হৃদয়ের চেরাগদান তাকওয়ার রশ্মিতে উদ্ভাসিত করার জন্যই পবিত্র সিয়াম সাধনা। আবহমানকাল থেকে চলে আসা রমাজানের এই রীতির মূল উদ্দেশ্য তাকওয়া বা খোদাভীতি অর্জন।
সিয়াম সাধনা নতুন কোনো আমল নয়, প্রাচীন যে সব আহকাম পূর্ববতী আম্বিয়ায়ে কেরামের যুগ থেকে চলে আসছে রোজা এর মধ্যে অন্যতম। আনুষঙ্গিক বিচারে কিছুটা বৈচিত্র থাকলেও উম্মতভেদে রোজা একটি সুপ্রচীন আহকাম। মাহে রমজানে করণীয় বিষয়ের সঙ্গে সঙ্গে বর্জনীয় বিষয়াবলীর সংখ্যা নিতান্ত কম নয়। সুবেহ সাদেক থেকে সূর্য ডোবা পর্যন্ত ত্রিমাত্রিক নিষেধাজ্ঞা মেনে চলতে হয় এ মাসে। মৌসুম ভেদে প্রায় পনের ঘন্টা নাওয়া-খাওয়া থেকে বিরত থাকার সঙ্গে সঙ্গে আরো রয়েছে ‘কিয়ামুল লাইল’ বা বিশ রাকাত তারাবির নামাজ।
একটি যন্ত্র কিছুদিন ব্যবহার করার পর তা থেকে যথাযথ সেবা পেতে হলে স্বভাবতই তা সার্ভিসিং করিয়ে নিতে হয়। জমে যাওয়া ময়লা আবর্জনা অপসারণ এবং প্রয়োজনীয় মেরামতের মাধ্যমে যন্ত্রটি ফিরে পায় পূর্ববৎ চলৎ শক্তি। ঠিক তেমনি চারপাশে দুনিয়া নিয়ে ডুবে থাকা একজন মানুষ যেন গাফলতের চাদর ছিন্ন করে বেরিয়ে আসতে পারে, অন্তরে খোদাভীতি জাগ্রত করতে পারে; অন্তরে জমে থাকা গোনাহের অবাঞ্ছিত নাপাকিগুলো ধুয়ে মুছে পাক-সাফ করে আত্মাকে পরিচ্ছন্ন ও নির্মল করে তুলতে পারে এজন্যই মাহে রমজানের আগমন। দিনের বেলায় রোজা রাখা ও রাতের তারাবিতে শরিক হওয়াই রমজানের শেষ কথা নয়। এ মাসে যথাসম্ভব দুনিয়াবী ঝামেলা থেকে মুক্ত থাকতে হবে।
রমজান মাস মানব সৃষ্টির মৌলিক লক্ষ্যের দিকে ফিরে আসার মাস। গোটা সময়টাকে আল্লাহতায়ালার ইবাদতের জন্য ব্যয় করতে হবে। এক কথায় পবিত্র মাহে রমজানকে তাকওয়া অর্জনের স্বর্ণসোপান জ্ঞান করে যথাযথ মূল্যায়ন করতে হবে।
আমরা সর্বক্ষেত্রে যেন নববী আদর্শ থেকে বিচ্যুত হয়ে যাচ্ছি। দুঃখজনক ও অপ্রিয় হলেও এটাই বাস্তব। স্বভাবতই মাহে রমজানের মূল লক্ষ্য উদ্দেশ্য থেকে আমরা ক্রমেই দূরবর্তী সীমায় অবস্থান নিচ্ছি। আমাদের সমাজে ‘খোশ আমদেদ মাহে রমজান’ জাতীয় উক্তি সম্বলিত ফেস্টুন-পোস্টার রমজান মাসের কিছুদিন আগ থেকেই শোভা পায়। দু’মাস পূর্ব থেকে রমজানের মানসিক প্রস্তুতি গ্রহণের কথা থাকলেও আমাদের নিতে হয় অতিরিক্ত ব্যয় নির্বাহের প্রস্তুতি। যেখানে স্বল্পাহারের কারণে দ্রব্যমূল্য নিম্নগতিই ছিলো যুক্তিসঙ্গত, সেখানে গোটা কয়েক স্বার্থবাদী মানুষের গো-গ্রাস জোগাড় করতে মাথার ঘাম পায়ে ফেলতে হয় হত দরিদ্র শ্রমজীবীশ্রেণিসহ দেশের সর্বস্তরের মানুষের। অবশ্য একথাও মিথ্যে নয় যে, আমরা অনেকেই সংযমের পরিবর্তে অন্য মাসের তুলনায় এ মাসে খাদ্যসূচিতে বৈচিত্রের সমাহার ঘটাই। যেখানে উদরপূর্তি করে ইফতার না করার প্রতি হেদায়েত দেয়া হয়েছে, সেখানে আমরা রোজার মূল উদ্দেশ্যে ব্যহত হয় এমন খাদ্যাভ্যাস গড়ে তুলি এ মাসে। এগারো মাস তিন বেলা খাবার গ্রহণ করলেও অনেকেই এ মাসে অন্তত চার বার আহার করা হয়। আমাদের এজাতীয় ভোজন বিলাস রোজার মূল উদ্দেশ্যকে অনেকাংশেই ব্যহত করছে।
রমজান মাসে অধিনস্তদের কাজের বোঝা হালকা করে দেয়ার নির্দেশ থাকলেও আমাদের সমাজে তা ডুমুরের ফুল। খেটে মানুষের কষ্ট বোঝার মত অনুভুতিটুকুও আমরা আজ হারাতে বসেছি। অথচ হত দরিদ্য মানুষের দুঃখ-কষ্ট বুঝে তাদের ব্যতায় ব্যথিত হওয়া পবিত্র রমজানের একটি অন্যতম উপলক্ষ্য। এ মাসে কাজ হালকা করা শ্রমজীবী মানুষকে রোজা রাখার প্রতি উদ্বুদ্ধ করার নামান্তর। এতে সরাসরি এ হাদিসের সওয়াবের পাশাপাশি ‘ভালো কাজে উৎসাহদানের ফজিলত সম্বলিত হাদিসের সওয়াবও আশাকরি লাভ করা যাবে। সরকারি-বেসরকারি অফিস আদালতেও কাজের চাপ কিছু অংশে হলেও হ্রাস করে দেয়া কাম্য, শুধু কাজের সময় এগিয়ে নেয়াই যথেষ্ঠ নয়।
শুধু বাইরে নয়, ঘরের অভ্যন্তরে যারা কাজে কর্মে থাকে তাদের কাজের চাপও কমিযে দেয়া বাঞ্ছনীয়। অনেক সময় দেখা যায়, সারাদিন ঘরের কাজ করার পরেও দিন শেষে বাহারী রকমের ইফতার সামগ্রী তৈরির আয়োজনে গোটা বিকেলটাই ব্যয় করতে হয় তাদের। অথচ এ সময়টা ছিলো আল্লাহতায়ালার দিকে রুজু হওয়ার সময়। এতে তাদেরও সুযোগ করে দেয়া উচিত বৈকি! এটি ভোজন বিলাসের সময় নয়; বরং পরম দু’টি প্রাপ্তির অন্যতমটি অর্জনের মুহূর্ত। এতে সকলকে সুযোগ করে দেয়া কাম্য নয় কি?
নিকটবর্তী অতীতেও সেহরির সময় ঘরের ছোট্ট শিশুটিকেও ঘুম থেকে জাগানো হতো এবং এই সেহরি গ্রহণের অভ্যাস গড়ে তোলা হতো। এটি ছিলো শিশুদের জন্য একটি আনন্দঘন মুহূর্ত। বিষয়টি একটি শিশুর অন্তরে দারুণভাবে রেখাপাত করে, যা তার পরবর্তী জীবনে জন্য বড় ধরণের পাথেয় হতে পারে। কিন্তু বর্তমানে এই সুন্দর রীতিতে ভাটা পড়েছে। স্বাস্থ্যহানীর বাহানায় কিশোর সন্তানটিকে রোজা রাখতে দেয়াতো দূরের কথা সেহরির সময় ঘুমও ভঙ্গানো ক্ষতিকর মনে করেন বর্তমান যুগের মাতা-পিতা। শুধু তাই নয়, বাবা পাক্কা পাঁচ ওয়াক্তের মুসল্লি, ফজরের নামাজে যওয়ার সময় ছেলের গায়ের চাদরটা টেনে ঠিক করে দিয়ে যান, পাছে কলিজার টুকরার ঘুমের ব্যঘাত ঘটে কি না!
আমরা জানি, শৈশবে ধর্মীয় শিক্ষার গুরুত্ব দিতে উদাসীন হলে এর পরিণাম হয় ভয়াবহ। এ ধারা চলতে থাকলে ভবিষ্যতে ধর্মীয় মূল্যবোধের সমাজ ডুমুরের ফুলে পরিণত হবে- যা কোনোভাবেই কাম্য নয়।
রমজান মাসের প্রতিটি মুহূর্ত মহামূল্যবান। কিন্তু অনেক ক্ষেত্রেই এর যথাযথ মূল্যায়ন করা হয় না। অলস সময় পার করা হয় এ মাসে। সময় পার করার জন্য গীবত শেকায়েতের মত ঘৃণ্য কাজ যখন বেয়ে নেওয়া হয়, তখন বিষয় হয় আরো আফসোসের। তবে এর চেয়ে আরো ভয়াবহ উপায়ে কেউ কেউ পবিত্র মাহে রমজানের সময় পার করে থাকে। পানাহারের মত মৌলিক হালাল কাজগুলো যে মাসে সে মাসে বদ নজরী বা এ জাতীয় মৌলিক হারাম কর্ম কতটা গর্হিত তা বলাই বহুল্য।
বিজ্ঞান ও প্রযুক্তির উন্নতি সাধনকল্পে শ্রমশক্তি ব্যয় করার মত মানুষের অভাব আমাদের সমাজে। পার্থিব উৎকর্ষ সাধনের জন্য সমাজের প্রায় সর্বক্ষেত্রর মানুষ যেন মরিয়া হয়ে ছুটছে। কিন্তু আত্মিক উন্নতির জন্য অন্তত একটি মাস কি খুব বেশি? তাকওয়া অর্জনের এই পথে একাকি চলা দুরূহ ব্যাপার। তাই তাকওয়ার স্বর্ণসোপান পবিত্র রমজানে সে পথে চলতে হবে পথচেনা মানুষের হাত ধরে। তাহলে ইনশাআল্লাহ পবিত্র মাহে রমজানের আবেদন নববী আদর্শের আলোকে যথাযথভাবে বাস্তবায়নে সক্ষমতা অর্জন করা যাবে।
বাংলাদেশ সময়: ১৫০১ ঘন্টা, জুলাই ০৩, ২০১৫
এমএ