উজিরপুর (বরিশাল) থেকে ফিরে: চারপাশে আলোর ঝলকানি। আগুন রঙের কী দারুণ খেলা।
বলছি, বায়তুল আমানের কথা। কোনো অন্য দেশের নয়, বাংলাদেশেরই।
একটি উপজেলার আওতাধীন ইউনিয়নে যার অবস্থান। এশিয়ার অন্যতম মনোরম সৌন্দর্যের এ স্থাপনাটির নাম ‘বায়তুল আমান জামে মসজিদ ও ঈদগাহ কমপ্লেক্স’। প্রায় দুই লাখ ১০ হাজার শ্রমিকের শ্রম-ঘামে নির্মিত মসজিদটি। এটি কেবল এশিয়াই নয়, বিশ্বের অন্যতম সুন্দর মসজিদগুলোরও একটি- মত বিশ্লেষকদের।
বরিশালের উজিরপুর উপজেলার গুঠিয়া ইউনিয়নের চাংগুরিয়া গ্রামে (বরিশাল-বানারীপাড়া মহাসড়ক) ১৪ একর জায়গায় প্রতিষ্ঠিত বায়তুল আমান কমপ্লেক্স। যাকে ‘গুঠিয়া মসজিদ’ হিসেবেও চেনেন অনেকে। মহানগরী থেকে ২২ কিলোমিটার দক্ষিণ-পশ্চিমে বানারীপাড়া সড়ক সংলগ্ন উজিরপুরের গুঠিয়া ইউনিয়নে প্রতিষ্ঠিত আধুনিক এই মসজিদটির অন্যতম বৈশিষ্ট্য হলো- বিশ্বের ১৯টি পবিত্র স্থানের মাটি ব্যবহৃত হয়েছে এর নির্মাণে।
মূল ফটক দিয়ে প্রবেশ করতেই হাতের বাঁয়ে রয়েছে বিস্তারিত লেখা ফলক। তা থেকে জানা যায়, পবিত্র কাবা শরিফের মাটি, মহানবীর (সা.) জন্মস্থানের মাটি, আরাফাত ময়দান, মুজদালিফা, জাবালে নূর-সুর-রহমত (পাহাড়), ওহুদের যুদ্ধের স্থান, জান্নাতুল বাকি, মসজিদে নববী, খাজা মঈনুদ্দীন চিশতীর মাজারসহ আরও বেশ কিছু গুরুত্ববহ স্থানের মাটি সরাসরি ব্যবহার করা হয়েছে বায়তুল আমানের নির্মাণে।
এক বিকেলে ওমান থেকে এখানে আসেন মো. গোলাম কুদ্দুস। ২৬ বছর ধরে প্রবাসী তিনি। সেখানে থাকতেই জেনেছেন বায়তুল আমান সম্পর্কে। তা থেকে দেখার আগ্রহ জন্মায়। দেশে ঈদ করতে এসেছেন। ফলে সময় সুযোগ করে চলে এলেন গুঠিয়ায়।
তিনি বাংলানিউজকে বলেন, আমি ওমানে থাকতেই এ মসজিদের ছবি দেখে মুগ্ধ হই। শুধু তাই নয়, সে দেশের নাগরিকরাও মসজিদের কারুকাজে বিস্ময় প্রকাশ করেছেন। কারণ, এটি অনেক বেশি সুন্দর।
বিস্ময় কেন, জানতে চাইলে তিনি বলেন, একটি প্রত্যন্ত জনপদে এ ধরনের বিশ্বমানের স্থাপনা সত্যিই বিস্ময়ের। বায়তুল আমান জামে মসজিদকে সৌন্দর্যের দিক দিয়ে ওমানের রাজধানী ও প্রধান শহর মাস্কাটের গ্রান্ড মস্কের সঙ্গে তুলনা করেন তিনি।
গোলাম কুদ্দুস মনে করেন, মূলত গ্রামে এ মসজিদের অবস্থান হওয়ায় প্রচারণা অনেক কম। এমনটা হতে পারে না। অনেক মানুষ জানেন না, তাদের জানাতে হবে। তবেই অনেক মানুষ ঘুরতে আসবেন। প্রয়োজন সরকারি ও প্রশাসনিক পর্যায়ে এগিয়ে আসা। শুধু ধর্মীয় দিক নয়, বায়তুল আমান আদর্শ বিনোদনকেন্দ্র হতে পারে বলেও মত দেন এই প্রবাসী।
স্থানীয় ব্যবসায়ী এস সরফুদ্দিন আহমেদ সান্টু অপরূপ এই মসজিদ তৈরিতে অর্থায়ন করেন। ২০০৩ সালে মহান বিজয় দিবসে শুরু হয় নির্মাণ কাজ। তার অাগে সরফুদ্দিন সান্টু কয়েকজন স্থপতি বন্ধুকে নিয়ে ঘোরেন সৌদি, তুরস্ক, ইরান, দুবাই, ভারত ও পাকিস্তানসহ বিশ্বের বেশ কয়েকটি দেশ। এরপর বিদেশি বিভিন্ন স্থাপত্যকলার আদলে মসজিদের নকশা প্রণয়নের কাজ শুরু হয়। প্রায় তিন বছর চলে নির্মাণ কাজ। এখানে নারী-পুরুষ মিলিয়ে একসঙ্গে ২০ হাজার মানুষ নামাজ আদায় করতে পারবেন। শুধু কমপ্লেক্স নয়, মসজিদের সামনে (হাতের ডানে) রয়েছে বিশাল পুকুর। যা এমনভাবে খনন করা- যাতে পানিতে মসজিদটির পুরো প্রতিবিম্ব সুস্পষ্ট বোঝা যায়। এছাড়া এতিমখানা, ডাকবাংলো, গাড়ি পার্কিং প্লেস, চর্তুমাত্রিক লাইটিং ব্যবস্থাসহ গাছ ও বাগান রয়েছে পুরো কমপ্লেক্স ঘিরে।
প্রকৌশলী মো. জাকির হোসেন মিলন ও আমিনুল হক মসজিদের নকশা প্রণয়ন করেন। ২০ কোটিরও বেশি টাকা ব্যয়ে প্রায় তিন বছরের কর্মযজ্ঞ শেষে ২০০৬ সালের ২০ অক্টোবর জুমার নামাজ আদায়ের মধ্য দিয়ে বায়তুল আমানের উদ্বোধন করা হয়। ছারছিনা দরবার শরীফের পীর মাওলানা শাহ মোহাম্মদ মোহেববুল্লাহ এর উদ্বোধন করেন। মসজিদটি উদ্বোধনের পর থেকেই অগণিত দর্শনার্থী ভিড় জমান এর আঙিনায়।
যেমনটি বরিশাল বিশ্ববিদ্যালয়ের একদল শিক্ষার্থীর উপস্থিতি। চলছিল রীতিমতো আড্ডা। মসজিদ আঙিনায় বসে হালকা বাতাসে এপাশ-ওপাশ হওয়া ছোট চুলের সোলেমান জানাচ্ছিলেন, তার ভ্রমণ ইচ্ছার কথা। মেসে থেকে বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়তে হচ্ছে তাকে। পরিবার-পরিজন গ্রামের বাড়িতে। তবে এখানে ভালোই দিন কাটছে। প্রায়শই বিকেলে ঘুরতে অাসা হয় বায়তুল আমানে। সন্ধ্যা নেমে এলে উপভোগ করেন আলোর ঝলকানি সঙ্গে কী দারুণ সৌন্দর্য। তাতে সায় দিলেন পাশে থাকা সহপাঠী রায়হান, সাইফুল, তৌহীদুল, আসাদ, আলিনূর, আলীম, জয়ও। সবারই মত, মসজিদটির প্রচার আরও বৃদ্ধি করা গেলে ভ্রমণপিয়াসীদের আনাগোনা আরও বাড়বে। সত্যিই এটি একটি দর্শনীয় স্থান-স্থাপনা।
ইসলামিক ঐতিহ্য ও নির্মাণশৈলীর এক অনন্য দৃষ্টান্ত মসজিদটি। মনোরম শৈল্পিক কারু-কাজ মণ্ডিত অত্যাধুনিক বায়তুল আমান জামে মসজিদে ২০টি গম্বুজ ও ১টি মিনার রয়েছে। মিনারের উচ্চতা ২০০ ফুটের মতো। নয়নাভিরাম মসজিদটি পুরো দক্ষিণাঞ্চলের সর্ববৃহৎ তো বটেই, সমগ্র দেশেরই অন্যতম অধুনিক স্থাপনা। ছুটির দিনে কিংবা ঈদে ঢল নামে বায়তুল আমানে। এই ঢল সারা বছরই থাকবে যদি দেশের বিভিন্ন স্থান থেকে মানুষ ঘুরতে আসেন তো। শরীয়তপুর জাজিরার বিলাসপুরের কুদ্দুস বেপারী উচ্চ বিদ্যালয়ের শিক্ষক এবিএম আবদুস সালামের বক্তব্য এমনই।
প্রাক্তন ছাত্র-ছাত্রীদের নিয়ে চলে এসেছেন তিনি। বরিশাল বিশ্ববিদ্যালয়ে ব্যবস্থাপনা বিভাগের প্রথম বর্ষের সাইফুল ইসলাম, নাজনীন আক্তার ও নাসরিন আফরোজ তুষা শিক্ষক আবদুস সালামের শিক্ষার্থী।
তারা বাংলানিউজকে জানান, এশিয়ার মধ্যে অন্যতম আধুনিক মসজিদের খ্যাতি আছে গুঠিয়া মসজিদের। ইরানের নাসির আল মুলক মসজিদের মতো সুন্দর এর স্থাপনা। সূর্য ডোবার সময় লাল আভায় আলোকিত মসজিদ, অন্যদিকে গোধুলির সময় লাইটের আলো-ছায়ায় আরও মনোরম দৃশ্য। লেজার লাইটের খেলায় মাতামাতি কতো না সুন্দর! এসব দেখে ভালো লেগেছে তাদের। ২ লাখ শ্রমিকের শ্রম-ঘামে বিশ্বের অন্যতম একটি মসজিদ এখন উজিরপুরে। তাই তো বরিশালে এলে যে কেউ এখানে আসতে বাধ্য।
কমপ্লেক্সের মূল গেট দিয়ে প্রবেশ করলে ডান পাশে বড় পুকুর। এর চারদিকে নানা রঙের ফুল ও গাছ। দর্শনার্থীদের চলাচল ও বসার জন্য পুকুরপাড়ে রয়েছে সুব্যবস্থা। এছাড়া মোজাইক দিয়ে তৈরি শান বাঁধানো ঘাটের শীতল হাওয়া মন জুড়িয়ে দেবে। ঘাটের ঠিক উল্টো দিকে মসজিদের প্রবেশ পথে বসানো হয়েছে দু’টি ফোয়ারা। সন্ধ্যার পর থেকে আলোর ঝলকানিতে ফোয়ারাগুলো আরও অপরূপ লাগে। মসজিদের তিন পাশে খনন করা হয়েছে কৃত্রিম খাল।
মসজিদের নির্মাণে মধ্যপ্রাচ্যের তিন-চারটি বিখ্যাত মসজিদের আদল আদর্শ হিসেবে নেওয়া হয়েছে। এদিকে ২০ গম্বুজের স্থাপত্যে বায়তুল আমান মূল কমপ্লেক্স। মধ্যখানের কেন্দ্রীয় গম্বুজের চারপাশে বৃত্তাকারে ক্যালিগ্রাফিতে লেখা হয়েছে পবিত্র আয়াতুল কুরসি। শুধু তাই নয়, সম্পূর্ণ মসজিদের ভেতরের চারপাশ জুড়ে ক্যালিওগ্রাফির মাধ্যমে সুরা রহমান লেখা। অভ্যন্তরে চারকোনের চার গম্বুজের নিচে, প্রবেশ তোরণের সামনে এবং দর্শনীয় কয়েকটি স্পটে শোভা পাচ্ছে কোরআনের বিভিন্ন আয়াত ক্যালিওগ্রাফি।
এসব সুদৃশ্য লেখা ধারাপাত ও আল্পনা বর্ণিল কাঁচ, বিদেশি মার্বেল পাথর, গ্রানাইট ও সিরামিক দিয়ে করা হয়েছে। ভেতরের নয়টি গম্বুজে বিশালাকৃতির নয়টি অত্যাধুনিক ও মূল্যবান ঝাড়বাতি রয়েছে। এছাড়া মেঝেতে ভারত থেকে আনা সাদা মার্বেল পাথরের টাইলস দেওয়া। সেই সঙ্গে মুসল্লিদের সুবিধার্থে সর্বপ্রান্তে রয়েছে বিদেশ থেকে আমদানি করা অত্যাধুনিক সাউন্ড সিস্টেম। এছাড়া বিদ্যুৎ লাইনের পাশাপাশি ব্যাকআপ হিসেবে ১৫০/১৫ কেভিএ শক্তিসম্পন্ন নিজস্ব দু’টি জেনারেটরও রয়েছে। এতে রাতে বিদ্যুৎ না থাকলেও পুরো মসজিদ থাকে নয়নাভিরাম আলোর খেলাতেই।
এলাকার বাসিন্দা মো. আনিস। পরিবার নিয়ে আসেন রোজ। বিকেলে বেড়ান এবং আসর ও মাগরিবের নামাজ পড়ে বাসায় ফেরেন। তার মেয়ে মুন্নী বেগম দশম শ্রেণীতে পড়ছে, স্ত্রী মিনারা বেগমকেও এনেছেন সঙ্গে।
আনিস বাংলানিউজকে বলেন, এখানে নারী ও পুরুষদের নামাজের আলাদা ব্যবস্থা রয়েছে। তাই পরিবার নিয়ে নামাজ পড়তে আসি। আসরের নামাজ আদায় শেষে মাগরিব পর্যন্ত হাঁটি এবং ঘুরে বেড়াই। আমার বাসা এখানে। তাই রোজই আসি। আমি মনে করি, সবার একবার হলেও এ মসজিদটি দেখে যাওয়া উচিত। এখানে এলে ভালো না লেগে পারবে না।
অত্যাধুনিক সুন্দর ও মায়াময় দৃষ্টিনন্দনের মসজিদটি শুধু একটি স্থাপনাই নয়, ঐতিহ্যও বটে। এটি আধুনিক ঐতিহ্য। বাংলাদেশের মাটিতে, তাও আবার প্রত্যন্ত গ্রামে এ রকম বিস্ময়কর সুন্দর সৃষ্টি হতে পারে, ঘুরতে না এলে বিশ্বাস হবে না।
বাংলাদেশ সময়: ০০২৫ ঘণ্টা, সেপ্টেম্বর ৩০, ২০১৫
আইএ/এএসআর
** বেদে পল্লী: ১৫ পরিবারে ২ বেড়ার টয়লেট
** এই শিশুদের ভবিষ্যৎ সাপ!
** প্রধানমন্ত্রীকে অনেক ধন্যবাদ
** যেখানে হারায় না শৈশব
** তিন মাস চা বিক্রেতা, নয় মাস মজুর
** ‘আমড়া বন্ধনে’ সম্ভাবনা বিশ্ব ছোঁয়ার
** জ্যাম-জেলি, পেয়ারা ও ভাসমান হাটে আগ্রহ
** রাস্তায় ইট বিছিয়ে ব্যবসা
** ঢাকায় কেজি ৪০, এখানে মণ ৪০!
** এই পেয়ারার স্বাদই আলাদা!
** নৌকায় ভাসা বিশাল বাজার...
** থাইল্যান্ড-ভিয়েতনাম নয় ‘ভীমরুলী’