কোন যুক্তিতে বড়রা তাদের বকাঝকা করেন কিংবা ধমক দেন? কোথায় পেলেন তারা ধমক দেওয়ার বা শিশুদের তাদের জায়গা থেকে উঠিয়ে দেওয়ার শিক্ষা? এই ব্যবহার কি ইসলামের মূল আবেদনকে ক্ষতিগ্রস্ত করছে না? আমি অস্বীকার করব না- ছোট বাচ্চারা মসজিদে এসে দুষ্টুমি করে না কিংবা হাসাহাসি ও গল্পগুজব করে বড়দের নামাজে ব্যাঘাত ঘটায় না। সেটা অবশ্যই তারা করে; আর ছোটদের অভ্যাসই এ রকম। এ ক্ষেত্রে আমি বলব, ছোট বাচ্চাদের কয়েকজন একসঙ্গে মিলে বসে বলেই তারা মসজিদে অনভিপ্রেত আচরণ করে। কিন্তু তাদের যদি আমরা বড়দের কাতারের মাঝে মাঝে জায়গা করে দিই তাহলে তো আর কোনো সমস্যা থাকার কথা নয়। বড়দের সঙ্গে থাকলে তারা আর হাসাহাসি বা দুষ্টুমি করার সুযোগ পাবে না। এভাবে স্নেহ ও ভালোবাসা দিয়ে মসজিদের শিশু-কিশোরদের অভ্যাস পরিবর্তন করানোর চেষ্টা করতে হবে; ধমক দিয়ে নয়। এ ব্যাপারে আমরা আশা করব, মসজিদের ইমাম ও খতিবরা মুসল্লিদের সামনে বিষয়টি নিয়ে আলোচনা করে তাদের ভ্রান্তি নিরসনে সহযোগিতা করবেন।
বাংলাদেশ সময়: ১৭৫১ ঘণ্টা, জুন ০৯, ২০১৫
এমএ/