মুসলিম ঐতিহ্য ও সংস্কৃতির লীলাভূমি তুরস্ক পবিত্র রমজানকে স্বাগত জানায় অনেকটা রাজকীয় ঢঙে। রমজানকে স্বাগত জানিয়ে তারা আনন্দ-উল্লাস প্রকাশ করে।
শাবান মাসের ২৯ তারিখে মহল্লা ও গ্রামের প্রধানরা উঁচু স্থানে চাঁদ দেখার জন্য অবস্থান নেয়। চাঁদ দেখা গেলে তাদের পক্ষ থেকে একজন ঘোষক মসজিদে রমজানকে স্বাগত জানিয়ে ঘোষণা দেয়। এরপর রাষ্ট্রীয়ভাবে তোপধ্বনির মাধ্যমে রমজানকে স্বাগত জানানো হয়। এছাড়াও রমজানের প্রতিদিন তিনবার তোপধ্বনি দেয়া হয়। প্রথমবার সেহরি খাওয়ার জন্য, দ্বিতীয়বার রোজা রাখার জন্য বা সেহরির সময় শেষ বোঝানোর জন্য, তৃতীয়বার ইফতারের জন্য।
তুরস্কের মুসলিম অধিবাসীরা প্রতিটি ইসলামি বিধি-বিধান ব্যাপক উৎসাহ ও উদ্দীপনার সঙ্গে পালন করে। বিশেষত রমজানুল মুবারককে তারা বরণ করে ধর্মের প্রতি গভীর নিষ্ঠা প্রদর্শনের মাধ্যমে। যা সাধারণ তুর্কিদের ইসলামের প্রতি গভীর অনুরাগেরই বহিঃপ্রকাশ। যদিও প্রভাবশালী তুর্কি সামরিক বাহিনী ও অভিজাত শ্রেণী ধর্মহীন তুরস্কের চিত্র তুলে ধরতে বেশি আগ্রহী। রমজানে তুরস্কের ঘরে-বাইরে সর্বত্র শোনা যায় অভিনন্দন; ‘আপনার জন্য রমজান কল্যাণময় হোক। ’ রমজানের শেষাংশে ‘কল্যাণময়ীর বিদায়। ’
রমজান ঘনিয়ে এলে ইস্তাম্বুল শহরের মসজিদগুলোর মিনারা- যেগুলো তার উচ্চতার জন্য বিশ্বখ্যাত; সেগুলো আলোকসজ্জায় সজ্জিত করা হয়। আলোকরশ্মিতে লেখা হয়- ‘সকল মাসের সেরা হে রমজান! তোমাকে অভিনন্দন। ’ রমজান ও বিশেষ ধর্মীয় উপলক্ষ্য ছাড়া মসজিদগুলোকে এভাবে সাজানো হয় না।
পবিত্র কোরআনের প্রতি তুর্কিরা অত্যন্ত শ্রদ্ধাশীল। তারা সর্বত্র কোরআনের প্রতি সর্বোচ্চ সম্মান প্রদর্শন করে। তুর্কি মুসলিমদের ঐতিহ্য হলো, রমজানে পরিবারের সবাই মিলে কোরআন খতম করা এবং দোয়া অনুষ্ঠান করা। ইস্তাম্বুল শহরের ঐতিহাসিক, ‘তুবকাবি’ ভবনে পুরো রমজান মাসে রাত-দিন সর্বক্ষণ কোরআনে কারিমে তেলাওয়াত করা হয়। এক মুহূর্তের জন্যও তা বন্ধ হয় না।
অন্যান্য দেশের মুসলিমদের মতো তুর্কিরাও রমজানে বিশেষ খাবারের ব্যবস্থা করে। রমজান উপলক্ষ্যে তারা বিশেষ ধরনের রুটি তৈরি করে। যাকে বলা হয়, ‘রমজান বাইদুসি। ’ এর সঙ্গে আহারের জন্য তৈরি করা হয় বিশেষ ধরনের মিষ্টান্ন। আশ্চর্যের বিষয় হলো, রমজান ব্যতীত অন্য মাসে তুরস্কে খেজুর পাওয়া যায় না। কিন্তু রমজান মাসে বাজারে হরেক রকম খেজুরের সমাহার দেখা যায়। প্রতি বছর নতুন ধরনের খেজুর যুক্ত হয় তালিকায়। তুর্কিরা ইফতার আয়োজনে অবশ্যই খেজুর ও জলপাই তেল রাখে। সামান্য ইফতারের পর তারা নামাজ আদায় করে এবং তারপর তারা ভারি খাবার গ্রহণ করে। রমজানে রাস্তায় রাস্তায় খাবারের দোকান বসে। বিভিন্ন বয়সের লোকেরা লাইনে দাঁড়িয়ে তা কেনেন।
তুর্কিদের একটি উল্লেখযোগ্য সংস্কৃতি হলো, দেশের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে ‘খেরকা শরিফ’ তথা রাসূলুল্লাহ (সা.)-এর জামা মুবারক পরিদর্শনে আসা। এটি ইস্তাম্বুলের ‘ফাতেহ জাদুঘরে’ সংরক্ষিত আছে। সুলতান সালেম তার শাসনামলে হেজাজ থেকে ‘খেরকা শরিফ’টি ইস্তাম্বুল নিয়ে আসেন। ১৮৫৩ সালে ইস্তাম্বুল জামে মসজিদ প্রতিষ্ঠার পর সেখানে হস্তান্তর করা হয়। সুলতান দ্বিতীয় আবদুল হামিদ রমজান মাসে দেশবাসীকে সিন্দুক খুলে ‘খেরকা’ প্রদর্শনের রীতি প্রবর্তন করেন। সেই থেকে এ রীতি চলে আসছে। প্রত্যেক রমজানে দেশি-বিদেশি প্রায় ১৪ মিলিয়ন লোক পবিত্র খেরকাখানা পরিদর্শন করে থাকেন। এছাড়া রমজানে বিভিন্ন নবী-রাসূলের স্মৃতিবাহী ‘হাজারাতুল মুকাদ্দাসা’ বা পবিত্র পাথর পরিদর্শন করে ধর্মপ্রাণ মানুষেরা।
তারাবির নামাজের প্রতি দুই রাকাত অন্তর অন্তর তুর্কিরা গুরুত্বের সঙ্গে দুরুদ পাঠ করে এবং চার রাকাত পরপর দোয়া ও তাসবিহ পাঠ করে। রমজান মাসে তারা ব্যাপকভাবে সালাতুত-তাসবির নামাজ আদায় করে। কদরের রাত্রেও গুরুত্বের সঙ্গে ইবাদত করে। সেহরির পূর্বে একদল ঘোষক তুর্কিবাসীকে ঘুম থেকে জাগিয়ে তোলে। সেহরির পর পুরুষরা মসজিদে একত্র হয় এবং নামাজের পর দীর্ঘ সময় দোয়া ও কোরআন তেলাওয়াতে অতিবাহিত করে। এরপর একজন আলেম তাদেরকে ধর্মীয় বিষয়ে পাঠদান করেন। পাঠদানের পর তারা ঘরে ফেরে। আসর থেকে মাগরিব পর্যন্তও অধিকাংশ মসজিদে ধর্মীয় বিষয়ে পাঠদান চলে। তুরস্কের ধর্মীয় পুস্তক প্রকাশকগণ রমজানের দ্বিতীয় ও তৃতীয় সপ্তাহে নতুন নতুন ধর্মীয় গ্রন্থ প্রকাশ করে থাকেন। এক কথায় বলা যায়, রমজানে তুর্কিরা জেগে উঠে, যার প্রতিচ্ছবি দেখা যায়, মসজিদ থেকে শুরু করে অফিস-আদালত ও রাস্তা-ঘাটে। এভাবেই রমজান তাদের জীবনে পরিবর্তনের বার্তা নিয়ে উপস্থিত হয়।
বাংলাদেশ সময়: ১৯২৩ ঘন্টা, জুন ২১, ২০১৫
এমএ/