‘রাত পোহাবার কত দেরি পাঞ্জেরি?
এখনো তোমার আসমান ভরা মেঘে?
সেতারা, হেলাল এখনো ওঠেনি জেগে?
তুমি মাস্তলে, আমি দাঁড় টানি ভুলে;
অসীম কুয়াশা জাগে শূন্যতা ঘেরি।
রাত পোহাবার কত দেরি পাঞ্জেরি?’
ইসলামি রেনেসাঁর কবি ফররুখ আহমদ তার অমর কবিতা ‘পাঞ্জেরি’র মাধ্যমে এভাবেই ঘুণে ধরা সমাজের লোকদের জাগানোর চেষ্টা করেছেন।
বাংলা সাহিত্যের অন্যতম শ্রেষ্ঠ শক্তিধর কবি ফররুখ আহমদ— প্রধানত কবি। ফররুখের প্রতিটি রচনা বৈশিষ্ট্যপূর্ণ, সর্বজনপ্রিয় ও গভীর শিল্প-সৌকর্যে উৎকর্ষমণ্ডিত। তিনি একজন সমাজ-সচেতন, স্বজাতি-প্রেমে উদ্বুদ্ধ উদার মানবতাবাদে বিশ্বাসী কবি। আর্তমানবতার ক্রন্দনে অভিভূত ফররুখের কাব্য স্বাধীনতা ও মানবতার মুক্তির জয়গানে মুখরিত। ফররুখ কাল-সচেতন, এবং কালোত্তীর্ণ। ফররুখ ইসলামি রেনেসাঁর কবি, মুসলিম নবজাগরণের অন্যতম প্রাণ-পুরুষ।
১৯৩৯-৪৫ সালে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ, ১৯৪৩ সালে যুদ্ধজনিত মন্বন্তর, পরাধীন ভারতের স্বাধীনতা আন্দোলন বিশেষত অধঃপতিত মুসলিম জাতির উত্থানের উদগ্র বাসনা ইত্যাদি তার লেখায় প্রমূর্ত হয়ে ওঠে। তাই তিনি পরিচিতি পান মানবতার কবি হিসেবে। মানব প্রেমে উদ্বুদ্ধ কবি মানবতার সন্ধানে, মানব প্রেমের উৎসের খোঁজে জীবন দর্শনের বিভিন্ন বাঁক পেরিয়ে আশ্রয় গ্রহণ করেন ইসলামি জীবন বিধানের ছায়াতলে। ইসলাম প্রদর্শিত মানবতার পথ ও ইসলামের বিশাল উদার জীবন দর্শন কবিকে বিমোহিত করে। এ পথে তার গম্ভীর পদচারণা তাকে উদ্দীপ্ত ও শক্তিমান করেছে। তাই ফররুখ ইসলামি ঐতিহ্যকে শুধু পুনরুল্লেখ ও স্মৃতিচারণে সীমাবদ্ধ না রেখে সেই ঐতিহ্য পুনঃনির্মাণ প্রয়াসে এক সাহসী যোদ্ধার মতো কাব্য রণাঙ্গনে ঝাঁপিয়ে পড়েন।
ফররুখের কবির কাব্য প্রতিভার সঙ্গে মুসলিম ঐতিহ্যবোধ ও গভীরতর বিশ্বাসের সমন্বয় সাধনই তাকে এ পথে বিচরণে সার্থক করেছে। কবির বিশ্বাসের সঙ্গে আলোকের ও বাণীমূর্তিও দৃঢ়তর বন্ধন জাতীয় কাব্য সৃষ্টির ভূমিকায় এতটা সফলতা প্রদান করেছে। কবি ফররুখ আহমদ ঐতিহ্য সচেতন ইসলামি পুনর্জাগরণের কবি। ঐতিহ্য চেতনাকে উজ্জীবিত করার প্রয়াসে অনেক সময় তিনি তার রচনায় মরুচারিতা, সমুদ্রাভিযান ও আরব্য আবহ নির্মাণে সচেষ্ট হয়েছেন। কবি মুসলিম জাগরণের নায়ক ও ইসলামি সংস্কৃতির তুর্যবাদকদের অভিনন্দন জানিয়ে যে কবিতা রচনা করেছেন তাতে রয়েছে মুসলিম ঐতিহ্য ও মরুচারিতার মনোহর প্রতিচ্ছবি।
একটি কঠিন তিক্ত বিষয় হলো, কবি সাহিত্যিকদের সৃষ্টি তার সমকালকে যেভাবে আন্দোলিত করে পরবর্তী সময়কে সেভাবে নাড়া দেয় না। কারণ মানুষের ভাবনা, বিশ্বাস, রুচিবোধ, জীবনবোধ সময় প্রবাহের সঙ্গে নিরন্তর পরিবর্তিত হতে থাকে, নতুন ধারণা, নতুন অনুষঙ্গ জন্ম নেয় মানুষের মনে। কিন্তু এমন কিছু সৃষ্টি আছে যা কালের প্রাকার ডিঙ্গিয়ে বহুকাল মানুষের মনে দোলা দিতে থাকে। কবি ফররুখ ও ফররুখের রচনা এর ব্যতিক্রম। ফররুখের বিশুদ্ধ সাহিত্যরস, মানবিক অনুভূতি সমৃদ্ধ সৃষ্টি পানি সিঞ্চন করেছে আমাদের রাজনৈতিক অবস্থান, সাংস্কৃতিক বিষয় ও স্বদেশিকতার চেতনার শিকড়ে।
কবি ফররুখের কাব্য প্রতিভার প্রদীপ্ত ছটায় বাংলা কাব্যের দিগন্ত যেমন প্রসারিত ও আলোকিত হয়েছে, তেমন তার জীবনবোধের দীপ্তি ও ঐতিহ্যানুসারিতার স্নিগ্ধ আলোয় বাংলা সাহিত্য নব জীবন ও অপূর্ব রূপ অর্জন করেছে। শব্দানুশীলন, বাক্য বিন্যাস ও ভাষা ব্যবহারের রীতিতে ইসলামের অতীত যুগের চিত্র ও আদর্শ প্রতিফলিত হয়েছে। যা তাকে অমর করে তুলেছে।
কবি তার লেখায় সর্বদা একটি শান্তিপূর্ণ সমাজ নির্মাণের প্রত্যাশা করেন। সমগ্র মানবতা ও তার সাংস্কৃতিক ব্যবস্থা অধ্যয়ন করেন। তাই তার দৃষ্টি কেবল প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের ঘুলঘুলিতে আটকে যায়নি অথবা বিলাসিতার শুড়িখানায় হাত পা ছাড়িয়ে চিৎ হয়ে পড়ে থাকেনি; প্রেমিকার নরম চুলের ভেতর মুখ গুঁজে পারিপার্শ্বিকতাকে ভুলে যায়নি। বরং সব হতাশা ও নৈরাশ্যকে গলা টিপে হত্যা করে, সকল অকল্যাণ অন্যায়ের বিরুদ্ধে সংগ্রামমুখর হয়ে, প্রতিকূল পরিবেশের প্রাচীর ভেঙে নতুন দুনিয়া গড়ার স্বপ্ন দেখেন।
ফররুখের সাফল্য হলো, তিনি বিশ্বাস আর আবেগের তোড়ে প্রকৃত কবিতার সীমা লংঘন করেননি। কবিতার মূল্যে কণ্ঠস্বরের দাম বাড়ানোর চেষ্টা করেননি। তার বক্তব্যে উচ্চরোল ছিল, কিন্তু তা উপস্থিত করা হয়েছে কবিতার পোশাকে। এ কারণে আপন লক্ষ্যে সনিষ্ঠ থেকেও কবিতার নানা স্রোতে বিচরণ তার পক্ষে সহজ হয়েছে।
ভাব প্রকাশের উপযোগী পরিমণ্ডল সৃষ্টির প্রয়োজনে উপযুক্ত শব্দ চয়নের কৃতিত্বে কালোত্তীর্ণ। আরবি-ফারসি শব্দের যেমন যথার্থ ব্যবহার করেছেন, তেমনি তৎসম-তদ্ভব শব্দের ব্যবহারেও কার্পণ্য করেননি। বাংলা শব্দের ধ্বনির সঙ্গে আরবি-ফারসি ধ্বনির সাযুজ্যে ফররুখ আহমদের কবিতা আবৃত্তির জন্য সুষম। ফররুখের সবচেয়ে বড় কৃতিত্ব ও সফলতা হল, তিনি যা বিশ্বাস করতেন, তার কাব্যে যে সব তত্ত্বকথা আওড়াতেন নিজের জীবনে তা পূর্ণাঙ্গভাবে বাস্তবায়ন করতেন। ইসলাম, আর্দশ, সততা, সাধুতার কথা অনেক কবি-লেখকই বলেছেন, কিন্তু তাদের ব্যক্তিজীবনে নিজেরাই সেই আদর্শের পরাকাষ্ঠা দেখিয়েছেন এমন নজির খুব কম। ফররুখ আহমেদ সেক্ষেত্রে ব্যতিক্রম। তিনি কখনো নিজের আদর্শকে বিসর্জন দেননি। কোনো প্রলোভনে পড়ে তিনি তার নীতিতে আপস করেননি, দারিদ্র্যের সঙ্গে সংগ্রাম করেছেন, অভাবের সাথে যুদ্ধ করেছেন কিন্তু নীতির বিষয়ে কোনো আপস করেননি। তার ধর্মচেতনা, নৈতিকতাবোধ অত্যন্ত দৃঢ় ছিল, সেগুলো তার রচনায় প্রতিফলিত হয়েছে।
ফররুখের জীবনদর্শন ইসলাম। মানুষকে ভালোবেসেছিলেন বলেই মানবতার ধর্ম ইসলামকে ভালোবেসেছিলেন। তবে ফররুখ আহমদ কথনও অন্য ধর্মাবলম্বীদের কটাক্ষ করেননি। তিনি ইসলামী জীবনব্যবস্থাকে সেই জীবনদর্শন মনে করতেন, যার বিধানে কল্যাণ আছে সমগ্র মানবতার, শুধু মুসলমানদের নয়। মোটকথা, ফররুখ বিভ্রান্ত চিন্তার অলিতে-গলিতে ছুটে বেড়াতে চাননি। চিন্তার স্থিরতার মাধ্যমে জীবনকে কোন এক লক্ষ্যবিন্দুতে পৌঁছে দেয়ার দায়িত্ব পালন করেছেন। বলা চলে, ফররুখ তার সাধনায় সফল। তাই তো তিনি অমর হয়েছেন আমাদের মাঝে।
আজ ফররুখ অাহমদের জন্মদিন। তার প্রতি রইল আমাদের বিনম্র শ্রদ্ধা।
বাংলাদেশ সময়: ১৭০১ ঘন্টা, জুন ১০, ২০১৫
এমএ/